চাকরি হারিয়ে গ্রামে ফেরা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৭১ ভাগ মানুষ সরকারি সাহায্য পায়নি!

0
999
অভ্যন্তরীণ কর্মস্থল ফেরত অভিবাসী ,চাকরি হারিয়ে গ্রামে ফেরত
অভ্যন্তরীণ কর্মস্থল ফেরত অভিবাসী ,চাকরি হারিয়ে গ্রামে ফেরত

করোনা মহামারির প্রভাবে কাজ হারিয়ে এখন বেকার জীবন-যাপন করছেন দেশের কর্মজীবী মানুষদের একটি বড় অংশ। তবে সব থেকে নাজুক অবস্থায় রয়েছেন নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী অভিবাসীরা। বাগেরহাটের মোসামাৎ আসমা বেগম (ছদ্মনাম) মাসিক নয় হাজার টাকা বেতনে কাজ করতেন চট্টগ্রামের একটি তৈরি পোশাক কারখানায়। মহামারির সময় কর্মী ছাঁটাইয়ের কারণে গ্রামে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। তিন সন্তান নিয়ে নিদারুণ কষ্টে দিন পার করছেন; কোনো ধরণের সরকারি সহায়তাই পাননি।  

আসমা বেগমের মতো দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শহর থেকে গ্রামে ফেরা এক-তৃতীয়াংশ অভিবাসী বর্তমানে বেকার অবস্থায় রয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই নারী। করোনায় কাজ হারিয়ে গ্রামে ফেরা অভিবাসীদের উপর পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে কর্মস্থল ফেরত এসব অভিবাসীর ৭১ শতাংশই কোনো ধরনের সরকারি সহায়তা পাননি।

গবেষণা সংস্থা বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট- বিল্ড, দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে অভ্যন্তরীণ কর্মফেরত অভিবাসীদের উপর কোভিড-১৯ এর প্রভাব মূল্যায়নে এ জরিপ চালিয়েছে। গতকাল, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ বিল্ড আয়োজিত ‘ক্রিয়েটিং অপরচুনিটিজ ফর ডোমেস্টিক রিটার্নি মাইগ্রেন্টস অ্যান্ড এমএসএমইজ: এ কেস অব সাউথওয়েস্ট বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি ভার্চুয়াল সংলাপ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।

বিল্ড এর জরিপ থেকে জানা যায়, অভ্যন্তরীণ কর্মস্থল ফেরত এসব অভিবাসী শ্রমিকদের বেশিরভাগেরই সামান্য জমির মালিকানা রয়েছে। আর ২৭ ভাগ মানুষের কোনো জমিজমা নেই। বিল্ডের অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক মো. তাহমিদ জামি জরিপটি ফলাফল তুলে ধরে জানান, বর্তমানে এই কর্মফেরত অভিবাসীদের জীবিকার প্রধান উপায় কৃষি, মৎস্য ঘের ও গাড়ি চালনা। পূর্বের তুলনায় তাদের মোট আয়ের ৬০ ভাগ কম আয়ে জীবন-যাপন করতে হচ্ছে। তিনি আরো উল্লেখ করেন, ক্ষতিগ্রস্ত কর্মফেরত অভিবাসীদের জন্য কর্মপ্রেরণামূলক ও কল্যাণমূলক সহায়তারও যথেষ্ঠ ঘাটতি রয়েছে।  

তৃণমূল পর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রণোদনামূলক নানা সহায়তা কার্যক্রম থাকা সত্ত্বেও ক্ষতিগ্রস্থদের একটি বড় অংশ সহায়তা প্রাপ্তির বাইরে থেকে যাচ্ছে। এ বিষয়ে বিল্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম অভিবাসীকে বলেন, ‘সরকারের স্থানীয় প্রশাসনকে আরো স্বচ্ছ ও সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তৃণমূল পর্যায়ে সহায়তা প্রদানে কল্যাণমূলক অনেক পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়নকারী প্রতিনিধিরা অনেক সময় সঠিক ব্যক্তির নিকট পৌঁছাতে পারেন না। জরিপ পরিচালনাকালীন আমরা দেখেছি, ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা প্রস্তুতের সময় কখনও কখনও শহরে কর্মরত শ্রমিকদের অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল মনে করে তালিকাভূক্ত করা হয় না। কিংবা অনেক সময় দেখা যায়, জনপ্রতিনিধিরা সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক আচরণ করে থাকেন।’

এর বাইরেও তিনি আর্থিক সহায়তা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ব্যাংক, এনজিও এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কিছু কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘নিম্ন আয়ের শ্রমজীবীদের জন্য সরকারের তিন হাজার কোটি টাকার একটা তহবিল দেওয়া আছে। যেখানে ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে ৪ শতাংশ সুদহারে ঋণ পাওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু জামানত ও আবেদন পদ্ধতির জটিলতার কারণে বেশিরভাগ ভূক্তভোগী ঋণ পান না। তাছাড়া নিম্নবিত্ত এসব মানুষেরা তাদের শেষ সম্বল বসতবাড়িটিকে ব্যাংকে জামানত হিসেবে রাখতে চান না।’

‘আবার এনজিও থেকে যে ঋণ প্রদান করা হয় তার পরিমান কম এবং সুদহারও বেশি। আমাদের জরিপে উঠে এসেছে যে, এসব নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীরা সাধারণত এক লক্ষ টাকা বা তার অধিক ঋণ দাবি করে থাকেন। কারণ হিসেবে দেখা গেছে, এর আগেও তারা কোনো না কোনো ঋণের জালে আটকে আছেন। তাছাড়া এই নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষদের মধ্যে প্রতিষ্ঠানিকভাবে আর্থিক লেনদেনে অংশগ্রহণ করার মতো স্বাক্ষরতা ও সচেতনতার অভাব রয়েছে।’ এ পরিস্থিতির গভীর বিশ্লেষণ ও সংকট উত্তরণে আরো গবেষণার প্রয়োজন বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক।

এছাড়া সংলাপে অংশ নেওয়া পরিকল্পনা কমিশনের সচিব (শিল্প ও জ্বালানি বিভাগ) শরীফা খান প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, ‘অভিবাসীরা চাকরি হারিয়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছে নাকি গ্রামে নতুন সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে এ বিষয়টি ভালোভাবে চিন্তা করতে হবে। সরকার দক্ষতা নির্ভর প্রশিক্ষণ প্রদানের বিষয়ে জোর দিচ্ছে। তিনি যোগ করেন, ‘এটা অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে যে, কোভিডকালেও অনানুষ্ঠানিক খাত দেশের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।’

বিল্ড আয়োজিত সংলাপে অংশগ্রহনকারী প্রতিনিধিবর্গ

উক্ত সংলাপের বিশেষ অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমইএসপিডি বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার এম জাকের হোসেন তার বক্তব্যে বলেন, ‘ব্যাংকগুলোকে অবশ্যই তথ্য জানানোর ক্ষেত্রে দায়িত্ব নিতে হবে। ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জামানতবিহীন ঋণ প্রদানের নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। তিনি বলেন, ব্যাংক মূলত ডিপোজিটের টাকা দিয়ে ঋণ প্রদান করে থাকে। এখানে একটা সমস্যা তৈরি হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে ব্যাংক অতিরিক্ত সচেতন হতে গিয়ে সকল গ্রাহককে একই মাপকাঠিতে বিবেচনা করে। নতুন উদ্যোক্তাদের অন্যভাবে চিন্তা করতে হবে।’

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন মোংলা মিউনিসিপ্যালিটির মেয়র শেখ আবদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘লবণাক্ততার কারণে এ অঞ্চলের মাছচাষীরা সর্বশান্ত হয়ে পড়ছে। ঋণ দেয়ার পূর্বে অবশ্যই ঋণগ্রহীতাকে প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। এ বিষয়ক সচেতনতার অভাবে অনেক ঋণগ্রহীতাকে এক পর্যায়ে তাদের জমি হারাতে হয়।’

এছাড়াও অনুষ্ঠানটিতে প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রামরু’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার ড. তাসনিম সিদ্দিকী, বাংলাদেশ খাদ্য রপ্তানি অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি এস হুমায়ূন কবির, ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচি, খুলনা- আরএসসি ম্যানেজার রুবেল পারভেজ, উইনরক ইন্টারন্যাশনাল এর প্রাইভেট সেক্টর এনগেজমেন্ট ম্যানেজার আশরাফুল আলমসহ প্রমূখ।

বক্তারা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কর্মসংস্থান সংকট নিরসনে লবণাক্ততা প্রশমন, ভূমিহীন স্থানান্তরিত মানুষদের পুনর্বাসন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। প্রতিটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায়ের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর বিষয়ে জোর দেন তারা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here