শনিবার, 27 জুলাই, 2024

ইউরোপে স্বপ্নের অভিবাসন : মাধ্যম, সুযোগ ও ঝুঁকি বিশ্লেষণ

আমিনুল হক তুষার

বিগত চার-পাঁচ বছর যাবৎ বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের তুলনায় ইউরোপে অভিবাসন বেশ কয়েকটি ধাপে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিষয়টি যে শুধু অর্থনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ তা নয়, আশঙ্কাজনকও বটে। কারণ, ইউরোপে অভিবাসন এর এই প্রক্রিয়া নিয়মতান্ত্রিক নয় এবং ক্ষেত্র বিশেষে ঝুঁকিপূর্ণ।

মধ্যপ্রাচ্যের গতানুগতিক অভিবাসন ব্যবস্থাপনা, কর্মসংস্থান, ও জীবনযাপন আজকাল আমাদের বেকার যুবকদের আকৃষ্ট করে না, বরং তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে তারা প্রলুব্ধ হয় পশ্চিমা সংস্কৃতি, রীতিনীতি ও সেখানে উন্নত জীবনযাপনের প্রতি।

ফলে ইউরোপে অভিবাসনের জন্য তারা পরিবার ও তাদের নিজেদের সাধ্যের বাইরে গিয়ে প্রচুর টাকা লগ্নি বা ব্যয় করেন। ইউরোপের দেশসমূহে গন্তব্যের এই প্রবণতার অন্যতম প্রধান গন্তব্য দেশ ইতালি।

এক্ষেত্রে অভিবাসনে ইচ্ছুক ব্যক্তি দালাল দ্বারা এতটাই অনুপ্রাণিত তথা প্রলুব্ধ থাকেন যে, কোনটি বৈধ পথ, আর কোনটি অবৈধ পথ কিংবা কোন কোন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অভিবাসন করতে হয়, তাও তারা যাচাই করে দেখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না।

দালালদের প্রলোভনে তারা এতটাই মগ্ন হয়ে পড়েন যে, তাদের মস্তিষ্কে শুধু একটা চিন্তাই ঘুরপাক খেতে থাকে, তাহলো: ‘একবার ঢুকতে পারলেই হয়, কাগজ ভিসা সবই হবে’। কিন্তু এর জন্য যে তাকে ও তার পরিবারকে কতোটা চরম মূল্য দিতে হতে পারে-তা তারা বিবেচনাই করেন না।

আরো পড়ুন : অভিবাসনে মধ্যসত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য  ও নিয়ন্ত্রণের কথকতা

ইউরোপে শ্রম অভিবাসনের চিত্র

বাংলাদেশ সরকারের শ্রম অভিবাসন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএমইটির তথ্য অনুসারে মধ্যপ্রাচ্যের তুলনায় বাংলাদেশ হতে ইউরোপে শ্রম অভিবাসন খুবই সামান্য। ধারণা করা হয়, বর্তমানে প্রায় এক লাখ ৫০ হাজারের কিছু বেশি বাংলাদেশী ইতালিতে অবস্থান করছেন, যাদের বেশিরভাগই কৃষি, স্ট্রিট ট্রেডিং ও শিপ বিল্ডিং এ কাজ করেন।

২০২২ সালের বিএমইটি’র (BMET) উপাত্ত অনুসারে, ৯৪২ জন যুক্তরাজ্যে এবং সাত হাজার ৫৯৪ জন ইতালিতে বৈধভাবে (অর্থাৎ জনশক্তি ছাড়পত্র ও সঠিক ভিসা নিয়ে) অভিবাসন করেছেন।

ইতালির রোমে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের ২০২০ সালের এক নোটিস অনুসারে জানা যায়, ইতালি সরকার ঘোষণা দিয়েছে নন ইউরোপিয়ান ৩১টি দেশ হতে তারা প্রায় ৭০ হাজার মৌসুমী কর্মীর ভিসা দিবেন।

সে হিসেবে বাংলাদেশ হতে কর্মী নিয়োগের সংখ্যা বেশ কমই ( তিন হাজার ৫০০ এর অধিক নয়) হওয়ার কথা। অথচ ইউরোপীয় ইউনিয়নের (EU) বর্ডার অ্যান্ড কোস্ট গার্ড এজেন্সি ফ্রন্টেক্স (Frontex)-এর তথ্য অনুসারে ২০২০ সালে অবৈধভাবে অর্থাৎ সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ ও সমুদ্রপথে আট হাজার ৬৬৭ বাংলাদেশী ইউরোপে অনুপ্রবেশ করেছে। যেখানে এ সংখ্যা ২০২১-এ ছিলো আট হাজার ৫২৩ (যার মধ্যে শুধু ইতালিতে ছিল এক হাজার ১৪ জন, সূত্র: ইতালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) এবং ২০২২ এ সংখ্যাটি ১০ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিলো-যাদের সিংহভাগের গন্তব্য ছিল ইতালি।

সূত্র: ফ্রন্টেক্স ও ইতালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, গ্রাফিক্স: অভিবাসী ডটকম

ইতালিতে অনুপ্রবেশ বা অবৈধভাবে বাংলাদেশিদের অভিবাসনের জন্য দালালরা (brokers or human traffickers) যেসব রুট (route) বা পথ ব্যবহার করে থাকেন তার ভিতর সর্বাধিক ব্যবহৃত রুট হচ্ছে মধ্য (Central) ভূমধ্যসাগরীয় রুট (ইতালি ও লিবিয়ার সংযোগস্থল, প্রায় ৮৯%), তারপরই রয়েছে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় রুট এবং পশ্চিম বলকান ভূমধ্যসাগরীয় (সার্বিয়া হয়ে সড়ক পথ, জঙ্গল দিয়ে হেঁটে বা সমুদ্র পথে) রুট।

এছাড়া তিউনেশিয়া হয়েও অনেকে সমুদ্রপথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পারি দিয়ে ইতালি ও গ্রীস দিয়ে ইউরোপে অনুপ্রবেশ করছেন। উল্লেখ্য, ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ২৬ হাজার ৮২০ জনের অধিক বাংলাদেশী ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্তৃক চিহ্নিত পাঁচটি ভূমধ্যসাগরীয় রুট দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অনুপ্রবেশ করেছে (সূত্র: ইনফো মাইগ্রেন্টস)।

ব্র্যাক (BRAC) এর অভিবাসন কর্মসূচির তথ্যমতে, বাংলাদেশের ১০টি জেলা (যার ভিতর সর্বাধিক ঢাকা, ফরিদপুর ও সিলেট হতে) হতে ইউরোপে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের প্রবণতা রয়েছে।

ANSA’র (www.infomigrants.net) সূত্রমতে ইতালি সরকারের নিকট ২০২০ সালে বৈধ হওয়ার জন্য ৮০ হাজারের অধিক অবৈধ অভিবাসন প্রত্যাশীর আবেদন জমা পড়েছে। যার ভিতর গৃহকর্মী ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশিদের আবেদনের অবস্থান তৃতীয়।

আরো পড়ুন : নিরাপদ অভিবাসনে প্রাক-বহির্গমন প্রশিক্ষণ ও আমাদের সক্ষমতা

ফলে, এটি সহজেই ধারণা করা যায়-কী বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশী অবৈধ বা অনিয়মিতভাবে (Irregular) ইতালিতে অভিবাসন করছেন। ইতালি বা ইউরোপে অভিবাসন সবার জন্য যে সুখকর হচ্ছে, তা নয়।

বরং অনেকেই দালাল বা পাচারকারীর নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন (ধারণা করা হয় ২০১৪ থেকে ২০২২ পর্যন্ত ১৭ হাজারের অধিক বাংলাদেশির প্রাণহানি হয়েছে সমুদ্র পথে), বা উচ্চমূল্যের মুক্তিপণ দিয়ে অভিবাসন করছেন।

কেন ইতালি বা ইউরোপে অভিবাসন

বৈধ উপায়ে অভিবাসনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অনেক বাংলাদেশিই অনিয়মিত বা অবৈধ পথে ইউরোপ অভিবাসন করে থাকেন। বিষয়টি এমন নয় যে, তারা অবৈধ অভিবাসনের ঝুঁকি সম্পর্কে অবগত নন বা ধারণা নেই। বরং তাদের অনেকেই তা জেনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, উচ্চ অভিবাসন মূল্য দিয়ে অভিবাসন করছেন। এর অনেকগুলো কারণ বা ফ্যাক্টর রয়েছে, যেমন-

১. নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ : মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত অনেক বাংলাদেশিই নতুন চুক্তি(Job Contract, Work Permit or Ikama) ও ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন। ফলে তারা নিশ্চিত ও উচ্চ মজুরির চাকুরীর জন্য ইউরোপের দেশগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হন। ঝুঁকি জেনেও তারা তাই অবৈধ পথে ইউরোপের পথে যাত্রা করেন। 

২. উচ্চ অভিবাসন ব্যয় উত্তোলন : বাংলাদেশ হতে শ্রম অভিবাসনের ব্যয় অতি উচ্চ হওয়ার (Higher migration cost) কারণে বিদেশে স্বল্প মেয়াদে ও স্বল্প মজুরিতে চাকুরী করে তা উঠিয়ে আনা বেশ কষ্টসাধ্য। ফলে অভিবাসী শ্রমিকরা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে দীর্ঘসময় অবস্থানের চেয়ে ইউরোপে অভিবাসনকে শ্রেয় মনে করেন।

তাছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য অভিবাসী শ্রমিক গ্রহণকারী দেশে নাগরিকত্ব প্রাপ্তি বেশ কঠিন হওয়াতে অনেক অভিবাসী শ্রমিকই ইউরোপের নাগরিকত্বের জন্য সুযোগ খোঁজেন। তাই তারা ইতালির মতো দেশে অবৈধ উপায়ে অভিবাসনের চেষ্টা করেন।

৩. উন্নত দেশে উচ্চাভিলাষী জীবন যাপনের প্রতি আকৃষ্ট : দেশে ও বিদেশে কর্মরত অনেক বাংলাদেশি, বিশেষ করে যুব সমাজ এখন আর মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসনে আগ্রহী নয়। এর বিপরীতে তাদের আগ্রহ ইউরোপের কোনো দেশে অভিবাসন ও নাগরিকত্ব প্রাপ্তি।

ফলে দেশে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকা বা ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও-তারা ইউরোপে অভিবাসনের আশায় বিপুল পরিমাণ অর্থ লগ্নি করেন।

৪. দালাল দ্বারা প্রলুব্ধ : ‘ইউরোপে একবার ঢুকে পড়তে পারলে নাগরিকত্ব নিশ্চিত’- এই মন্ত্রে বেকার যুবকদের সহজেই প্রলুব্ধ করে আমাদের দেশের কিছু দালাল চক্র। যাদের না আছে নিজস্ব কোনো বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি, না আছে সরকারি অনুমোদন। এছাড়া অভিবাসনের ডকুমেন্ট, প্রশিক্ষণ, মেডিকেল ফিটনেস ইত্যাদির চাহিদা না থাকায় অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে দালালদের মিথ্যা প্রলোভনের ফাঁদে পরে ইউরোপে অভিবাসনের চেষ্টা করে।

গ্রাফিক্স: অভিবাসী ডটকম

বৈধভাবে অভিবাসনের সুযোগ কোথায়

ইতালিতে অবস্থিত বাংলাদেশী দূতাবাস কর্তৃক প্রকাশিত এক ডিক্রির (১০ই মে, ২০২৩) মাধ্যমে জানা যায়, ফ্লসি ২০২২ ডিক্রির আওতায় সরাসরি নিয়োগকারী-কর্মীর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে ইতালিতে কর্মসংস্থানের (সিজনাল ও নন-সিজনাল ক্যাটেগরিতে) সুযোগ রয়েছে- যদিও তার সংখ্যা বাংলাদেশিদের জন্য নির্ধারিত নয়।

এছাড়া পোল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, রোমানিয়াতেও গৃহকর্ম, নির্মাণকাজে বাংলাদেশিদের বৈধভাবে অভিবাসনের সুযোগ রয়েছে। আমাদের শুধু ইউরোপ দেখলে হবে না, বরং প্রশিক্ষিত ও দক্ষ কর্মী থাকলে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও রাশিয়াতেও উচ্চ বেতনে আমাদের কর্মীদের কর্মসংস্থান সম্ভব।

ইউরোপে অভিবাসন নিরাপদকরণে অবশ্য করণীয়

আমাদের মনে রাখতে হবে, যে সব দেশের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই বা অভিবাসী শ্রমিক নিয়োগে কোনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক করা হয়নি-এমনসব দেশে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ বা অভিবাসন না করাই শ্রেয়।

আরো পড়ুন : অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ও অভিবাসী নারীর ক্ষমতায়ন

অন্যদিকে যেসব দেশে যাওয়ার সুযোগ আমাদের রয়েছে, সেসব দেশে অভিবাসনের জন্য সেই দেশের অভিবাসন নীতি ও আমাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিয়ম অনুসরণ করে অভিবাসন করে অধিক গ্রহণযোগ্য ও নিরাপদ।

এছাড়া চাহিদা অনুসারে কারিগরি প্রশিক্ষণ গ্রহণ, ভাষা শিক্ষা গ্রহণ ও অনুমোদিত এজেন্সির মাধ্যমে অভিবাসনের প্রস্তুতি অনেকটাই মানব পাচারের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে অনিরাপদ অভিবাসনের ঝুঁকি, প্রভাব ও ফলাফল সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা, মানব পাচার প্রতিরোধে ও পাচারকৃত ব্যক্তিদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, ইউরোপে বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য নতুন শ্রম বাজার সৃষ্টিতে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি ইত্যাদি পদক্ষেপ ইউরোপে নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে পারে।

তথ্যসূত্র

www.infomigrants.net, www.thedailystar.net, www.dw.com

লেখক: শ্রম অভিবাসন বিশ্লেষক উন্নয়ন কর্মী

Get in Touch

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Related Articles

অভিবাসীর সঙ্গে থাকুন

10,504FansLike
2FollowersFollow
96SubscribersSubscribe

সাম্প্রতিক ঘটনা