দালালের প্রলোভনে আকাশছোঁয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন বরিশালের বাকেরগঞ্জের দুধল গ্রামের আব্দুল জব্বার। সেই প্রলোভনের ফাঁদ এতটাই মোহময়তায় পূর্ণ ছিলো যে, দুই শিশু সন্তান আর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর শত বারণও তাকে টলাতে পারেনি দেশান্তরী হতে। যদিও আব্দুল জব্বারের স্বপ্ন পূরণ হয়নি, উল্টো ভিনদেশে হারিয়ে গিয়ে উদ্বাস্তু জীবনের সঙ্গী হতে হয়েছে; পরিবার, স্ত্রী-সন্তান ছাড়াই কাটাতে হয়েছে দীর্ঘ ৩৫ বছর।
আশার কথা হলো, হারিয়ে যাবার ৩৫ বছর পর আব্দুল জব্বার শেষপর্যন্ত স্বদেশে ফিরতে পেরেছেন, খুঁজে পেয়েছেন পরিবার-পরিজন। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের উদ্যোগে গতকাল পাকিস্তান থেকে আব্দুল জব্বারকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।

আব্দুল জব্বারের দেশে ফিরে আসা সম্পর্কে জানতে অভিবাসী ডটকম এর সঙ্গে কথা হয় তার ও তার পরিবারের। পরিবারের পক্ষ থেকে এসময় জানানো হয়, আব্দুল জব্বার তিনবার হার্ট অ্যাটাক করেছেন। তার শরীরের অবস্থা ভীষণ খারাপ। পা ফুঁলে উঠেছে, হাতে প্রচণ্ড ব্যথা। সুস্থ হতে খানিকটা সময় লাগবে।
এসময় আব্দুল জব্বারের ছেলে কামাল হোসেনের মাধ্যমে তার সঙ্গে কথা হয় অভিবাসী ডটকম এর। দীর্ঘদিন পাকিস্তানে থাকার কারণে তিনি ভালো বাংলা বলতে পারেন না। তাকে প্রশ্ন করা হয় কেমন আছেন? তিনি বলেন, ‘আমি ভালো আছি আল্লাহর রহমতে।’ সবাইকে দেখে কেমন লাগছে? ‘আচ্ছা (ভালো) লাগছে। বহুত (খুব) খুশি আমি। আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে ভালো থাকতে চাই (কান্নাজড়িত কণ্ঠে)।’
এসময় তার পাশে বসেছিলেন স্ত্রী রাশেদা বেগম। তার সঙ্গেও কথা হয় অভিবাসী ডটকম এর। তিনি বলেন, ‘উনি যখন বিদেশ যেতে চান, তখন আমার ছেলে মেয়ে একেবারেই শিশু। আবার আরেক সন্তান গর্ভে। এরকম পরিস্থিতিতে আমি তাকে বিদেশে যেতে নিষেধ করি। কিন্তু তিনি কষ্ট পাচ্ছিলেন। এটা দেখে শেষপর্যন্ত বললাম ঠিক আছে যাও।’
তাকে প্রশ্ন করা হয়, ওই সময় বিদেশ যাওয়ার জন্য কেনো এতো আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন তিনি?
‘দালালদের খপ্পরে পড়েছিলেন। তারা আকাশছোঁয়া স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তাকে। এই প্রলোভনে পড়ে তিনি ভেবেছিলেন, বিদেশে যেতে পারলেই তিনি অনেক ধনী হয়ে যাবেন’-বলেন রাশেদা বেগম।
তিন তিনটি বাচ্চা নিয়ে তখন কত যে ঝড় তুফান মোকাবিলা করেছি, ইয়ত্তা নেই। এখন ওরা বড় হয়েছে আমি সুখী। কিন্তু ওই পরিস্থিতি যে কতোটা কঠিন আর ভয়াবহ ছিলো, তা কাউকে বোঝাতে পারবো না।
-আব্দুল জব্বারের স্ত্রী রাশেদা বেগম
স্বামী অবর্তমানে তিন সন্তানকে নিয়ে কঠিন এক লড়াই করতে হয়েছে রাশেদা বেগমকে। দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে তিনি তার সন্তানদের আগলে রেখেছেন, বড় করেছেন। এ নিয়ে তার ভাষ্য, ‘তিন তিনটি বাচ্চা নিয়ে তখন কত যে ঝড় তুফান মোকাবিলা করেছি, ইয়ত্তা নেই। এখন ওরা বড় হয়েছে আমি সুখী। কিন্তু ওই পরিস্থিতি যে কতোটা কঠিন আর ভয়াবহ ছিলো, তা কাউকে বোঝাতে পারবো না। অনেক কষ্টের মধ্যেই ওদের বড় করেছি। আমাকে সাহায্য করার মতো কেউ ছিলো না।’
এসময় রাশেদা বেগম জানান, দুয়েক দিনের মধ্যে তিনি তার স্বামীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাবেন এবং ওখানেই বাকি জীবনটা দু’জন মিলে কাটিয়ে দিবেন।
আব্দুল জব্বার যখন বিদেশ যান তখন ছোটো ছেলে কামাল হোসেন পৃথিবীর মুখ দেখেননি। বাবার আলিঙ্গন আর স্পর্শ ছাড়াই ৩৫টি বছর পার করেছেন। প্রথমবার তাই বাবাকে দেখার অনুভূতি ছিলো তার জন্য একেবারেই অন্যরকম।
অভিবাসী ডটকমকে তিনি বলছিলেন, ‘এটা আসলে অকল্পনীয়। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের অশেষ কৃপা ও রহমত যে, তিনি আমাদের দোয়া ও আর্জি কবুল করেছেন। এবং এতগুলো বছর পেরিয়ে যাবার পরও আমাদের কাছে বাবা ফিরে এসেছেন। এই অনুভূতি খুবই আনন্দের। যার সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা করা যায় না। এতগুলো বছর পর বাবা আমাদের কাছে ফিরে এসেছেন, এর চেয়ে ভালো লাগার অনুভূতি আর কীইবা হতে পারে!
আব্দুল জব্বার বিদেশে যাওয়ার তিনমাস পর জন্ম হয়েছিলো কামালের। যিনি ২০১৯ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গনিত বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে এখন চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
আব্দুল জব্বার বিদেশ গেলেন ঠিকই, কিন্তু…
১৯৮৮ সাল। ভাগ্য বদলানোর আশায় বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আবদুল জব্বার। দালালের সঙ্গে চুক্তি ছিল তাকে ইরান পাঠানো হবে। সে অনুযায়ী দালালরা তাকে প্রথমে নেয় ভারত।
এরপর পাকিস্তান হয়ে ইরান যাওয়ার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পাকিস্তানেই আটকা পড়েন তিনি। তিন মাস জেল হয় তার। জেল থেকে বেরিয়ে আবদুল জব্বার পরিবারের কাছে একটি চিঠি পাঠান এটা উল্লেখ করে যে, ভয়াবহ বিপদে আছেন তিনি। সেই চিঠি তার স্ত্রীর হাতেও এসেছিলো। কিন্তু কোনো ঠিকানা বা অন্য কোনো যোগাযোগ মাধ্যমের উল্লেখ না থাকায়, আর যোগাযোগ করতে পারেননি তিনি। এভাবেই মাঝখানে কেটে যায় ৩৫ বছর!

এরপর চলতি বছরের আট জানুয়ারি পাকিস্তান থেকে তার বড় ভাই আব্দুল রশিদের ঠিকানায় পুনরায় একটি চিঠি পাঠান তিনি।
একটি চিঠির সূত্র এবং সন্তানের নিরন্তর প্রচেষ্টা
৩৫ বছর পর হঠাৎ আসা ওই চিঠির সূত্র ধরে পাকিস্তানের বিভিন্ন কমিউনিটি গ্রুপে পোস্ট দেন তার ছোটো ছেলে মোঃ কামাল হোসেন। সবাইকে অনুরোধ করেন, চিঠির ঠিকানায় গিয়ে তার বাবার খোঁজ করতে। একপর্যায়ে একজন ডাক্তার তাতে সাড়া দেন। ঠিকানা অনুযায়ী গিয়ে তিনি কামালকে জানান তার বাবা সেখানে আছেন। কিন্তু কীভাবে বাবাকে দেশে ফিরিয়ে আনবেন, তার কোনো কিনারা পাচ্ছিলেন না।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা
ঠিক ওই সময়ে গণমাধ্যমে একটি সংবাদ দেখেন কামাল। যেখান থেকে জানতে পারেন, ব্র্যাকের সহায়তায় ২৫ বছর পর সৌদি আরব প্রবাসী আবুল কাশেমের সন্ধান পেয়েছে তার সন্তানেরা। এই সংবাদটিই কামালকে আশার আলো দেখায়। এরপর কামালই যোগাযোগ করেন ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সঙ্গে।
দীর্ঘ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে আব্দুল জব্বারকে দেশে ফিরিয়ে আনার আবেদন করা হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাকিস্তান দূতাবাসে যোগাযোগ করে। শুরু হয় অপেক্ষার পালা! এরপর পাকিস্তান থেকে পুলিশের বিশেষ শাখায় চিঠি আসে আবদুল জব্বাররের পরিচয় নিশ্চিত করতে। পরিবার ও পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ হলো। নাগরিকত্ব নিশ্চিত করে চিঠি গেল পাকিস্তানে। কাটলো আরো কয়েক মাস! অবশেষে সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে গতকাল রাতে দেশে ফিরলেন আব্দুল জব্বার!
আরো পড়ুন: ভারত থেকে ফিরলেন পাচারের শিকার ৬ বাংলাদেশি, পাশে দাঁড়ালো ব্র্যাক
এ প্রসঙ্গে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘আসলে আবুল কাশেমের ঘটনার পর সারা দেশ থেকে এমন একাধিক ঘটনার খোঁজ পাই আমরা। প্রত্যেকটি নিয়েই কাজ করছিলাম। এর মধ্যে আমাদের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের কমিউনিকেশন ম্যানেজার পাকিস্তানে আবদুল জব্বারের ঘটনা জানান।… কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। পাকিস্তান মানে অতিরিক্ত জটিলতা। তাও একজন আবার ৩৫ বছর ধরে সেখানে আটকে আছেন! বেশ স্পর্শকতার বিষয়। ঠিক করলাম রায়হান কবীরকে দায়িত্ব দেব। রায়হান কাজে নেমে পড়লো। বিস্তারিত সব তথ্য জানলাম আমরা। পরিবারের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম বৈধ কোন কাগজপত্র নেই বলে ৩৫ বছরে ধরে পাকিস্তানে আটক রয়েছেন আবদুল জব্বার। সব তথ্য নিয়ে আমরা যোগাযোগ করি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। আবেদন করা হয় ফিরিয়ে আনার।’
জনাব শরিফুল হাসান এসময় ব্র্যাকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আব্দুল জব্বারকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দূতাবাস, পুলিশসহ সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
বড় ভাইকে লেখা সর্বশেষ চিঠি। যে চিঠির সূত্র ধরে দেশে ফিরিয়ে আনা হয় আব্দুল জব্বারকে

৭৮৬ আল্লাহ ভরসা
শ্রদ্ধেয় বড় ভাই, আব্দুল রশিদ
আসসালামুয়ালাইকুম, আশা করি আপনারা সকলেই ভালো আছেন। আমিও আপনাদের সকলের দোয়ায় ভালো আছি। অনেক দিন ধরে আপনাদের কোন খবরাখবর পাই নাই, যার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো যোগাযোগ করতে পারি নাই। আমি দেশে আসতে চাই। কিন্তু পাকিস্তান থেকে দেশে আসা অনেক অসুবিধার। অনেক চেষ্টার মাধ্যমে দেশে আসা যায়। তার জন্য চেয়ারম্যান (ইউনিয়ন পরিষদ) এর থেকে পরিচয়পত্র হলে পরে দেশে আসতে পারা যায়। আমার জন্য চেয়ারম্যান থেকে পরিচয়পত্র বানানোর পরে আমার কাছে পাঠিয়ে দিবেন। প্রথমে আমার সাথে ফোনে যোগাযোগ করবেন। আমার ফোন নম্বর …-এ ফোন করবেন। ২৪ ঘণ্টা আমার কাছে থাকে। মিস কল দিলে পরেই আমি নিজেই ফোন করবো। বিশেষ আর কি লিখবো। পত্র পাওয়ামাত্রই ফোনে যোগাযোগ করবো। চেয়ারম্যান থেকে অবশ্যই পরিচয়পত্র পাঠাবেন। আমার জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ পাক যেন সর্বসময় আপনাদের ভাল রাখে আমিও দোয়া করি। আপনারা সকলে ভাল থাকেন এই কামনা করে এখানেই বিদায় নিলাম।
খোদা হাফেজ
ইতি
আব্দুল জব্বার
পাকিস্তান থেকে
(পাদটিকা) : পত্র পাওয়া মাত্রই বড় ভাই রশিদকে দিবনে আমি তার ছোটো ভাই-আব্দুল জব্বার।