দেশে দেশে রাষ্ট্রহীন মানুষ

0
1144

ধরুন আপনাকে কেউ প্রশ্ন করলো, ‘তোমার দেশের নাম কী?, তোমার নাগরিকত্বের পরিচয় কী?’ আপনার উত্তর যদি হয়, ‘আমার কোনো দেশ নেই, আমি কোনো দেশের নাগরিক নই!’ তাহলে আপনি কেমন বোধ করবেন ? এত বড় পৃথিবীতে এত শত দেশ থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তির যদি নিজের দেশ বলে পরিচয় দেয়ার কিছু না থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে তা পীড়াদায়ক ও তীব্র বেদনার!


জেনে রাখুন, পৃথিবীতে ঠিক এই মুহূর্তে শত শত মানুষের পরিচয়ের সঙ্গে দেশহীন, রাষ্ট্রহীন কিংবা নাগরিকত্বহীন শব্দগুলি যোগ হচ্ছে। যুদ্ধ, দ্বন্দ্ব, সংঘাত, বর্ণবাদ, রাজনীতি, বৈষম্য ও আইনের মারপ্যাচে প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষকে নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হতে হচ্ছে।
উল্লিখিত বিষয় ছাড়া আরো নানা কারণে মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে অন্য ভূখণ্ডে জীবন বাঁচানোর তাগিদে লড়াই করছেন লাখো সাধারণ মানুষ।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার তথ্যমতে, প্রায় ৩৯ লাখ মানুষের নিজের দেশ বলতে কিছু নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য, শুধু নাগরিক পরিচয়টুকু না থাকার কারণে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন ও চাকরির মতো সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রে তারা ব্যাপকভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন আশ্রিত দেশগুলোতে।

সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা আয়োজিত এক সম্মেলনে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো জেনেভাতে। যেখানে ‘#আইবিলং’ শীর্ষক ক্যাম্পেইনের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়। যে ক্যাম্পেইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ২০২৪ সালের মধ্যে রাষ্ট্রহীন পরিচয় থেকে সব মানুষকে মুক্ত করা এবং রাষ্ট্রহীনতার অবসান ঘটানো। কিন্তু সেই কার্যক্রম কী কোনো সফলতা বয়ে এনেছে? সেই প্রশ্নের উত্তর মিলিয়ে নিতে চলুন দেখে নেয়া যাক, পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রাষ্ট্রহীন মানুষদের বর্তমান অবস্থানের কথা:

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা সম্প্রদায়


মিয়ানমার/বাংলাদেশ: ১৯৮২ সালে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে পাস হয় নাগরিকত্ব আইন। এই আইনের ফলে মুসলিম ও দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত অধিকাংশ রোহিঙ্গা জনগণ রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ে। জাতিগত দাঙ্গায় এদের অনেকেই স্বভূমি থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশের মতো ছোটো আয়তন ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। এরই বাইরে আরো কয়েক লাখ রোহিঙ্গা এখনো মিয়ানমারে আছে, যারা কিনা প্রতিনিয়ত টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।


আইভরিকোস্ট: অনুমান করা হয়, আইভরিকোস্টে প্রায় ৬ লাখ ৯২ হাজার রাষ্ট্রহীন মানুষ রয়েছে। যাদের বেশিরভাগই পাশের দেশগুলো থেকে এসে এখানে থিতু হয়েছেন। মূলত ২০ শতকে আইভরিকোস্টে গিয়ে কফি ও সুতা উৎপাদনের কাজ করতে এই মানুষদের উৎসাহিত করা হতো। আইভরিকোস্টের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশকেই অভিবাসী হিসেবে ধরা হয়।


থাইল্যান্ড: প্রায় ৪ লাখ ৮০ হাজার মানুষ থাইল্যান্ডে রাষ্ট্রহীন পরিচেয়ে জীবনযাপন করছে। এর মধ্যে রয়েছে পাহাড়ী জনগোষ্ঠী, যেমন, ইয়াও, মং ও কারেন, যারা মিয়ানমার, লাওস ও আন্দামান উপকূলঘেষা সীমান্তবর্তী পাহাড়ী অঞ্চলে বসবাস করেন।


এস্তোনিয়া/লাটভিয়া: যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেল, অসংখ্য এথনিক রাশিয়ান এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়ায় আসতে বাধ্য হন এবং তারা এখানে অ-নাগরিক হিসেবে অ্যাখ্যায়িত হতে থাকেন, অর্থাৎ তাদের ললাটে যুক্ত হয় রাষ্ট্রহীন নামের দুঃখজনক শব্দটি। লাটভিয়াতে প্রায় ২ লাখ ২১ হাজার রাষ্ট্রহীন মানুষ বসবাস করে, এস্তোনিয়াতে এ সংখ্যা ৭৮ হাজার। রাশিয়ার এসব মানুষ তাদের নাগরিকত্বের পরিচয় নিয়ে সংকটে পড়েছিলেন এবং দীর্ঘ সময় ধরে মৌলিক অধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।

কুর্দি নারী


সিরিয়া: ১৯৬২ সালে দেশটির উত্তরাঞ্চলের কুর্দিদের নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। এ নিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পর্যবেক্ষণ বলছে, আরবিকরণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সম্পদে পরিপূর্ণ এই অঞ্চলে কুর্দিদের সঙ্গে এমন ন্যাক্কারজনক আচরণ করা হয়েছিল। গৃহযুদ্ধের আগে ৩ লাখের মতো কুর্দি ছিল সিরিয়ায়। ২০১১ সালে অভ্যুত্থানের সময় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ তাদের জাতীয়তার পরিচয় দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন।
এদিকে জাতিসংঘের তথ্য মতে, কুর্দিদের সংখ্যাটা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজারে। অবশ্য এই সংখ্যা কমে আসার অন্যতম কারণ হল, যুদ্ধের সময় অনেকই দেশের বাইরে পালিয়ে গিয়েছিল। মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, লেবানন ও জর্দানে অবস্থানরত সিরিয়ান শরণার্থী নারীরা যেসব শিশু জন্ম দিচ্ছেন সেসব শিশুর ভাগ্যে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রহীন পরিচয় যোগ হতে পারে।


কুয়েত: এখানে রাষ্ট্রহীন মানুষরা বিদুন নামেও পরিচিত। যেটি বিদুন জিনসিয়ার সংক্ষিপ্ত রূপ, আরবি ভাষায় এর অর্থ নাগরিকত্বহীন। কুয়েতে প্রায় ৯২ হাজার বিদুনের বসবাস। জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী, কিছু হিসাবে এ সংখ্যা ঢের বেশি। তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও কাজের ক্ষেত্রে বঞ্চনার শিকার হন।

বিদুন সম্প্রদায়


নেপাল: নেপাল সবসময়ই বলে আসছে তাদের দেশে কোনো রাষ্ট্রহীন নাগরিক নেই। বিপরীতে রাষ্ট্রহীন মানুষদের নিয়ে কাজ করে এমন বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এখানে কম করে হলেও লাখ খানেক মানুষ আছে, যারা ক্ষতিগ্রস্ত ও রাষ্ট্রহীন। এই সমস্যার একটি অন্যতম কারণের মধ্যে রয়েছে বিদেশি নাগরিকদের সঙ্গে নেপালের নারীদের বিবাহ আইন নিষিদ্ধকরণের বিষয়টি। কারণ এই আইনে বলা আছে, কোনো নেপালি নারী যদি ভিনদেশি কোনো পুরুষকে বিবাহ করে তাহলে তাদের সন্তানদের নাগরিকত্ব দেয় হবে না। এছাড়া ১৯৯০ এর দশকে ভুটান থেকে বিতাড়িত কিছু রাষ্ট্রহীন মানুষ এখানে বসবাস করছেন।


ডোমিনিকান রিপাবলিক: অনিরাপদ অভিবাসন ঠেকাতে দেশটিতে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন এনে ২০১৩ সালে আদালত এক রুল জারি করে। এর ফলে অসংখ্য মানুষ রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ে। যাদের বেশিরভাগেরই হাইতিয়ান বংশোদ্ভূত। এমনকি এদের অনেকেরই সন্তানও এখানে জন্গ্রহণ করেছে। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে ডোমিনিকান রিপাবলিকে ১ লাখ ৩৪ হাজারের মতো রাষ্ট্রহীন মানুষ ছিল। যদিও জাতিসংঘের দেয়া এই তথ্যের পরে আরো অসংখ্য দেশহীন মানুষের নাম যুক্ত হয়েছে।


ইরাক: ফাইলি কুর্দি নামের জনগোষ্ঠী এবং বিদুনসহ ৪৭ হাজার ৫০০ এর মতো রাষ্ট্রহীন মানুষ রয়েছেন ইরাকে। মূলত ইরান-ইরাক সীমান্তের দুই পাশে বসবাস করে আসছে নৃতাত্ত্বিক ফাইলি কুর্দি নামের এই জনগোষ্ঠী। বাথ শাসনামলে ১৯৮০ সালে ১ লাখেরও বেশি ফাইলি কুর্দির জাতীয়তা কেড়ে নেয়া হয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে তাদের অনেকে নাগরিকত্ব ফিরে পেয়েছিলেন। বাকিরা এখনো রাষ্ট্রহীন অবস্থায় আছে।

নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত রোমা জনগোষ্ঠী


ইউরোপ: ভারতীয় বংশোদ্ভূত নৃজনগোষ্ঠী রোমা সম্প্রদায়ের প্রায় দশ হাজার মানুষ রাষ্ট্র পরিচয়হীনভাবে মধ্য, পূর্ব ও দক্ষিণ ইউরোপে বসবাস করছেন। কসোভো ও বসনিয়ায় বসবাসরত রোমা জনগোষ্ঠীর অনেকে যুদ্ধের সময় বাস্তুচ্যূত হয়েছেন। এখনো রোমারা তাদের সন্তানদের জন্মনিবন্ধন করাতে পারেন না এবং সরকারিভাবে সম্পত্তির মালিকানা দাবি করতে পারেন না। কারণ তারা কোথা থেকে এসেছে, তাদের পক্ষে এই বিষয়টি প্রমাণ করা কষ্টসাধ্য।


ভেনেজুয়েলা: রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক মন্দার কবল থেকে রক্ষা পেতে পালিয়ে যাওয়া অনেক ভেনেজুয়েলানদের সন্তান রাষ্ট্রহীন পরিচয়ের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

সূত্র: ইনকোয়ারার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here