আমিনুল হক তুষার
নিরাপদ ও দক্ষ শ্রম অভিবাসনের নিশ্চয়তায় প্রাক-বহির্গমন প্রশিক্ষণ
দক্ষ কর্মী হিসেবে বিদেশ গমনে আমাদের দেশের সরকারি নিয়ম অনুসারে প্রাক-বহির্গমন প্রশিক্ষণ (বা প্রি-ডিপার্চার ট্রেনিং বা ওরিয়েন্টেশন) গ্রহণ অত্যাবশ্যকীয়। গৃহকর্মী হিসেবে নারী শ্রমিকদের ৩০ দিনের হাউসকিপিং ও অন্যান্য পেশার পুরুষ ও নারীদের তিন দিনের প্রাক-বহির্গমন প্রশিক্ষণের আয়োজন করে থাকে সরকার। যদিও তার পূর্বে বিভিন্ন ট্রেডে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণেরও সুযোগ রয়েছে বিদেশ গমনেচ্ছুদের। কিন্তু জনশক্তি ছাড়পত্র বা ম্যানপাওয়ার ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার জন্য উক্ত প্রাক-বহির্গমন প্রশিক্ষণের সনদ প্রাপ্তি অত্যাবশ্যকীয়।
মূলত: প্রাক বহির্গমন প্রশিক্ষণ আয়োজন করে থাকে বিএমইটির অধীনস্ত কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি), জেলা জনশক্তি অফিস (ডেমো) বা ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। যা দেশব্যাপী ৪২টি ডেমো এবং ৬৪টি টিটিসির মাধ্যমে প্রদান করা হয়। গন্তব্য দেশের রীতিনীতি, ভাষা, আইন-কানুন, করণীয় ও বর্জনীয়, নিজ-নিরাপত্তা ও কল্যাণ ইত্যাদি বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা দেওয়াই প্রাক-বহির্গমন প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য।
পরিস্থিতির চিত্র
এই প্রশিক্ষণে যদিও বিদেশগমনেচ্ছুক কর্মীদের নিরাপদ অভিবাসনের প্রক্রিয়া ও উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হয় এবং সম্ভাব্য অভিবাসন ঝুঁকি এড়ানোর জন্য দিক নির্দেশনা দেয়া হয়, কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে তা খুব একটা ফলপ্রসূ হয় না। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, এই সকল কর্মীরা এই প্রশিক্ষণে নিবন্ধন বা অংশগ্রহণের পূর্বেই তাদের অভিবাসনের সকল প্রস্তুতি (যেমন: ভিসা ক্রয়, চাকুরির চুক্তিপত্র ইত্যাদি) সম্পন্ন করে ফেলেছেন। অনেক সময় দেখা যায় কর্মীরা এই প্রশিক্ষণ গ্রহণে খুব একটা আগ্রহী ও মনোযোগী থাকেন না।
যার কারণ হতে পারে:
- এক সঙ্গে অনেক কর্মীকে (৭০-১৫০ জন বা ক্ষেত্র বিশেষে তারও অধিক) প্রশিক্ষণ প্রদান।
- সম-অংশগ্রহণের বা মতপ্রকাশের সীমাবদ্ধতা।
- দেশভিত্তিক ও যুগোপযোগী পাঠক্রমের বা পাঠ-উপকরণের অভাব।
- সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পরে নতুন ধারণা গ্রহণের মানসিকতার অভাব ইত্যাদি।
নারী অভিবাসী কর্মীদের ৩০ দিনের হাউসকিপিং প্রশিক্ষণে রয়েছে আরও সীমাবদ্ধতা। বেশিরভাগ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রেই নেই আবাসিক ব্যবস্থার পর্যাপ্ত সুযোগ। এছাড়াও তাদের ভাষা শিক্ষার ও নিরাপদ অভিবাসনে করণীয় সম্পর্কে শিক্ষা প্রদানে দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রশিক্ষকের অভাবও পরিলক্ষিত হয়। যার কারণে নারী কর্মীরা সঠিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্তিতে বঞ্চিত হয়। এছাড়া দেখা যায়, গৃহকর্মী হিসেবে গমনেচ্ছুক নারী কর্মীরা যাও নিরাপদ অভিবাসন সম্পর্কে ৩০ দিনে ধারণা অর্জন করতে পারেন কিন্তু গার্মেন্টস বা অন্য পেশার বিদেশ গমনেচ্ছুক নারী কর্মীরা সেটুকুও পান না। বরঞ্চ তাদের নির্ভর করতে হয় কেবল তিন দিনের ওরিয়েন্টেশনের উপর।
পরিসংখ্যান কি বলছে
নিয়মানুসারে সকল বিদেশগামী অভিবাসী শ্রমিকের জন্য প্রাক-বহির্গমন প্রশিক্ষণ গ্রহণ বাধ্যতামূলক। তবে সরকারি তথ্য-উপাত্ত অনুসারে দেখা যাচ্ছে সকল কর্মী কিন্তু প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন না। যদিও সরকারের পাশাপাশি তৃণমূল পর্যায়ে বিভিন্ন এনজিও সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক বা অভিবাসনের প্রাক-সিদ্ধান্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। তারপরেও দেখা যায়, প্রতি বছর বহু শ্রমিক পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ছাড়াই বিদেশ চলে যাচ্ছেন। যেমন, ২০১৯ সালে মোট ৭,০০,১৫৯ জন বহির্গমন ছাড়পত্র নিয়ে বিদেশে গিয়েছেন, যার মধ্যে ৫,২৬,৮৯৭ জন বিএমইটির ৩ দিনের প্রাক-বহির্গমন প্রশিক্ষণ পেয়েছেন, আর ৫৫,৫২৬ জন কল্যাণ বোর্ডের এক দিনের ব্রিফিং পেয়েছেন। ফলে দেখা যাচ্ছে, সরকারি উপাত্ত অনুসারে ১,১৭,৭৩৬ জন অভিবাসী শ্রমিক প্রাক-বহির্গমন প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার আওতার বাইরে ছিলেন (সূত্র: বিএমইটি ও ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৮-১৯)।
একইভাবে এই অসামঞ্জস্যতা পাওয়া যায় ২০১৬-২০১৮ পর্যন্ত আয়োজিত প্রাক-বহির্গমন প্রশিক্ষণের উপাত্ত ও পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে। সরকারি হিসাব অনুসারে ২০১৬, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে বিদেশে গমন করেছেন যথাক্রমে ৭,৫৭,৭৩১ জন, ১০,০৮,৫২৫ জন ও ৭,৩৪,১৮১ জন। যাদের মধ্যে (বিএমইটি ও ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আয়োজিত) প্রাক-বহির্গমন প্রশিক্ষণ বা ওরিয়েন্টেশন পেয়েছেন যথাক্রমে: ১,০২,০২৩ জন, ৭,৬৯,৩৫০ জন এবং ৬,২২,৩০৪ জন। ফলে দেখা যাচ্ছে যে, ২০১৬, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে যথাক্রমে ৬,৫৫,৭০৮ জন, ২,৩৯,১৭৫ জন ও ১,১১,৮৭৭ জন এই প্রশিক্ষণের আওতাধীন ছিলেন না বা তাদের সংখ্যা সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি।
আমরা জানি যে, অধিকাংশ নারী শ্রমিক বাংলাদেশ হতে বিদেশে যায় গৃহকর্মী হিসেবে। খুব কম সংখ্যক নারী কর্মী অন্যান্য পেশায় (যেমন: গার্মেন্টস শ্রমিক বা নার্স বা টেকনিশিয়ান) বিদেশে গিয়ে থাকেন। যেমন ১৯৯১ হতে ২০২০ সালের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, প্রায় ৩৮ শতাংশ নারী কর্মী সৌদিআরবে, ১৪ শতাংশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে, ১৭ শতাংশ জর্ডানে ও ১১ শতাংশ লেবাননে অভিবাসন করেছেন, যার প্রায় ৯০ শতাংশই গৃহকর্মী। ফলে এটা বলা যায় যে, হাউসকিপিং বা কেয়ারগিভার প্রশিক্ষণ এই সকল নারী কর্মীদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু সরকারি পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা। ২০১৭ ও ২০১৮ সালের বিএমইটির ডাটা অনুসারে বিদেশে গিয়েছেন যথাক্রমে ১,২১,৯২৫ জন ও ১,০১,৬৯৫ জন, যার ভিতর টিটিসি হতে হাউসকিপিং প্রশিক্ষণ পেয়েছেন যথাক্রমে ৬২,৬৮৪ জন ও ৪৪,৩৫২ জন (সূত্র: বিএমইটি বার্ষিক প্রতিবেদন, ২০১৭ ও ২০১৮)। তাহলে হিসাব অনুযায়ী ২০১৭ সালে ৫৯,২৪১ জন ও ২০১৮ সালে ৫৭,৩৪৩ জন অন্যান্য প্রশিক্ষণ পেয়েছেন, যা মোট নারী কর্মী ও গৃহকর্মী প্রেরণের উপাত্তের সঙ্গে অসামঞ্জস্য।
অনেক সময় দেখা যায়, এই অসাধু চক্রটি এক ধরণের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে অন্য ধরণের পেশায় কর্মী প্রেরণ করে থাকে । ফলস্বরূপ অনেক কর্মী প্রতারণার বা ক্ষেত্রবিশেষে পাচারের শিকার হন । আবার কার্যকর প্রশিক্ষণ আয়োজন ব্যর্থ হলে বা পাঠক্রম মানসম্মত বা যুগোপযুগী না হলে কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়ন ও নিরাপদ অভিবাসন কার্যকর করা সম্ভব হবে না ।
দক্ষ জনশক্তি গঠন ও প্রেরণে বর্তমান সরকার যদিও সচেষ্ট। সরকারের পক্ষ থেকে বহুমুখী পদক্ষেপ ও কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে । সরকার প্রতি উপজেলা থেকে এক হাজার দক্ষ কর্মীর বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য কাজ করছে, যা অবশ্যই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতকরণে কার্যকর, মানসম্পন্ন ও যুগোপযোগী প্রাক-বহির্গমন প্রশিক্ষণ ও প্রাক-সিদ্ধান্ত প্রশিক্ষণের আয়োজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের তথ্য-উপাত্ত বা পরিসংখ্যান সংরক্ষণ ও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
সঠিক পরিসংখ্যান বা ডাটা একদিকে যেমন অভিবাসনের সার্বিক পরিস্থিতির ধারণা দেয়, তেমনি তা অভিবাসনের নিয়ন্ত্রণ ও মূল্যায়নের জন্য কার্যকরী। তাই আমাদের উচিত বিদেশগমনেচ্ছুক কর্মীদের সকল ধরণের প্রশিক্ষণের পদ্ধতি, পাঠক্রম ও পাঠ উপকরণের মান বজায় রাখা ও ডিজিটাল পদ্ধতিতে তথ্য- উপাত্ত সংরক্ষণ করা। তবেই আমরা দক্ষ জনশক্তি প্রেরণে লাভবান হব এবং শ্রমিক পাচার বা শোষণ হতে নিরাপদে রাখতে পারবো আমাদের রেমিটেন্স যোদ্ধাদের।
লেখক: শ্রম অভিবাসন বিশ্লেষক ও উন্নয়নকর্মী