ভারতেও কেন বাংলাদেশী অভিবাসীদের গন্তব্য?

0
878

ভারতীয় সংবাদ সংস্থা ডেইলি এক্সেলসিয়র গত জুলাইয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে অভিবাসন প্রসঙ্গে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। পাঠকদের উদ্দেশ্য নিবন্ধটি বাংলায় ভাষান্তর করা হলো। ভাষান্তর করেছেন তুষার ফারুক


মে, ২০২০। গড় মাথাপিছু আয় নিয়ে বাংলাদেশের একটি খবরের শিরোনাম চমকে দেয় ভারতকে। যেখানে বলা হয়, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের জনগণের গড় মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার দুইশত ২৭ ডলার। বিপরীতে একই সময়ে ভারতীয়দের গড় মাথাপিছু আয় ছিল প্রায় ১ হাজার নয়শত ৪৭ ডলার। এই তথ্য ভারতে অবৈধ অভিবাসনের অভিযোগকে খণ্ডন করতে আরো একটি যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করেছিল একটি পক্ষ।


এই ‘উন্নয়ন’ এমন এক সময়ে হয়েছিল যখন কিনা ভারত জাতীয় নাগরিক নিবন্ধক (এনআরসি) এবং নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) বাস্তবায়ন শুরু করার পর দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ইতোমধ্যে অশান্ত হয়ে উঠেছিল। তবে ভারত ও অন্যান্য কয়েকটি দেশে সম্প্রতি কিছু অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী গ্রেফতার হওয়ায় বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে সামনে এসেছে আবার।


৩ জুলাই ২০২১। অন্ধ্র প্রদেশে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আটজন অবৈধ অভিবাসীকে গ্রেফতার করা হয়। এই অভিবাসীরা গোয়ায় কাজের সন্ধানে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিল। এসব অভিবাসীদের ভোটার পরিচয়পত্র, আধার কার্ড ও প্যান কার্ড নকল ছিল। তাদের কারোরই পাসপোর্ট ছিল না। সুতরাং পরিস্কার যে, অবৈধপথেই তারা সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদেও উন্মেচিত হয়, বাংলাদেশের বাগেরহাট ও অন্যান্য জেলা থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অভিবাসী অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেছে। যারা কলকাতা, নয়াদিল্লি, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, হায়াদ্রাবাদ, গোয়া ও অন্যান্য শহরে বসবাস করছে। তখন থেকেই তারা নির্মাণ প্রকল্পে মজুর হিসেবে কাজ করছে। মূলত এটা দায়ী করা যায় যে, অবৈধ অভিবাসনের এই তীব্রতা ভারতের কোভিড নীতিমালা শিথিল করার কারণেও ঘটেছে।


ভুমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে অবৈধভাবে বাংলাদেশীদের অনুপ্রবেশের ঘটনার সঙ্গে নাটকীয়ভাবে এসব খবরের সাদৃশ্য দেখা যাচ্ছে। অপ্রত্যাশিতভাবে হলেও সত্য যে, এসব অভিবাসীর অনেকে ভুমধ্যসাগরে ডুবে মারা যাচ্ছে, যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যককে আবার উদ্ধারও করা হচ্ছে।


৪ জুন, ২০২০। কমপক্ষে ২৬৪ জন বাংলাদেশীকে ভুমধ্যসাগরের তিউনেশিয়ার উপকূলীয় অঞ্চল থেকে উদ্ধার করা হয়। এরা সবাই সাগরপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেছিল।
তিউনেশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের কনস্যুলেট এর তথ্যমতে, সর্বশেষ ৯০ দিনে তিউনেশিয়ার উপকুল থেকে ইউরোপগামী কমপক্ষে ৪৮৫ জন বাংলাদেশী অভিবাসীকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশীদের তিউনেশিয়া ও লিবিয়ায় কনস্যুলটে সেবা দেয়া হয়েছে।


কোভিড মহামারি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কঠিন আঘাত হেনেছে। যদিও শুরুর দিকে দাবি করা হয়েছিল যে, মহামারির খারাপ প্রভাব স্বত্বেও বাংলাদেশ অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে। এখন অর্থনীতিতে মহামারির প্রকৃত প্রভাব এমনভাবে পড়েছে যে, জীবিকার সন্ধানে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যাওয়ার জন্য মরিয়া মানুষদের বিদেশের যাওয়ার চেষ্টা দেখে এ গল্পের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাচ্ছে।


জুন, ২০২০। এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কর্তৃক তৈরী করা এক প্রতিবেদনে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল যে, চাকরির সৃজনে সরকার সম্মিলিত প্রচেষ্টা না নিলে ছয় মাসে বাংলাদেশের যুব বেকারত্বের হার দ্বিগুণের বেশি হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের এক গবেষণায় বলা হচ্ছে, ২০২০ সালের মার্চে শুরু হওয়া কোভিড প্রাদুর্ভাবের প্রথম তিন মাসে প্রায় ১৩ শতাংশ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছিলেন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রমিক কেবল পোশাক খাতে চাকরি হারিয়েছিলেন। অথচ এই শিল্পটিই সবচেয়ে সমৃদ্ধ শিল্প বাংলাদেশে এবং যা শ্রমনির্ভর। এই সময়কালে নতুন শ্রমশক্তিও হ্রাস পেয়েছে। নিজ দেশে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাবে এই শ্রমিকরা এখন অন্য কোথাও সুযোগের সন্ধান করছেন।


উপসাগরীয় দেশ এবং দক্ষিণ পূর্ব এশীয় দেশগুলিতে শ্রম রফতানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সুনাম রয়েছে। এই দেশগুলির অর্থনীতিতে করোনা আঘাত হানার কারণেও বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসী কর্মীরা বেকায়দায় পড়েছে। যদিও ইন্টারনেটের বিস্তৃতি বাংলাদেশকে প্রায় ২ লক্ষ মানুষকে প্রত্যক্ষ্যভাবে কাজের সন্ধান দিতে সহায়তা করেছে। অবশ্য সংখ্যাটি পর্যাপ্ত নয়। সাধারণত বাংলাদেশ বিদেশে প্রবাসী শ্রমিক হিসাবে সাত থেকে ৮ লাখ লোক পাঠায়।


এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, মহামারির আগে দশকের পর দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে এগিয়ে চলেছে এবং দেশটি স্বল্পোন্নত দেশগুলি (এলডিসি) থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তারপরও এই এগিয়ে চলা অসম। এই উন্নয়ন কেবলমাত্র বাংলাদেশের কয়েকটি অঞ্চলে সীমাবদ্ধ রয়েছে। তদুপরি, দারুণ অর্থনৈতিক বৈষম্য রয়েছে, যার ফলে বেশিরভাগ মানুষ এখনও দরিদ্র হয়ে পড়েছে।


সবচেয়ে খারাপ বিষয়, মহামারিটি একটি ধাক্কা দিয়েছে এবং দারিদ্র্যসীমার উর্ধ্বে উঠে আসা বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী আবার পিছিয়ে গেছে। এটাও সত্য যে, বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি সামাজিক সূচকে ভাল কাজ করেছে। তবে তা মূলত বাংলাদেশে সক্রিয় সংখ্যক বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার প্রচেষ্টার কারণে ঘটেছে। অর্থনৈতিক সুযোগের অভাবে সামাজিক সূচকগুলিতে উন্নতি স্থানীয় লোকদের স্থানান্তর করা থেকে বিরত রাখতে পারে না। আসলে যখন আইনি উপায় পাওয়া যায় না তখন লোকেরা অবৈধ উপায়ে আশ্রয় নেয়।


ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর তথ্য অনুসারে, বিএসএফ এর হাতে ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের দায়ে ৩ হাজার ২০৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তাদের মধ্যে ৬০০ জনকে, যাদের পূর্ণ পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল, তাদের বাংলাদেশের হাতে হস্তান্তর করা হয়েছিল।


স্পষ্টতই, বিএসএফ কর্তৃক গ্রেপ্তারকৃতদের সংখ্যা হল আইসবার্গের একটি ভাসমান ক্ষুদ্র কণা। বেশিরভাগ অবৈধ অভিবাসী ভারতের বিভিন্ন শহরে গা ঢাকা দেয়। মূলত প্রতিবেশী দেশ হওয়ার কারণে অবৈধ অভিবাসনের এই প্রবণতার বিশাল প্রভাব ভারতকে নিতে হয়।


দুর্ভাগ্যক্রমে, বিষয়টি এত জটিল যে এ সঙ্কটের কোনও সহজ সমাধানকে অস্বীকার করা হয়। ইস্যুটির রাজনৈতিকীকরণ, কেবলই বিষয়টিকে আরও খারাপ দিকেই ধাবিত করছে। তদুপরি, দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের যে কয়েকটি দেশের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।


মার্চ ২০২১। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে এলেও ভারতে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসন বিষয়ে প্রশ্ন তুলে জটিলতা বাড়িয়ে তুলতে দেননি। প্রসঙ্গটি না তোলার সম্ভবত আরও কিছু কারণ ছিল। উদাহরণস্বরূপ, প্রধানমন্ত্রী মোদির মার্চ সফরের উদ্দেশ্যগত কারণেও কিছুটা ভিন্নতা ছিল। তার আগমণের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের পঞ্চাশতম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগদান করা। এটি ছিল ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পঞ্চাশতম বছর। একইসময় আবার, বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীও পালন করছিল।


সর্বোপরি বাংলাদেশের সংবেদনশীলতাকে সম্মান জানিয়ে ভারত ওই সফরের সময় অবৈধ অভিবাসনের প্রসঙ্গটি সামনে আনেনি। তবে এখন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষতি না করে বিষয়টিকে সুসংগতভাবে সমাধানের চেষ্টা করা উচিত ভারত-বাংলাদেশকে।



LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here