‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’ এই প্রচলিত কথাটির যেন যথার্থতা প্রমাণ করেছেন কঙ্গোর এক নারী শরণার্থী। তবে তিনি ধান ভানা নয়, শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করে রীতিমতো ধান চাষ করে সাড়া ফেলেছেন। চার বছর আগে মাতৃভূমি কঙ্গো থেকে অ্যাঙ্গোলায় পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন ৫৫ বছর বয়সী অ্যানটোইনেট।
অ্যানটোইনেট বলছিলেন ‘ভাত আমাদের প্রধান খাবার। ম্যানিয়েমায় আমাদের বাড়িতে আমরা এটা খেতাম’। অ্যাঙ্গোলায় আসার পর আমি ভাত খুব মিস করি। আর এ কারণেই ধান চাষের পরিকল্পনা মাথায় আসে।’
অ্যাঙ্গোলার লুন্ডা নর্টে প্রদেশের লোভুয়া থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের একটি গ্রাম চামাসুইয়া। এখান থেকে কাঁদামাটির পথ ধরে পাঁয়ে হেটে একটি ধান ক্ষেতে যেতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। পাহাড়ের গোঁড়ায় অবস্থিত গ্রাম এবং স্থানীয় একটি নদীর মধ্যবর্তী জায়গায় প্রায় ১০ হেক্টর জমি নিয়ে দৃষ্টিনন্দন এ ধান ক্ষেত তৈরি করা হয়েছে।
অ্যাঙ্গোলায় প্রায় ৫৫ হাজার শরণার্থী আছেন, যাদের বেশিরভাগই কঙ্গো থেকে পালিয়ে আসা। অ্যানটোইনেট এর মতো ৬ হাজার ৭০০ কঙ্গোর শরণার্থী লোভুয়া শিবিরে বসবাস করছেন। এখানে তার একটি বড় প্লট আছে, যেখানে তিনি তার পরিবারের ১৬ সদস্যের জন্য চারটি বাসা তৈরি করেছেন।
অ্যানটোইনেট এর আরেকটি পরিচয় আছে; তিনি মামা আন্থো নামে পরিচিত। শরণার্থী এই নারী তার মতো ৩০ জন নারী নিয়ে একটি কৃষি বিষয়ক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন। যারা খামারের মধ্যে ও শিবিরের বাইরে কাজ করেন। প্রতিবার চাষে তারা ৫০০ থেকে ৬০০ কেজি পর্যন্ত ধান উৎপাদন করেন, যা কিনা তাদের প্রদেশের অন্য সবার চেয়ে বৃহৎ উৎপাদকের স্বীকৃতি দিয়েছে।
শুধু ধান নয়, শিবিরে তাদের স্ব স্ব ঘরের সামনে নিজস্ব বাগানে আলু, টমেটো, বেগুন, গাজর, পেঁয়াজ, কাসাভা, লেটুসসহ আরো নানা ধরনের শাকসব্জির চাষ করছেন তারা। যদিও শুরুতে ধান চাষের জন্য মোটেও উপযুক্ত ছিল না জায়গাটি। অ্যানটোইনেট এখানে আসার পর একটি পরিকল্পনা করেছিলেন এবং স্থানীয় কিছু গোষ্ঠীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে তিনি আলোচনা করেন।
‘২০১৭ সাল থেকে আমরা এখানে আছি এবং তখন থেকেই এখানকার স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে ভালো একটি সম্পর্ক তৈরি করেছি’-বলছিলেন অ্যানটোইনেট। ‘নদী তীরবর্তী ভূমি ব্যবহারের জন্য সমর্থন আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছিলাম আমরা, যেখানে ধান চাষের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছিলাম। পুরো প্রদেশজুড়ে, মানুষ আমাকে ফোন করতে থাকে, কারণ তারা আমাদের ধান কিনতে চায়।’
গ্রামে শরণার্থী ও স্থানীয় অ্যাঙ্গোলানদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য এই ধানের খামার তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তারা সবাই শরণার্থীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে, ক্ষেতের পরিচর্যা করে। এর ফলে তারা ধান চাষ সম্পর্কে হাতে কলমে শিখতে পেরেছে, যে অঞ্চলটি মূলত কাসাভা চাষের জন্য বেশি পরিচিত। ‘আমরাও লাভবান হচ্ছি এবং আমাদের জনসাধারণ তাদের কাছ থেকে শিখতে পারছে’- নিজের গ্রামে ধান চাষ সম্পর্কে বলেন চামাসুইয়ার স্থানীয় নেতা সোবা ফাউসতিনো।
তিনি আরো জানান, তার এলাকার অনেকেই ধানের ক্ষেতে কাজের সুযোগ পাচ্ছে এবং এখান থেকে প্রাপ্ত পারিশ্রমিক দিয়ে তারা সচ্ছলভাবে সংসার চালিয়ে নিতে পারছেন। বিকল্প একটি মাধ্যমে বাড়তি এই রোজগারের কারণে জ্বালানি ও কয়লা বানানোর জন্য বৃক্ষনিধনের প্রয়োজনীয়তা কমে গেছে তাদের। এর ফলে পরিবেশের ভারসম্য রক্ষা পাচ্ছে।
মামা আন্থো বিশ্বাস করেন যে, এভাবে নিজেদের খাদ্যের সংস্থান নিজেরা করতে পারলে দাতা সংস্থাগুলোর উপরও খাদ্য সংস্থানের চাপ কমবে। ‘আমাদের বাড়তি খাদ্য সংস্থান করতে হবে কারণ আমাদের চাহিদার চেয়ে যোগান কম। আমাদের প্রয়োজন বিক্রির জন্য উৎপাদন বাড়ানো, যাতে করে আমরা আমাদের ব্যবসা চালিয়ে নিতে পারি এবং পরিবারকে সহযোগিতা করতে পারি।’
ইউএনএইচসিআর প্রতিনিয়ত এইসব শরণার্থী কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা বীজের সংস্থান করছে, কৃষি বিষয়ক উপকরণ, সার এমনকি খামারের জন্য মুরগি সরবরাহ করছে। এই আশ্রয় শিবিরের পার্শ্ববর্তী তিনটি স্থানীয় সম্প্রদায়ের প্রায় ৬০ জন কৃষককে নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।
ইউএনএইচসিআর এর অ্যাসোসিয়েট লাইভলিহুড অফিসার রবার্ট আহেবওয়া অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন- ‘শরণার্থীদের কৃষিজ্ঞান ও অভিজ্ঞতা এখানকার স্থানীয় মানুষদের উৎপাদন ক্ষমতাকে আরো বেশি বাড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখবে।’
সূত্র: ইউএনএইচসিআর