কখনও উত্তাল সমুদ্র, কখনও তপ্ত মরুভূমি, আবার কখনওবা ভয়ংকর জঙ্গল পাড়ি দিয়ে অভিবাসন প্রত্যাশীরা নিরন্তর ছুটে চলেছে। যুদ্ধ, সন্ত্রাস কিংবা ক্ষুধার তাড়নায়, বেঁচে থাকা কিংবা একটু ভালো থাকার প্রত্যাশায় তাদের এই ছুটে চলা। গন্তব্যে পৌঁছতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মৃত্যুপুরীর নানা ধাপ পার হতে হয় তাদের। সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্রপথে ঘটে যাওয়া এসব অঘটনের খবর সংবাদমাধ্যমগুলোতে উঠে আসছে বারবার।
তবে জলপথের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্থলপথেও থেমে নেই অভিবাসীদের এমন ভয়ংকর যাত্রার মর্মান্তিক পরিণতি। ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যে ট্রাকের ভেতর থেকে ৩৯ জন ভিয়েতনামী অভিবাসীর মৃতদেহ পাওয়া যায়, যারা শ্বাসকষ্ট ও হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল। প্রতিবছরই এই সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
সংবাদমাধ্যম নিউজউইক এর করা গতকালের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, চলতি বছর ট্রাকের ভেতর লুকিয়ে ফ্রান্স থেকে ১১ হাজারের বেশি অভিবাসন প্রত্যাশী যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করেছে।
মূলত প্রতি সপ্তাহে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সে পণ্যবাহী বাণিজ্যিক ট্রাকগুলি আসা যাওয়া করে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ট্রাকের ভেতর লুকিয়ে অভিবাসন প্রত্যাশীরা ফ্রান্স থেকে যুক্তরাজ্যে চলে আসার চেষ্টা করেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।
ট্রাক চালকদের ভাষ্যমতে, তারা ট্রাকের ভেতর সবসময় চেক করেন যে, কেউ ভেতরে আছেন কিনা। অন্যদিকে টহলরত পুলিশও বলছে, তারাও নিয়মিত পরিদর্শন করেন। কিন্তু তাদের এতসব নজরদারির পরও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অভিবাসন প্রত্যাশী ট্রাকে উঠে পড়েন।
এর কারণ হিসেবে পুলিশ ও ট্রাক চালকদের বক্তব্য, অভিবাসন প্রত্যাশীরা ট্রাকের রুটের দিকে সবসময় গভীরভাবে নজর রাখে এবং সুযোগ পেলেই ট্রাকে উঠে লুকিয়ে পড়েন। একবার ব্যর্থ হলে পুনরায় তারা চেষ্টা চালিয়ে যান।
এভাবে একাধিকবার চেষ্টা করে চোখের আড়ালে অনেকেই ট্রাকে উঠতে সক্ষম হন। তবে তারা সঠিক গন্তব্যের দিকে এগোলেই যে নিরাপদে পৌঁছে যাবেন, বিষয়টি মোটেও এমন নয়, বরং সামনে থাকা টহলরত পুলিশ যেকোনো সময় ট্রাক তল্লাশি চালিয়ে তাদেরকে নামিয়ে দিতে বাধ্য করতে পারে।
রিফিউজি অ্যাডভোকেসি গ্রুপ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের প্রতিবেদনে বলছে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ট্রাকের মধ্যে থাকা অভিবাসন প্রত্যাশীরা তাদের কাছে সাহায্যের আর্জি জানিয়েছেন। অভিবাসন প্রত্যাশীরা বলেছেন, এর মধ্যে অবস্থানের সময় তাদের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় এবং হাইপোথার্মিয়ার কারণে মৃত্যুর কবলে পড়ার উপক্রম হয়। কেউ আবার বলছেন, পুলিশের হাতে আটকের পর তারা নিপীড়নের শিকার হন।
দ্রুত গতিতে ছুটে আসা ট্রাকে লাফিয়ে উঠতে গিয়ে অনেকে মারাত্মকভাবে আহত হয়, অনেকে আবার মারা যায়। গত মাসে ইয়াসের আবদাল্লাহ নামের বিশ বছর বয়সী এক যুবক ট্র্যাকের চাপায় মারা গেছেন। আবদাল্লাহ সুদান থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল যুক্তরাজ্যে ট্যাক্সি ড্রাইভার হওয়ার।
আরো পড়ুন
আবদাল্লার মৃত্যুর পর ক্যালাইস শহরে অবস্থানরত প্রায় তিনশো অভিবাসী তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পদযাত্রায় অংশ নিয়েছিল। ট্রাক চালকদের কাছে লিখিত এক বক্তব্যে তারা প্রশ্ন করেছিল, ‘যখন আপনি টের পান ট্রাকের মধ্যে কোনো রিফিউজি আছে, আপনি তখন ট্রাকটি ঝাকি দেন এবং বারবার গতিরোধ করেন, যতক্ষণ না আমরা সেখান থেকে না নেমে যাই। কেনো আমরা আমাদের যাত্রা চলমান রাখতে পারি না?’
লুকিয়ে থাকা অভিবাসন প্রত্যাশীরা রাতের বেলায় ক্যালাইস শহরের পার্শ্ববর্তী বনে ঘুমানোর চেষ্টা করেন। ভাগ্য ভালো থাকলে তাদের কপালে তাবু জুঁটতে পারে, অন্যথায় সাধারণত বেশিরভাগ সময়ই গাছের তলায় রাত কাটাতে হয় তাদের।
প্রতিদিন সকাল হলেই ক্যাম্পের আশপাশে তল্লাশী চালায় পুলিশ। পুলিশ তাদের আটক করে, টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে, সঙ্গী থেকেও তাদের বিচ্ছিন্ন করে দেয় বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের পর্যবেক্ষণে তুলে ধরেছে।
মূলত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি কিংবা পারিবারিক বন্ধনের কারণে অনেক মানুষ যুক্তরাজ্যে যান। ফরাসি কর্তৃপক্ষ বলছে, বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়াই অবস্থানের জন্য যুক্তরাজ্যে বিধিনিষেধের শিথিলতা রয়েছে।
এদিকে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে অভিবাসন প্রত্যাশীদের যুক্তরাজ্যে প্রবেশ ঠেকাতে পুলিশ উন্নত প্রযুক্তি ও স্ক্যানার ব্যবহার করে নজরদারি বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু তা স্বত্বেও অভিবাসীদের ঢল সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ গত তিনদিনে আটশোর বেশি অভিবাসন প্রত্যাশী ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে যুক্তরাজ্যে ঢোকার চেষ্টা করেছে। এছাড়া গত রোববার ও সোমবার এই দুইদিনে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করার সময় ছোটো নৌকা থেকে ২১৩ জন অভিবাসীকে উদ্ধার করেছে ফরাসি কর্তৃপক্ষ। যাদের বেশিরভাগই ফ্রান্স থেকে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল।
সূত্র: নিউজউইক, বিবিসি ও দ্য নেশনস