অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার রঙ্গিন স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমানোর সংখ্যা যেমন দীর্ঘায়িত হচ্ছে, তেমনি দীর্ঘায়িত হচ্ছে স্বপ্নভঙ্গের সংখাটিও। এই বেদনাদায়ক চিত্রনাট্যের সঙ্গে করোনা মহামারির আঘাতও যেন দানবের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছে ।
গবেষণায় উঠে এসেছে, গড়ে ১০০ জন বিদেশগামীদের মধ্যে ৩৪ জন ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসেন। এদের বেশিরভাগই স্বল্প শিক্ষিত ও অদক্ষ। দরিদ্র পরিবারের এসব মানুষেরা যখন নিঃস্ব হয়ে ফেরত আসেন, তখন তারা পূণরায় অধিকতর দরিদ্রতার কবলে পড়েন। অনেকটা অর্থনীতিবিদ রাগনার নার্কস প্রদত্ত ‘দারিদ্র্যের দুষ্টুচক্র’ তত্ত্বের মতো।
কেননা নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের এসব নারী পুরুষরা তাদের ভিটেমাটি বা জমি-জমার মতো শেষ সম্বল টুকু বিক্রি করে বিদেশে পাড়ি জমান। যার ফলে দেশে ফেরত এসে অধিকাংশেরই আয়ের আর কোন উৎস থাকে না। পরবর্তীতে তাদের ঘুরে দাঁড়ানো বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়।
মূলত সুযোগ ও উদ্যোগের অভাবকে ব্যক্তির দরিদ্র হবার প্রধান কারন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সহায়ক পরিবেশের অভাবে অনেকে দরিদ্রতার এই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না।
সরকার এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর উদ্যোগে পরিচালিত বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বিদেশ ফেরতদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনের সুযোগ রয়েছে। তবে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যেন লক্ষিত জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া ব্যক্তিকে সবার আগে সহযোগিতা প্রদান নিশ্চিত করা হয়।
এক্ষেত্রে, সঠিক উপকারভোগী নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া প্রকল্পের কার্যক্রমে গুণগত মান নিশ্চিতেও বিশেষ নজর রাখতে হবে।
দরিদ্র ব্যক্তি ও তার পরিবারকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করার প্রক্রিয়া বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ। শুধু এককালীন কোন অনুদান বা উৎপাদনশীল সম্পদ হস্তান্তরই, কাউকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার জন্য যথেষ্ট নয়।
প্রয়োজন সঠিক আর্থিক কর্মপরিকল্পনা। সেই সঙ্গে অন্তত বছরখানেক ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখা। এর মাধ্যমে কোন ব্যক্তিকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সিঁড়িতে নিয়ে আসা সম্ভব হতে পারে।
পিছিয়ে পড়া বা সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের অগ্রযাত্রায় তাদেরকে দীর্ঘ সময় ফলোআপে রাখতে হয়। শুধুমাত্র এককালীন অনুদান বা সম্পদ দিয়ে সরে আসলে ব্যাপারটা এমন হবে যেন, একটি শিশুকে বাইসাইকেল চালানো শেখাতে গিয়ে সাইকেলে বসিয়ে একা রেখে চলে আসলেন। শিশুটি সাইকেল চালাতে পারবে না বরং রাস্তায় পড়ে যেতে পারে। কিন্তু আপনি যদি কিছুক্ষণ শিশুটিকে সাহস দিতেন, সহযোগিতা করতেন, সে ধীরে ধীরে চালানো শিখে যেত। এরপর একসময় আপনি চলে আসলেও সে নিজে নিজে সাইকেল চালাতে পারবে।
দারিদ্র্য বিমোচনে এবং আত্নকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রত্যেক উপকারভোগীর জন্য ছকে বাঁধা একরকম অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করলে উদ্দেশ্য ফলপ্রসূ হয় না। ব্যক্তি বিশেষের দক্ষতা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, আগ্রহ এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে হবে।
সদস্যকে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ করে দিতে হবে, তবে তাকে পর্যাপ্ত বিশ্লেষণি তথ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করতে হবে। প্রত্যেকের জন্য গৃহীত উন্নয়ন পরিকল্পনা হতে হবে সুনির্দিষ্ট।
অর্থসংস্থান ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনার খুব গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয়। ক্ষতিগ্রস্ত বিদেশ ফেরতদের সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণ গ্রহণের বিষয়ে সহযোগিতা করতে হবে। ব্যবসা উদ্যোগের জন্য দিক-নির্দেশনা দেয়া কিংবা শ্রমবাজারে অন্তর্ভুক্তির জন্য দক্ষতা অর্জনের সুযোগ করে দেয়ার পাশাপাশি তাকে অবশ্যই বাজার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত করে দিতে হবে।
কেউ যদি ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেন তাকে সে বিষয়ে ভালো ভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। কৃষি ও গবাদিপশু পালনের উদ্যোগ নিলে, অবশ্যই কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে তারপর শুরু করতে হবে। অন্যান্য ব্যবসার উদ্যোগ নিলে ব্যবসার হিসাব-নিকাশ, আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও সংশ্লিষ্ট কারিগরি বিষয়ে পর্যাপ্ত ধারণা রাখতে হবে।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে পুনরেকত্রীকরণের প্রকল্পগুলোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো সদস্যদের প্রয়োজনীয় কারিগরি ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ক দিক-নির্দেশনা প্রদান, নিয়মিত ফলোআপ এবং পর্যবেক্ষণ করা। এভাবে অত্যন্ত বছরখানেক ধারাবাহিক ফলোআপ চালিয়ে যেতে হবে।
কেবলমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণে সামগ্রিকভাবে টেকসই পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব হবে না। লক্ষিত ব্যক্তি ও তার পরিবারের আত্নবিশ্বাস বৃদ্ধি এবং পারিপার্শ্বিক সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের মনো-সামাজিক সুরক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং ক্ষমতায়নও নিশ্চিত করতে হবে।
বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই জেনে-বুঝে, বৈধভাবে, নিরাপদ উপায়ে বিদেশ যেতে হবে। অভিবাসন খাতের প্রচুর সম্ভাবনা যেমন রয়েছে ঠিক তেমনি মুদ্রার ওপর পিঠে রয়েছে নানা ধরনের ভোগান্তি ও শোষণ। বিদেশে গেলেই যে সোনার হরিণ পাওয়া যাবে, এমন ধারণায়ও পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে।
ক্ষতিগ্রস্ত বিদেশ ফেরতদের আত্নকর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দরিদ্রতা দূরীকরণে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং সর্বোপরি সমাজের সবার অংশগ্রহণে সমন্বিতভাবে কাজ করে যেতে হবে।
লেখক: উন্নয়ন কর্মী