‘যুক্তরাষ্ট্রে বা অন্য কোথাও কোনও ‘সীমান্ত সংকট’ নেই। বরং কিছু ‘প্রকৃত সংকট’ রয়েছে, যেগুলো ব্যাপকভাবে অভিবাসনের দিকে মানুষকে চালিত করে – যেমন পুঁজিবাদ, যুদ্ধ, জলবায়ুজনিত জরুরি পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক সীমান্তে ‘কল্পিত সংকট’। এইসব যুক্তি সীমান্তের সুরক্ষা জোরদার করা এবং সহিংসতা সৃষ্টির ন্যায্যতার জন্য ব্যবহৃত হয়।’
কানাডার একজন সংগঠক হার্শা ওয়ালিয়া, যিনি অভিবাসী, শরণার্থী এবং অনিবন্ধিত মানুষদের পক্ষে ‘নো ওয়ান ইজ ইল্লিগ্যাল’ নামে একটি সংগঠনে কাজ করছেন। বিশ্বব্যাপী অভিবাসন, সীমান্তের রাজনীতি এবং ‘বর্ণবাদী জাতীয়তাবাদ’ এর উত্থানের বিষয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত তার নতুন গ্রন্থ ‘বর্ডার অ্যান্ড রুল’ নিয়ে সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
গার্ডিয়ানে প্রকাশিত হার্শা ওয়ালিয়ার এই সাক্ষাৎকারটি ভাষান্তর করেছেন মুর্শিদা টুম্পা ।
গত মার্চে, জর্জিয়ার আটলান্টায় একজন শ্বেতাঙ্গ তরুণ বন্দুকধারীকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল বিভিন্ন স্পা সেন্টারে আটজন মানুষকে হত্যার দায়ে, যাদের বেশিরভাগ এশিয়ান নারী। একই সময়ে ইউএস-মেক্সিকো সীমান্তে অভিবাসী এবং শরণার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, এমন ইস্যুর দিকে রাজনৈতিক মনোযোগ বাড়ছিল। আপনি কী এই দুটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্যে কোনো যোগসূত্র দেখতে পাচ্ছেন?
ওয়ালিয়া: আমি মনে করি ঘটনা দুটি গভীরভাবে সম্পর্কিত। ‘সীমান্ত স্ফীতি’ এবং ‘সীমান্ত সংকট’ শব্দ চয়নের এই নতুন প্রচলন আবারো অভিবাসী এবং শরণার্থীদের ‘দখলে নেওয়ার’ ছদ্মবেশ তৈরি করছে। আপাতদৃষ্টিতে এই শব্দগুলো জাতিগত নিরপেক্ষ ভাষা বলে মনে হতে পারে।আমরা ভাবছি যে ‘সীমান্ত স্ফীতি’ বলার বিষয়ে আমাদের মধ্যে অন্তর্নিহিত বর্ণবাদী কিছুই নেই- কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর মধ্যে গভীরভাবে বর্ণবাদী সংকেত নিহিত আছে।
এটি একটি তথাকথিত শ্বেতাঙ্গ মানুষের দেশ দখল করার জন্য কালো এবং বাদামি মানুষের স্রোতকে আহ্বান জানায়। এটিই ঐতিহাসিকভাবে অভিবাসী বর্জনের ভিত্তি।
আমরা যদি এই ঘটনাগুলোকে শুধুই এশিয়া বিরোধী বর্ণবাদ এবং ল্যাটিন বর্ণবাদ হিসাবে একটি পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা করি, তাহলে এগুলোকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে হতে পারে। তবে বর্ণবাদের উভয় রূপই মূলত অভিবাসী বিরোধী।
আমরা বিশ্বব্যাপী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী সহিংসতা, বিশেষত অভিবাসী বিরোধী ও মুসলিম বিরোধী সহিংসতা দেখে থাকি, তার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
ওয়ালিয়া: শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের উত্থান হল স্বতন্ত্র ডানপন্থী নজরদারি, রাষ্ট্রীয় বক্তৃতা এবং রাষ্ট্রীয় নীতির মধ্যে একটি প্রতিক্রিয়াশীল চক্রাকার বন্ধন। জর্জিয়ায় যৌনকর্মীদের উপর বন্দুক হামলার বিষয়টি যখন আসে, তখন আমরা যৌনতাকে অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করে যৌনকর্মীদের লক্ষ্যবস্তু করে তোলার যে বাস্তবতা দেখি, তা উপেক্ষা করতে পারি না। এটিকে একটি স্বাভাবিক যৌনকর্ম হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে না, বরং এটি অপরাধীকরণের একটি সামাজিক অবস্থা, যা সুরক্ষাহীন একটি পরিবেশ তৈরি করছে।ঠিক যেভাবে সীমান্তে প্রহরীরা অভিবাসীদের উপর নজরদারি করেছে: এই দুটি পরিস্থিতির বাস্তবতা একই। সীমান্তে প্রদর্শিত মিনিটম্যান এবং অভিবাসীদের হয়রানি করা, বা বন্দুকের পয়েন্টে ইউনাইটেড কনস্টিটিশনাল প্যাট্রিয়টস দ্বারা অভিবাসীদের অপহরণ, এইসব ঘটনার বাস্তবতা আর যৌনকর্মীদের উপর হামলার ঘটনার বাস্তবতা একই সূত্রে গাঁথা। অভিবাসী ও শরণার্থীদের মানহানিকর এমন রাষ্ট্রীয় নীতিগুলি বা ‘অবৈধ এলিয়েন’ শব্দটি অব্যাহত রাখার মতো সংবাদপত্রগুলি থেকে আমরা এই ধরণের বিদ্বেষকে আলাদা করতে পারি না।
জাতীয় সীমানাগুলিকে প্রায়শই নাগরিকদের সুরক্ষা হিসাবে বা ভিনদেশী স্বল্পবেতনভূক্ত শ্রমিকদের থেকে নিজ দেশের কর্মীদের সুরক্ষিত রাখার উপায় হিসাবে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু আপনি বলছেন যে, সীমান্তগুলি আসলে খুব আলাদা উদ্দেশ্যে কাজ করে।
ওয়ালিয়া: সীমান্তগুলি বৈশ্বিক বর্ণবাদ সম্পর্কিত একটি বিস্তৃত ব্যবস্থা বজায় রাখে। উন্নত জীবনের সন্ধানে চেষ্টারত মানুষের স্বাধীন চলাচলে তারা বাধা দিচ্ছে এবং এমনভাবে তারা এসব করছে, যা আমরা এর আগে কখনও দেখিনি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে খুব বেশি বর্জনীয় অভিবাসন নীতিমালা তৈরি করেছিলেন এখনও তার উপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তবে সীমান্ত সুরক্ষা এবং সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের বিষয়গুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবসময়ই দ্বিপক্ষীয়ভাবে অনুশীলন করা হয়। আমরা নব্বই এর দশকের শেষদিকে বিল ক্লিনটনের অধীনে মেক্সিকো সীমান্তে সামরিকীকরণের প্রথম নীতিগুলি দেখেছি।
আমরা যদি ইউরোপীয় প্রসঙ্গে আসি, [তিন বছর বয়সী সিরিয়ার বাচ্চা] অ্যালান কুর্দির মৃত্যুর ফলে স্পষ্ট হয় যে, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ডুবে যাওয়া অভিবাসীদের সমস্ত চিত্রই আসলে এমন কোনো অভিবাসন নীতিকে নেতৃত্ব দেয়নি, যা তাদের স্বাগত জানিয়েছিল। ভূমধ্যসাগরে ড্রোনের নজরদারি ও যুদ্ধ জাহাজ নিযুক্ত করতে কোটি কোটি ইউরো ব্যায় করা হচ্ছে। আমরা দেখছি যে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলের দেশ এবং অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত মধ্যপ্রাচ্যের দলগুলির সঙ্গে বাণিজ্য ও সহায়তা চুক্তি করছে। তারা সীমান্ত সামরিকীকরণের সীমানা হিসাবে বিশ্বের দক্ষিণাঞ্চলের দেশগুলির উপর নির্ভর করছে। এগুলি সবই স্থিরতার সংকট। পুরো বিশ্ব ক্রমবর্ধমান দুর্গ হয়ে উঠছে।
এই ‘অভিবাসন সংকট’ এর মূল কারণগুলি কী? এটি কেন ঘটছে?
ওয়ালিয়া: আমাদের যা বোঝার দরকার তা হল, অভিবাসন হচ্ছে একধরণের ক্ষতিপূরণ। অভিবাসন বিশ্বব্যাপী সহিংসতার একটি অবধারিত পরিণতি। এটা কোন কাকতালীয় ঘটনা নয় যে, বিশ্বে বর্তমানে বিপুল সংখ্যক অভিবাসী এবং শরণার্থী মানুষগুলো দরিদ্র দেশসমূহের কালো ও বাদামি বর্ণের মানুষ, যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যের শোষণ এবং ইচ্ছাকৃত অনুন্নয়নের কারণে দরিদ্র হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে লুণ্ঠনের এই অমীমাংসিত বিষয়গুলোই একইভাবে অভিবাসনের কারণ হিসেবে কাজ করে। বাণিজ্য চুক্তি, খনির উত্তোলন, বন উজাড়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আরও বেশি মানুষকে তাদের ভূমি থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। ইরাক ও আফগানিস্তান কয়েক দশক ধরে জাতিসংঘের বাস্তুচ্যুতের তালিকার শীর্ষে ছিল এবং সেগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর দখলের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
আপনি অভিবাসীদের নিজস্ব ন্যারেটিভের চেয়ে সরকার এবং তাদের নীতিমালার উপর কেন মনোযোগ দিলেন?
ওয়ালিয়া: সীমান্তের মৃত্যুকে প্যাসিভ ঘটনা হিসাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন মানুষ ঘটনাচক্রে মারা যায়, সহজাতভাবেই এ ধরণের চলাচল বিপজ্জনক, এরকম যা কিছু আমরা জানি, এর বাইরেও প্রকৃত কিছু ঘটনা থাকে।
অনেকে প্রচুর সুযোগ-সুবিধা নিয়ে এমনকি বিলাসবহুলভাবে স্থানান্তর হয়ে থাকেন।
বিশ্বজুড়ে অভিবাসী এবং শরণার্থীদের সঙ্গে যা ঘটছে সেটিকে সীমান্ত হত্যা হিসাবে অভিহিত করার উপর জোর দেওয়া উচিত। মানুষ হত্যার নীতি দ্বারাই মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। আক্ষরিক অর্থে, রাষ্ট্র আশা করছে যে মানুষ মৃত্যুবরণ করবে, ইচ্ছাকৃতভাবে মৃত্যুর পরিস্থিতি তৈরি করছে, যাতে হতাশার সৃষ্টি হয়।
অভিবাসীদের মৃত্যুর জন্য তাদেরকেই দায়ী করার যে ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছে:’তারা জানত যে এটি বিপজ্জনক হতে চলেছে, তাহলে কেন তারা এ পথে পা বাড়াল?’ এই ন্যারেটিভের পরিবর্তে রাষ্ট্রসমূহকেই জবাবদিহি করতে হবে।
আপনি কানাডায় থাকেন। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে, অনেকে কানাডাকে সুন্দর জায়গা হিসাবে ভাবেন। কম বর্ণবাদী, কম হিংস্র, শরণার্থী এবং অভিবাসীবান্ধব। এটাই কি বাস্তবতা?
ওয়ালিয়া: এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ‘আপনার প্রধানমন্ত্রী বলেছেন শরণার্থীরা স্বাগত’। অস্থায়ী বিদেশী কর্মী কর্মসূচির মাধ্যমে অভিবাসনের শর্তগুলি কতটা অসম্পূর্ণ তা আসলে সহিংসতার মুখোশে ঢাকা থাকে। এখানে শ্রমজীবী তাদের গৃহকর্তার বাড়িতে বসবাস করতে বাধ্য হন। যখন আপনার শ্রমের আর প্রয়োজন হয় না, তখন আপনাকে নির্বাসন দেওয়া হয়, প্রায়শই আপনার মজুরি পরিশোধ না করেই। এর অর্থ হল কানাডা শোষণের একটি মডেলকে নিখুঁত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশ ক্রমবর্ধমানভাবে এই মডেলটির দিকে তাকাচ্ছে, কারণ এটি রাষ্ট্র এবং মূলধন উভয় স্বার্থ রক্ষায় পরিপূর্ণভাবে কাজ করে। মূলধন সস্তায় শ্রম চায় এবং রাষ্ট্র সম্পূর্ণরূপে নাগরিক অধিকারযুক্ত লোকদের চায় না।
আপনি সম্প্রতি লিখেছেন যে ‘ক্রমবর্ধমান শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যকে সন্ত্রাসবিরোধী বা ঘৃণ্য অপরাধ আইনের মাধ্যমে মোকাবেলা করা যায় না।’ কেন?
ওয়ালিয়া: সন্ত্রাসবাদ কোনও বর্ণান্ধ ঘটনা নয়। গত ২০ বছর ধরে সন্ত্রাসবিরোধী বিশ্বযুদ্ধ গভীরভাবে ইসলামোফোবিক বক্তব্যকে ঘিরে অনুমিত হয়েছিল যা বিশ্বজুড়ে কালো ও বাদামি মুসলিম এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলিতে বিধ্বংসী প্রভাব ফেলেছে।
আমি মনে করি যে, এটি জাতীয় সুরক্ষা অবকাঠামো ও বর্ণবাদী যুক্তি, বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গ বিরোধী বর্ণবাদের উপরও নির্মিত হয়েছে – এটি অবর্ণনীয় এবং নির্বুদ্ধিতা। আমরা বর্ণবাদী সম্প্রদায়ের সুরক্ষার জন্য এই পদ্ধতিগুলিকে কোনওভাবেই বিকৃত করতে পারি বলে মনে হয় না।
কানাডায় কিছু অতি-উৎসাহী তরুণদের সংগঠনকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে মনোনীত করার পরে ঘটে যাওয়া একটি বিষয় হল- অতি-উৎসাহী তরুণদের সংগঠনটি তালিকাভুক্ত হওয়ার দিন, অন্যান্য বেশ কয়েকটি সংস্থা যুক্ত হয়েছিল যা মুসলিম সম্প্রদায়ের অংশ ছিল। আমাদের বেশিরভাগেরই উদ্বেগের জায়গা ছিল যে: সন্ত্রাসবাদ ধ্বংস করার পরিবর্তে এটি কি শুধু তালিকা বড় করার অজুহাত? দীর্ঘমেয়াদে, কি হতে চলেছে? এমনকি যদি অলৌকিকভাবে অতি-উৎসাহী এসব তরুণ এবং এর সদস্যদের ধ্বংস করে দেওয়া হয়, তবে তালিকার অন্য সব সংস্থার কী হবে? তারাও তো এখনও অপরাধী হচ্ছে, সন্ত্রাসবাদী হচ্ছে।
আপনি সীমান্ত সাম্রাজ্যবাদের অবসান, এবং বর্ণবাদী পুঁজিবাদের অবসানের পক্ষে কথা বলছেন। সেগুলি বড় ধরণের লক্ষ্য। এককভাবে একজন ব্যক্তির চিন্তাকাণ্ডকে আপনি কীভাবে ভাঙবেন?
ওয়ালিয়া: আমি আসলে এই বিষয়গুলো নিয়ে এর আগে খুব কমই অনুসন্ধান করেছি । কারণ আমি এমন কিছু করার চেষ্টা করতাম যা সাধারণ বলে মনে করতাম এবং ভাবতাম এভাবেই বিশ্বের পরিবর্তন সম্ভব, কিন্তু আদতে তা ঘটেনি। আমার ক্ষেত্রে, সহিংসতাগুলো কিভাবে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সেটি বুঝতে পারা এবং কোনো্ সমস্যার বিশালতা অনুধাধাবন করতে পারাটা দুরূহ ছিল না। এই বিষয়টিই আমাকে আরও বড় পরিসরে চিন্তা করতে, অন্যদেরকে সংগঠিত করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এটি মূলত উগ্রতা সম্পর্কে অনুধাবনবোধ তৈরির এক বিশাল সম্মিলিত কর্ম। এটি কোনো একক ব্যক্তি কিংবা একক স্থানের উপর নির্ভর করে না।