অভিবাসীদের সামাজিক সুরক্ষায় নিরাপত্তা মডেল: সুযোগ ও সম্ভাবনা

0
1124

আমিনুল হক তুষার

বর্তমান সরকার ঝুঁকিপূর্ণ দরিদ্র ও অতি দরিদ্র নাগরিকদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিতকল্পে ‘জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশল’ প্রণয়ন করেছে। যার সঠিক বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি ‘জাতীয় কর্ম পরিকল্পনা ২০১৬-২০২১’ প্রস্তুত করা হয়েছে। উক্ত কর্মপরিকল্পনায় অসহায় ও দরিদ্র অভিবাসী কর্মী এবং তাদের পরিবারকে স্বল্প পরিসরে যদিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু তাদের সামাজিক সুরক্ষায় গৃহীত বা প্রস্তাবিত কর্মসূচিগুলোর সংখ্যা বা ধরণ চাহিদা অনুসারে উল্লেখযোগ্য নয়।

অভিবাসী কর্মীর মেধাবী সন্তানদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি থেকে শুরু করে পুনর্বাসন ঋণ সহায়তা, বীমা, কারিগরি দক্ষতা উন্নয়ন, অভিযোগ নিস্পত্তি কিংবা আইনি সহায়তা প্রদান ইত্যাদি উক্ত কর্মপরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। যার বেশিরভাগই ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ড ও বিএমইটি অনেক আগে থেকেই প্রদান করে আসছে। উক্ত কর্মপরিকল্পনা অনুসারে  প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় উপকারভোগী নির্বাচন ও তালিকা প্রণয়নের জন্য একটি নির্দেশিকা তৈরী করেছে। যা মার্চ ২০১৮ এর পর থেকে নির্দিষ্ট সময়ে হালনাগাদ করে অনলাইনে প্রকাশ করার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া আছে । (জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশল বাস্তবায়নের কর্মপরিকল্পনা ২০১৬-২০২১, এনএসএসএস, জিইডি-পরিকল্পনা কমিশন, পৃষ্ঠা নং ৮০ দ্রষ্টব্য)।

কিন্তু দুৰ্ভাগ্যজনকভাবে এই কর্মপরিকল্পনার অগ্রগতি সম্পর্কে নাগরিক সমাজ ও অভিবাসী কর্মীরা খুব একটা জ্ঞাত নয়। উপরন্তু, অভিবাসী কর্মীদের ও তাদের পরিবারের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে কার্যকর কোন সামাজিক নিরাপত্তা মডেলও নেই। যদিও সরকারের পাশাপাশি সীমিত আকারে কিছু উন্নয়ন সংস্থা তৃণমূল পর্যায়ে তাদের সামাজিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিতে কাজ করছে।  

অভিবাসনকে নিয়মিত, নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল করতে সম্প্রতি জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো ‘গ্লোবাল কম্প্যাক্ট’ নীতি গ্রহণ করেছে, যেখানে অভিবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সূচকসহ কিছু রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া জাতিসংঘের ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ বা ‘এসডিজিতে (লক্ষ্যমাত্রা ২০১৬-২০৩০)’ অভিবাসী শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টি ও উল্লেখ করা হয়েছে।

ফিলিপাইনসহ কয়েকটি শ্রমিক প্রেরণকারী দেশ যদিও সামাজিক সুরক্ষার জন্য নানান ধরণের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, কিন্তু বাংলাদেশে অভিবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সামাজিক সুরক্ষার স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য কোনো মডেল নেই। অন্যদিকে সরকারি রাজস্ব থেকে খুব কম বরাদ্দই থাকে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জন্য বা অভিবাসীদের সামাজিক সুরক্ষার জন্য, যেটুকু থাকে তাও আসে অভিবাসী শ্রমিকদের অর্থে গঠিত কল্যাণ ফান্ড থেকে।

তৃণমূল দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে নিরাপত্তা বলয় বা বেষ্টনীর আওতায় নানান ধরণের কর্মসূচি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার বাস্তবায়ন করছে। কিছু কিছু মন্ত্রণালয় যেমন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ, কৃষি, স্থানীয় সরকার, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কয়েকটি মডেল অনুসরণ করে থাকে। কিন্তু অভিবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সত্যিকার অর্থে কোন সামাজিক সুরক্ষা মডেল নেই বা তারা কোন স্বীকৃত মডেল অনুসরণও করে না।

ফলে তাদের বেশিরভাগ পরিকল্পনাই কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ থাকে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কৌশল সম্পর্কে অভিবাসী বা নাগরিক সমাজ খুব একটা অবগত থাকেন না। তাই অভিবাসীদের ও তাদের পরিবারের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত ও সরকার গৃহীত কার্যক্রমের বাস্তবায়নের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে একটি সামাজিক সুরক্ষা মডেল প্রস্তুত করা উচিত।

আমাদের সামাজিক সুরক্ষার জাতীয় কৌশলে মূলত সামাজিক সুরক্ষাকে চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে:

  • সামাজিক সহায়তা ।
  • খাদ্য নিরাপত্তা ও দুর্যোগকালীন সহায়তা।
  • সামাজিক বীমা বা জীবিকা সহায়তা।
  • মানব উন্নয়ন ও সামাজিক ক্ষমতায়ন।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এই চারটি শ্রেণীতেই সহায়তা প্রদান বা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে বিচ্ছিন্নভাবে এবং সুস্পষ্ট করে সেগুলো অভিবাসীদের বা নাগরিক সমাজের কাছে উপস্থাপন করা হয়নি।

উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে:

সামাজিক সহায়তায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়- বিপদগ্রস্থ কর্মীদের দেশে ফেরত আনয়ন, অভিবাসী কর্মীর মৃতদেহ দেশে আনা ও সৎকারের জন্য আর্থিক সহায়তা এবং মৃত কর্মীর পরিবারকে এক কালীন আর্থিক সহায়তা। যার বেশিরভাগের অর্থের যোগান দেয় ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ড বা কল্যাণ বোর্ড।

অথচ এই শ্রেণীতে দুঃস্থ, পাচারের শিকার নারী ও পুরুষ কর্মীদের বিশেষ ঝুঁকি ভাতা প্রদান, কিংবা বিদেশ ফেরত কর্মীদের নির্দিষ্ট সময় পরে ফেরত আসলে অবসর বা স্বীকৃতি ভাতার ব্যবস্থা সরকারের নিজস্ব তহবিল বা রাজস্ব থেকে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ রয়েছে ।

আবার খাদ্য নিরাপত্তা ও দুর্যোগকালীন সহায়তার ভেতর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে- আশ্রয়ণ বা নিরাপদ বাসস্থান সুবিধা ও আনুষঙ্গিক আইনি সহায়তা, যার অর্থের উৎস একই ভাবে ওই ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ড। কিন্তু এইখানে সুযোগ রয়েছে দুর্যোগকালীন বা মহামারিকালীন সময়ে জরুরি ত্রাণ সহায়তা বা রিলিফ কার্ড ও ভাতা প্রদানের, যার তহবিল আসবে সরাসরি সরকারি রাজস্ব বরাদ্দ থেকে।

অন্যদিকে, সামাজিক বীমা বা জীবিকা সহায়তায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়- অভিবাসী কর্মীদের জন্য আবশ্যিক বীমা, জীবন বা স্বাস্থ্যবীমা, বৈধ রেমিট্যান্স আনয়নে দুই শতাংশ  প্রণোদনা সুবিধা, কর্মক্ষেত্রে ভাতা ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধার নিশ্চয়তা, অসুস্থ কর্মীর জন্য অনুদান ইত্যাদি। যার উৎস হতে পারে ওয়েলফেয়ার ফান্ড, সরকারি রাজস্ব তহবিল, বা নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে- আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহার যোগ্য স্বাস্থ্যবীমা কার্ড, উদ্যোক্তা উন্নয়নে তৃণমূল পর্যায়ে সুদহীন ক্ষুদ্রঋণ সহায়তা, কিংবা বিদেশে অবস্থানরত কর্মীর জন্য বাৎসরিক উৎসাহ ভাতা ইত্যাদি।

মানব উন্নয়ন ও সামাজিক ক্ষমতায়ন শ্রেণীতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় যদিও দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করে আসছে, কিন্তু সামাজিক সুরক্ষায় সেই সকল কর্মকান্ডকে নির্দিষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বা যায়নি। যেমন: এই শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে- অভিযোগ নিস্পত্তি বা আইনি সহায়তা সেবা, বিনামূল্যে বা ভাতাসহ কারিগরি দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ সেবা (বিভিন্ন প্রকল্প যেমন: সেইপ, স্টেপ, সেপ ইত্যাদি) এবং অভিবাসী শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি যার প্রায় সবকিছুরই উৎস ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ড ।

মূলতঃ এই সকল অভিবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত ও ক্ষমতায়নের জন্য কল্যাণ বোর্ড ছাড়া সরকারি রাজস্ব হতে বরাদ্দ খুব কমই থাকে । সরকার যদিও প্রান্তিক পর্যায়ে দরিদ্র মানুষদের জীবন -জীবিকার ঝুঁকি নিরসনে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ রেখেছে, কিন্তু দুঃস্থ অভিবাসী কর্মীর জন্য নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে খুব কমই বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অভিবাসী শ্রমিক বা বৈদেশি কর্মসংস্থান আদতে একটি লাভজনক পেশা বা ক্ষেত্র মনে হলেও এই পেশাতে ও রয়েছে নানান ধরণের ঝুঁকি। আমরা দেখেছি অনেক বেকার জনসাধারণ বা অসহায় নারীরা অধিক অর্থ উপার্জন বা উন্নত জীবনযাপনের মোহে অনেক সময় ঝুঁকির আশ্রয় নেয়। যার কারণে তারা নানা ধরণের শোষণ, নিপীড়ন, ও বঞ্চনার শিকার হন বা মানব পাচাকারীদের খপ্পরে পরে সহায় সম্বল হারিয়ে দেশে ফেরত আসেন। ফলে দেখা যায়, খুব স্বল্প সময়ে একজন অভিবাসী কর্মী বা তার পরিবার স্বচ্ছল অবস্থা থেকে দারিদ্রের তালিকাতে নেমে আসেন, নিম্নমানের জীবনযাপন করেন এবং সামাজিকভাবেও হন হেয়প্রতিপন্ন।

আবার আমরা এমনও দেখেছি, দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে উপার্জন করে একজন অভিবাসী কর্মী দেশে বিনিয়োগ করতে গেলে বা তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে গেলে সম্মুখীন হন নানা ধরণের প্রতিকূলতার। তারপরে আবার থাকে না তাদের জন্য কোন অবসর বা উৎসাহ ভাতা – যা তাদের শেষ বয়সে নিরাপত্তা দিতে পারে। তাই প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের  উচিত অন্য সকল মন্ত্রণালয়, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সমন্বয়ে এবং জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশল ও কর্মপরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে অভিবাসীদের কল্যাণে ও সুরক্ষায় নিজস্ব ‘সামাজিক নিরাপত্তা মডেল’ তৈরী  ও তার সঠিক বাস্তবায়ন করা। সর্বোপরি, পরবর্তী জাতীয় কর্মপরিকল্পনাতে (সামাজিক সুরক্ষা কৌশল ২০২২-২০২৬)  অভিবাসীদের সুরক্ষায় নতুন কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এখন থেকেই কাজ করা উচিত।

  লেখক: শ্রম অভিবাসন বিশ্লেষক ও উন্নয়নকর্মী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here