১৪ ডিসেম্বর, ২০২০, ইউএনএইচসিআর–এর বয়স ৭০ বছর পূর্ণ হবে। কিন্তু এই জন্মদিন উদযাপনের পরিস্থিতিতে আমরা এখন নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একটি ছিন্নবিচ্ছিন্ন বিশ্ব যখন পুনর্গঠিত হতে শুরু করলো, তখন ইউরোপের শরণার্থীদের জন্য গৃহ সন্ধানের দায়িত্ব নিলো ইউএনএইচসিআর। ১৯৫০ সালের ১৪ ডিসেম্বর থেকে এটি কার্যকর করা হয়েছিলো, এর ইশতেহার ছিলো সীমিত এবং স্পষ্টতই অরাজনৈতিক।
কিন্তু পরিবর্তিত আর্ন্তজাতিক পরিস্থিতি আবারো নতুন সংঘাত তৈরি করেছিলো। ১৯৫৬ সালের অভ্যূত্থানে সোভিয়েত সেনাবাহিনী চূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর আরও অনেক শরণার্থী- ২ লক্ষ হাঙ্গেরিয়ান অস্ট্রেলিয়ায় পালিয়ে যায়। পরের বছর, তিউনিসিয়া ইউএনএইচসিআর–এর কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন করেছিল কারণ প্রতিবেশী আলজেরিয়ায় স্বাধীনতার যুদ্ধে সীমান্তে কয়েক হাজার মানুষকে সুরক্ষার সন্ধানে পাঠিয়েছিলো এবং মিশনটির সম্প্রসারণ এখনো বিদ্যমান।
পোস্ট কলোনিয়াল যুগের সঙ্গে যুক্ত ছিল মুক্তির সংগ্রাম এবং তারপরে ক্ষমতার জন্য লড়াই, লক্ষ লক্ষ নাগরিকরা এই উত্থানযাত্রায় জড়িয়ে পড়েছিলো।বছরের পর বছর, মহাদেশ থেকে মহদেশে, ইউএনএইচসিআরকে মধ্য আমেরিকা থেকে সাব–সাহারান আফ্রিকা (আফিকা মহাদেশে সাহারা মরভূমির দক্ষিণে অবস্থিত দেশ) এবং ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হওয়া ক্রমবর্ধমান সংখ্যক মানুষকে সহায়তায় আহ্বান জানানো হয়েছিল।
গত বছর আফগানিস্থান থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়ার চার দশক পূর্ণ হয়েছে। পরের বছর সিরিয়ায় চলমান সংঘাত শুর হওয়ায় এক দশক হবে। এভাবে পুরানো দ্বন্দ্বগুলোর প্রভাবগুলো ম্লান হতে না হতেই উত্থিত হচ্ছে অযাচিত বার্ষিকী, নব্য দ্বন্দ্বসমূহ। গত সাত দশক ধরে বিশ্বসম্প্রদায় শান্তির যুগে যাত্রা করার শপথ করেছিল, তবে লড়াইয়ে অনুসন্ধানটা ভালো হলেও সেগুলো সমাধানে ততটা পারদর্শীতা দেখাতে পারেনি।
ফলস্বরূপ, ইউএনএইচসিআরকে বার বার আহ্বান জানানো হয়েছে গৃহ হতে উৎখাত অসহায় মানুষদের রক্ষায়। অতীতের ও বর্তমানের ইউএনএইচসিআর সহকর্মীরা যে পরিবর্তন তৈরি করেছে, তাতে তারা গর্বিত। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বা সম্প্রতি করোনাভাইরাস মহামারীর প্রকোপে বাস্তুচ্যুত হওয়ার মতো বিষয়কে তারা চ্যালেঞ্জ করতে প্রস্তুত।
যদি যুদ্ধরত পক্ষগুলো যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়, যদি বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিরা নিরাপদে স্বদেশে ফিরে আসতে পারেন, যদি সরকারগুলো পুনর্বাসনের দায়িত্ব ভাগ করে নেয়, যদি রাষ্ট্রগুলো আর্ন্তজাতিক আইনের আওতায় আশ্রয় এবং অ–পুনর্বাসন নীতি সম্পর্কিত তাদের বাধ্যবাধকতা পালন করে, হুমকির কারণে যারা যেখান থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছে তাদের সেখানে পাঠানো না হয়, তাহলে ইউএনএইচসিআর–এর চিন্তার কারণ খুব কম থাকবে।
১৯৯৪ সালে আমি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গোর (যার পূর্ব নাম ছিলো যায়ার) ইউএনএইচসিআর–এর জরুরী সাড়াপ্রদানকারী দলের অংশ ছিলাম। সেখানে চার দিনের মধ্যে, এক মিলিয়ন মানুষ গণহত্যার হাত থেকে বাঁচার জন্য রুয়াান্ডা থেকে সীমান্ত পেরিয়েছিল, কেবল কলেরার প্রাদুর্ভাব থেকে বাঁচতে কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল। আমার সহযোগী যারা এসব লোকদের রক্ষা করার প্রতিশ্রতি দিয়েছিলেন তাদেরকে রক্ষার পরিবর্তে কবর খনন করতে হয়েছিলো।
গত বছরই, শরণার্থী, অভ্যন্তরীন বাস্তুচ্যুত, আশ্রয়প্রার্থী এবং রাষ্ট্রবিহীন ব্যক্তিদের সংখ্যা বিশ্বের জনসংখ্যার ১ শতাংশতে পৌঁছেছে। আমি ভাবছি যে আমরা আর কত শতাংশ গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনা করবো-২ শতাংশ, ৫ শতাংশ বা তারও বেশি? রাজনৈতিক কারণে আর কত লোককে বাস্তুচ্যুত হওয়ার ক্ষতি ও অসম্মান ভোগ করতে হবে?
সুতরাং ইউএনএইচসিআর–এর ৭০ বছর পূর্তিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আমার চ্যালেঞ্জটি হল: আমাকে চাকরি থেকে সরিয়ে দিন।
আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন একটি বিশ্ব গড়ার, যেখানে ইউএন শরণার্থী সংস্থার সত্যই দরকার নেই। আমাকে ভুল বুঝবেন না: বিষয়টা হলো, আমাদের কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; তবুও আমাদের অস্তিত্ব থাকা উচিত নয়।যদি আমরা নিজেকে আরও অনেক জন্মদিন পালন করতে দেখতে চাই তবে একমাত্র সিদ্ধান্ত হলো,আর্ন্তজাতিক মহল ব্যর্থ হয়েছে। তবে জনসাধারণের স্থানচ্যুত হওয়ার কারণগুলো যদি কেবল অর্ধেক দেশেও সমাধান করা যায়, তবে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী স্বদেশে যেতে পারবেন। এটা খুব ভালো একটা সূচনা হবে। এবং এটি এমন একটি বিষয় যা আমরা সবাই সত্যই উদযাপন করতে পারি।