বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও শেকড়ের বহু বিচিত্রতার ধ্বনি শুনতে পাওয়া যায় পৃথিবীর দূরতম প্রান্ত থেকেও। মূলধারার বাঙ্গালি জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি এখানে রয়েছে ৫৪টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষের বসবাস; রয়েছে কমপক্ষে ৩৫টি ভাষার অদ্ভূত মেলবন্ধন।
২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ১৫ লাখ ১৬ হাজার আদিবাসী রয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১ দশমিক ৮ শতাংশ। যদিও তাদের দাবি, এ সংখ্যা কমপক্ষে ৫০ লাখ। যাদের অধিকাংশের বসবাস সমতল ভূমিতে এবং বাকিরা রয়েছেন পার্বত্য চট্রগ্রামের পাহাড়ী অঞ্চলে। যদিও রাষ্ট্র এখনো আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। এমনকি সময় যত গড়িয়ে যাচ্ছে ততই সংকট ঘণিভূত হচ্ছে। জমি দখল, মনুষ্যসৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ নানা কারণে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষের শেকড় ছেড়ে চলে যাওয়ার হার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে।
চলতি বছর দেশজুড়ে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাসমূহে বেশ কয়েকটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে, যা সর্বত্র আলোচিত হয়। দ্য ইন্ডিজিনিয়াস ওয়ার্ল্ড ২০২১ শীর্ষক প্রতিবেদনে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ থেকে তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
ম্রো গ্রামবাসীদের উচ্ছেদ করে বিলাসবহুল হোটেল নির্মাণ
পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার চিম্বুক রেঞ্জে আদিবাসী ম্রো জনগোষ্ঠীর বসবাস। এখানেই নির্মিত হচ্ছে বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হোটেল। এর ফলে হুমকির মুখে পড়েছেন অঞ্চলটিতে শত শত বছর ধরে বসবাস করা ম্রো গ্রামবাসী। তারা বাধ্য হচ্ছেন পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটি ছাড়তে। সম্প্রদায়টির অভিযোগ রাষ্ট্রীয় একটি বাহিনী পরিচালনাধীন প্রতিষ্ঠান এবং ক্ষমতাধর ব্যবসায়িক গোষ্ঠী শিকদার গ্রুপ এর ‘আর অ্যান্ড আর হোল্ডিংস লিমিটেড’ যৌথভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রতিষ্ঠান দুটি তাদের যৌথ উদ্যোগটি গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে সবার সামনে ঘোষণা করে।

আদিবাসী অধ্যুষিত ৮০০ থেকে ১০০০ একর জমিতে নির্মাণ করা হবে বিলাসবহুল হোটেলটি এবং অবকাশযাপনের জন্য এর আধুনিক সুযোগসুবিধাসম্পন্ন ডজনখানেক বিলাসবহুল ভিলা, কার ক্যাবল ও সুইমিংপুল। এর প্রভাবে কিছু ম্রো পরিবার ইতোমধ্যে উচ্ছেদ হয়েছে এবং আরো অনেকেই তাদের সম্পত্তি হারানোর হুমকিতে রয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামের মধ্যে রয়েছে কাপরু পারা, দোলা পাড়া, ইরা পাড়া, মার্কিন পাড়া, লং বাইতং পাড়া, মেনসিং পাড়া, রিয়ামানাই পাড়া ও মেনরিং পাড়া।দীর্ঘ সময় ধরে এখানকার মানুষের জীবনধারণের জন্য এই জমি প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছে।
বিলাসবহুল হোটেল নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিলের দাবিতে জাতীয় আন্তঃদেশীয় অ্যাডভোকেসি গ্রুপের সহযোগিতায় ম্রো গ্রামবাসীরা প্রতিবাদ মিছিল করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী ও নীতি নির্ধারকদের কাছে স্বাক্ষর সংবলিত পিটিশন প্রদান করেছেন। কিন্তু বিষয়টির সুরাহা সম্পর্কিত কোনো ইতিবাচক ফলাফল এখনো কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে আসেনি। এসব কারণে ম্রো জনগোষ্ঠীর মানুষেরা আরো অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনযাপন করছেন।
আদিবাসী নারী ও মেয়েশিশুদের ওপর নিপীড়ন পরিস্থিতি উদ্বেগজনক

পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী নারী ও মেয়েশিশুদের ওপর সহিংসতা পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগজনক। মানবাধিকার সংস্থা কাপেং ফাউন্ডেশন এর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০ সালে কমপক্ষে ৫৪টি সহিংস ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন আদিবাসী নারী ও মেয়েশিশুরা। যার মধ্যে ৩৫টি ঘটনা ঘটেছে সমতল এলাকায় এবং বাকিগুলো পাহাড়ী অঞ্চলে, কমপক্ষে সাতজন নারী ও মেয়েশিশু হয় যৌন নিপীড়ন অথবা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। প্রতিবেদনটির বরাতে আরো জানা যায়, কমপক্ষে ১৮ জন নারী ও মেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, চারজন ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হাত থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন ১৪ জন।
রাষ্ট্রীয় বাহিনী দ্বারা নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে
পার্বত্য চট্ট্রগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা এবং সন্ত্রাসবাদ, বিশেষ করে আইপিএইচআরডির সদস্যদের ওপর হামলা এই কোভিডের মধ্যেও অব্যাহত ছিল বলে দাবি স্থানীয় নেতৃবৃন্দের। শ’খানেক আইপিএইচআরডি গ্রেফতার কিংবা বন্দুকের গুলিতে নিহত হওয়ার ভয়ে পালিয়েছিল পর্যন্ত। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির দাবি, এবছর এখন পর্যন্ত ১৩৯টি মানবাধিবার লঙ্ঘণের ঘটনা ঘটেছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নেতৃত্বে। পিসিজেএসএস এর বার্ষিক মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছর তিনটি বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ৫০টি নির্বিচারে গ্রেফতারের ঘটনা, ৪৯টি স্বল্পমেয়াদে গ্রেফতার ও ৫৪টি শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে।
কোভিডের কারণে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত
কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালে অনলাইন ও টেলিভিশনে ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারেনি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আদিবাসী শিক্ষার্থী। অনেক আদিবাসী শিক্ষার্থী অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র পরিবারের, বিশেষ করে যারা গ্রাম ও দুরবর্তী অঞ্চলসমুহ থেকে উঠে এসেছেন। যেকারণে ভার্চুয়ালি ক্লাস করার মতো সামর্থ্য তাদের ছিল না। ‘ইম্প্যাক্ট অব কোভিড-১৯ অন এডুকেশন ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে ২০ জুন, ২০২০ তারিখে অনুষ্ঠিত এক অনলাইন আলোচনায় দাবি করা হয়, সংসদ টেলিভিশন বিটিভিতে প্রচারিত ক্লাসে ৭৫ শতাংশ আদিবাসী শিক্ষার্থীর অংশ নেয়ার সামর্থ্য ছিল না।

আশার কথা হলো এত সংকটের মধ্যেও এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে পিছপা হচ্ছে না আদিবাসী শিক্ষার্থীরা।সুযোগ বঞ্চিত এরকম স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের পড়ানোর কাজ শুরু করেন গ্রামের কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণ। এরকমই একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি জেলার হাজাছড়া নামের ছোট্ট একটি গ্রামকে নিয়ে। চাকমা তরুণদের উদ্যোগে ‘পহর ছিদোক’ (আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে পড়ুক) শিরোনামে একটি শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম চালু হয়েছিল কোভিড-১৯ চলাকালে। নিজেদের গ্রামের স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পড়ালেখার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও মনোসামাজিক বিষয় নিয়েও তারা শিক্ষা দিচ্ছেন।
আদিবাসী শিশুদের ওপর হামের প্রাদুর্ভাব: মৃত্যু ১০, সংক্রমিত ৩০০

রাঙ্গামাটির সাজেক ইউনিয়ন ও বান্দরবানের লামা ইউনিয়নে গত মার্চে হঠাৎ আঘাত হানে হাম। করোনার মতোই ভয়াবহ আতঙ্ক হিসেবে এখানকার মানুষের সামনে আসতে থাকে হাম। এসময় একের পর এক আদিবাসী আক্রান্ত হতে থাকে ভাইরাসাটিতে। এরমধ্যে শিশুদের আক্রান্তের হারই ছিল সবচেয়ে বেশি। হামে আক্রান্ত হয়ে ১০ আদিবাসী শিশু মারা যায় এবং কমপক্ষে ৩০০ জন সংক্রমিত হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ আক্রান্ত শিশুরা কোনো চিকিৎসা সেবা পায়নি কয়েক সপ্তাহ ধরে। শিশুদের মৃত্যুর খবরটি সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পরার পর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের টিম সেখানে যায়। এরপর সরকারের একাধিক প্রতিষ্ঠান মিলে প্রায় ৩০০ শিশুকে ভ্যাকসিন, ভিটামিন ও অন্যান্য পুষ্টিসমৃদ্ধ ঔষুধ দেয়।
অবশ্য স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ক্লিনিকের নিয়মিত সুবিধা পাওয়া থেকে তারা বঞ্চিত হয়। আবার আক্রান্ত এলাকাসমূহ দুর্গম হওয়ায় স্বাস্থ্যকর্মীরাও বাড়িতে গিয়ে নিয়মিত সেবা প্রদান করতে পারেন না। নানাবিধ কারণে স্বাস্থ্যসেবা থেকে ক্রমাগতই বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ আদিবাসী মানুষ। মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তিতে মূলধারার সঙ্গে এখানেও প্রতীয়মান স্পষ্ট বিভাজন রেখা।




