তুষার ফারুক
ডেভিড ডানগে জুনিয়র নামের একজন আদিবাসী যুবক সিডনির একটি কারাগারে মারা যান ২০১৫ সালে। জানা যায়, ডেভিডকে বিস্কুট খাওয়া বন্ধ রাখার জন্য পুলিশ কর্মকর্তা কর্তৃক নিষেধ করার পরপরই নাকি এই ঘটনা ঘটেছিল। এসময় নাকি কারারক্ষীরা ডেভিডের মুখ মাটিতে ঠেকিয়ে দিয়েছিল এবং উত্তেজনা কমানোর ঔষুধ প্রয়োগ করেছিল তার শরীরে।
মূলত একটি ভিডিও দৃশ্যে এ নির্মমতার চাক্ষুষ চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। যেখানে দেখা গিয়েছিল, ডেভিডের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো এবং তিনি চিৎকার করে বারবার বলেছিলেন ‘আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না’।
তার এ ঘটনাটি আফ্রিকান-আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েড এর মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে সমান্তরাল। ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর মূলত পৃথিবীজুড়ে মার্কিন পুলিশি ব্যবস্থা ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়ে ওঠে।
‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন অস্ট্রেলিয়ায় কারাবন্দি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষদের ওপর নির্মমতা ও হত্যার বিষয়টিকেও সামনে এনেছিল।
কারাগারে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষদের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে শুরু হওয়া তদন্তের এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি চলতি সপ্তাহ ৩০ বছর পার করছে। এ সংকট নিরসনে রয়্যাল কমিশন শতাধিক সুপারিশ দিয়েছিল। কিন্তু দশকের পর দশক পেরিয়ে গেলেও সেই সংকট না কমে বরং বেড়েই চলছে এবং উদ্বেগ তৈরি করছে।
ভয়ঙ্কর তথ্য হলো, অ-আদিবাসীদের চেয়ে একজন আদিবাসী মানুষের জেলে যাবার সম্ভাবনার হার প্রায় ১২ গুণ বেশি। বাস্তবতা হলো, যে পদ্ধতিগত সমস্যা ও অসুবিধার মুখোমুখি হয়েছিল আদিবাসী মানুষেরা, তা সমাধান না করার ফলে নতুন করে তাদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
‘এই সিস্টেম প্রতিনিয়ত আমাদের হত্যা করে চলেছে এবং কেউই কিছু করছে না এ নিয়ে’-পল সিলভা, ডেভিড ডানগে জুনিয়রের ভাইয়ের ছেলে, এক প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন। পল সিলভা বিবিসির প্রতিবেদককে আরো জানিয়েছেন, তার পরিবার পাঁচ বছর ধরে বিচার চেয়ে লড়াই করেছে। তার প্রশ্ন ‘আর কবে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে? আদিম জাতিস্বত্তার এ মানুষদের ওপর আর কবে নাগাদ সিস্টেমেটিক বর্ণবাদী আচরণ বন্ধ হবে?’
কারাগারে কত সংখ্যক আদিবাসী মারা গেছে?
১৯৯১ সাল থেকে কমপক্ষে ৪৭৪ জন আদিবাসী কারাগারে মারা গেছেন। এর মধ্যে গত মাসেই পাঁচজন মারা গেছেন। যদিও আদিবাসী বন্দিদের মৃত্যুহার অ-আদিবাসী বন্দির চেয়ে আনুপাতিকহারে কম, কিন্তু তাদের কারাগারে বা পুলিশ লকআপে আটক থাকার আশঙ্কা অনেক বেশি। ১৯৯১ সালের তদন্ত প্রদিবেদনে উঠে আসা এই চিত্র এখনও সমানভাবে অব্যাহত রয়েছে।
কারাগারে বন্দি থাকার হার পৃথিবীর অন্য যেকোনো সম্প্রদায় বা দলের চেয়ে আদিবাসীদের বেশি। সমস্ত কিশোর বন্দিদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই আদিবাসী। এর মধ্যে অনেক বন্দিই আবার সাজা ছাড়া জেল খাটছেন। সম্ভবত তাদের কাউকে পুলিশ সেলে নিয়ে আসা হয়েছে রাতে আটক রাখার জন্য। বন্দিদের অনেকেই আবার আটক আছে জামিন পাবার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংকুলনা করতে না পারার জন্য।
এইসব মৃত্যুর দায় কি পুলিশের ওপর দেয়া যেতে পারে?
বর্তমানে ভিন্ন ভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তিনটি ক্রিমিনাল ট্রায়াল চলমান, যারা কিনা আদিবাসী মানুষদের হত্যার দায়ে অভিযুক্ত। যদিও ১৯৮০ সালের পর এগুলোই সম্ভবত সবচেয়ে দুর্লভ মামলা। কারাগারে আদিবাসী মৃত্যুর ঘটনাগুলোর সঙ্গে শুধু সহিংসতা, নির্মমতা ও পুলিশের অসাদাচরণই মূখ্য কারণ নয়। এর বাইরে আরো অজস্র কারণ রয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। ‘গার্ডিয়ান অস্ট্রেলিয়া ডাটাবেজ’ ১৯৯১ সাল থেকে প্রায় প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনাই পর্যবেক্ষণ করেছে। জানা গেছে, রয়্যাল কমিশন ৯৯টি মামলা তদন্ত করার পর পুলিশকে অভিযুক্ত করার মতো কোনো তথ্যপ্রমাণই দেখাতে পারেনি! তবে তদন্তটি পুরোপুরিভাবে কর্মকর্তাদের অপরাধ থেকে নিস্তার দেয়নি। তদন্তে তারা অন্তত এটি প্রমাণ করেছেন যে, কারাগারে বন্দি থাকা আদিবাসী মানুষদের দেখাশুনার নেয়ার ব্যাপারে তারা উদাসীন ছিলেন।
তাহলে আর দোষ কী?
অনেক ঘটনায় দেখা গেছে, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষেরা অস্ট্রেলিয়ার কারাগারে মারা গেছেন সিস্টেমেটিক অবহেলাজনিত কারণে। বেশিরভাগ কারাবন্দি আদিবাসী অপর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা, দায়িত্বশীলদের মনোযোগের অভাবজনিত কারণে মারা গেছেন। ৩০ বছর আগের কমিশন এবং বর্তমানের আইনজীবীরা আজ একবাক্যে স্বীকার করেন যে, বর্ণবাদী মনোভাব ও আচরণ এসব অবহেলা ও নিস্ক্রিয়তাকে তরান্বিত করে। তারা এ বিষয়েও একমত যে, বর্ণবাদী মনোভাবই পুলিশ কর্মকর্তাদের বন্দি অসুস্থ আদিবাসী মানুষদের সাহায্য করা অথবা চিকিৎসা সেবা দিতে তাদের দীর্ঘ গড়িমসি মনোভাব ও নিজেদের এড়িতে যেতে ভূমিকা রেখেছে।
সূত্র: বিবিসি
খুবই প্রশংসনীয় উদ্যোগ