ফিলিস্তিন: উপনিবেশবাদের একটি উন্মুক্ত জাদুঘর

0
7156
ফিলিস্তিন উপনিবেশবাদ
ছবি:সংগৃহীত

সাম্প্রতিক ফিলিস্তিন সফরে রামাল্লায় আমার এক ফিলিস্তিনি বন্ধু আমাকে তার সঙ্গে বেথলেহেম পর্যন্ত গাড়িতে করে যাবার আমন্ত্রণ জানায় (আমি জর্ডানীয় ফিলিস্তিনিদের একটি শ্রেণীর অন্তর্গত যারা ইসরায়েলের জারি করা আইডি কার্ড ব্যবহার করে ফিলিস্তিন পরিদর্শন করতে পারে)। ভ্রমণ শুরুর ত্রিশ মিনিট পর, আমরা একটি ইসরায়েলি চেকপয়েন্টে থামলাম, সামনে গাড়ির বিশাল লাইন । জায়গাটিতে কেমন যেন উদাসীন নীরবতা, এর থেকে বোঝা যায় যে সেখানে উপস্থিত বাকি সবার জন্য পরিস্থিতিটা কতটা স্বাভাবিক ছিল।

যাইহোক, আমার ধৈর্যের বাঁধ টুটে যাওয়ার পর আমি আমার বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম যে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিতে খুব বেশি সময় লাগবে কিনা। কিছুটা ব্যঙ্গাত্মকভাবে আমার বন্ধু উত্তর দিয়েছিল, ‘এটা ফিলিস্তিন- এখানে কখন চলাফেরা করতে হবে বা থামতে হবে তা তুমি অনুমান করতে পারবে না। এখানকার লোকেরা মিটিংয়ের সময় বলতে কী বোঝায় তা ভুলে গেছে। তুমি শেষমেশ যখন গিয়ে পৌঁছাবে সেটাই পৌঁছানোর সময়।’

পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের কাছেই এখন উপনিবেশবাদ মানে একটি সুদূর বিস্মৃত সময় । বিশ্বের জনসংখ্যার অধিকাংশেরই এই বিষয়ে প্রত্যক্ষ কোন অভিজ্ঞতা নেই এবং সম্পূর্ণ বৈদেশিক নিয়ন্ত্রণের অধীনে থাকার অর্থ কী তা অনেকেই কল্পনাই করতে পারে না। আজকের দিনে বিভিন্ন দেশে উপনিবেশিকতার জাদুঘর আছে, যেখানে গিয়ে মানুষ জানতে পারে কিভাবে এই শাসন ব্যাবস্থা এর বাসিন্দাদের বেঁচে থাকার, চলাফেরার, কথা বলার, কাজ করার এবং এমনকি শান্তিপূর্ণভাবে মারা যাওয়ার স্বাধীনতাকেও প্রভাবিত করতো। এখন আমরা একটি উত্তর-উপনিবেশিক বিশ্বে বাস করি (অনুমিতভাবে) এবং উপনিবেশিকতার জাদুঘরগুলি দর্শনার্থীদের একটি নিষ্ঠুর যুগে ফিরিয়ে নেয়ার কাজ করে, যা তাদেরকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উপর এই ধরনের শাসনের ক্ষতির একটি আভাস দেয়।

যাইহোক, কেমন হতো যদি আজ আমাদের পৃথিবীতে একটি এমন স্থান থাকে যেখানে উপনিবেশবাদ এবং উত্তর-উপনিবেশিকতা পাশাপাশি টিকে আছে। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও ঠিক এমনটাই ঘটে চলেছে ফিলিস্তিনে। 

উপনিবেশিকতা বিষয়ক জাদুঘর শিল্পের পেছনে দুঃখজনক ও প্রায় অসম্ভব অবদান রয়েছে ফিলিস্তিনের। উপনিবেশিকতার জাদুঘরগুলি যদি আধুনিক পরিবেশে অতীতকে কল্পনা করে, ফিলিস্তিন তাহলে উপনিবেশিকতার অতীত এবং বর্তমান উভয়কেই চাক্ষুষ দেখিয়ে দিচ্ছে। সেখানে একইসাথে সহাবস্থান উপনিবেশিক এবং উত্তর-উপনিবেশিক বাস্তবতার। ফিলিস্তিনে আলাদা করে উপনিবেশিকতার যাদুঘর তৈরির প্রয়োজন নেই, কারণ পুরো দেশটাই আসলে একটা জাদুঘরস্বরূপ। 

যেকোন যাদুঘরে যেমনটা বিভিন্ন থিমের বিভিন্ন বিভাগ থাকে, তেমনি ফিলিস্তিনেরও রয়েছে বিভিন্ন বিভাগ, যার প্রতিটি উপনিবেশিকতার একটি ভিন্নস্তর প্রদর্শন করে। ফিলিস্তিনের ওয়েস্ট ব্যাংকে আপনি দেখা পাবেন অবৈধ ইসরায়েলি বসতি, দখলকৃত জমি, একটি বিচ্ছেদ প্রাচীর এবং কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা। তারপর আছে গাজা, যেখানে উন্মুক্ত জাদুঘরের মতোই উন্মুক্ত কারাগারের দেখা মেলে, কেননা দুই মিলিয়ন ফিলিস্তিনি সেখানে ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইসরাইলি অবরোধের অধীনে বসবাস  করছে। সর্বোপরি যদি আপনি উপনিবেশিকতার একটি পরাবাস্তব ঘটনার উদাহরণ দেখতে আগ্রহী হন, তাহলে ইসরায়েলের দিকে যান, এবং খোঁজ নিয়ে দেখুন ইসরায়েলের ভিত্তি স্থাপনের পর ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনে অবস্থানরত ফিলিস্তিনিরা কীভাবে বেঁচে আছেন । সেখানে, আপনি জানতে পারবেন চুরি করা বাড়ি, ধ্বংস করা গ্রাম, দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ সম্পর্কে ।

ছাদখোলা বা ওপেন-এয়ার যাদুঘরগুলি দর্শনার্থীদের অতীতের জীবনযাপন কেমন ছিল তার সরাসরি অভিজ্ঞতা দিতে চায়। যখন আমি বিদেশী বন্ধুদের বলি যে, ওয়েস্ট ব্যাংকের (পশ্চিম তীরের) নাবলুস থেকে কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত আমার ক্ষুদ্র গ্রাম, বুরিনকে ঘিরে রয়েছে কেবলমাত্র বসতি স্থাপনকারীদের (সেটেলারদের) তৈরি রাস্তা, তখন তারা অবিশ্বাসের দীর্ঘশ্বাস তোলে। অনেকের কাছে, আমাদের সময়ে উপনিবেশিক যুগের অবস্থা কল্পনা করাও অসম্ভব, অথচ গত কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনে সেটা স্থায়ীভাবেই রয়েছে।

একবিংশ শতাব্দীর ফিলিস্তিনকে উপনিবেশবাদের উন্মুক্ত জাদুঘর হিসেবে স্বীকৃতি দিলে সেটা দীর্ঘদিনের ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দ্বন্দ্বতে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোকপাত করে। গাজায় সাম্প্রতিক যুদ্ধের সময়, ইসরাইলের কিছু সমর্থক এর শক্তি প্রয়োগকে বৈধতা দিয়ে উল্লেখ করেছিলো যে, যে কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের রকেট হামলার শিকার হলে এরকম প্রতিক্রিয়া জানানোই স্বাভাবিক। হামাস ইসরায়েলি ভূখণ্ডে রকেট ছুড়েছিল, তাই এই যুক্তি চলে, আর তাই ইসরায়েলের পাল্টা লড়াই করার অধিকার আছে।

এই গৎবাঁধা যুক্তি পরিস্থিতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা উপেক্ষা করে: গাজা কোন রাষ্ট্র নয়। ওয়েস্ট ব্যাংকও কোন রাজ্য নয়। আসলে ফিলিস্তিনিদের কোন রাষ্ট্র নেই। ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যে দ্বন্দ্বের সমান নয়। বরং, এটি একটি উপনিবেশ শাসিত মানুষ এবং তাদের উপনিবেশকারীর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব।

ফিলিস্তিনের অবস্থার বিশেষত্ব বোঝার জন্য এর ব্যাপারে প্রশ্ন করা অপরিহার্য। বিশ্বের কাছে ফিলিস্তিন একটি ধাঁধা। এতদিন ধরে কিভাবে ফিলিস্তিনিরা এমন একটি পরিস্থিতির মধ্যে আটকে আছে যা আপাতদৃষ্টিতে অপরিবর্তনীয়, স্থির এবং বিভ্রান্তিকর? রাষ্ট্রহীনতা, উচ্ছেদ, শরণার্থী এবং প্রতিরোধ এর মতো শব্দগুলো কার্যত ফিলিস্তিনিদের স্থায়ী পরিচায়ক হয়ে উঠেছে। ফিলিস্তিনি এবং ইসরায়েলিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আমাদের আধুনিক সাউন্ডস্কেপের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে – সেখানে সবসময় কিছু না কিছু ঘটে চলেছে, এবং যা ঘটছে তা কখনোই এর অবস্থায় কোন গুরুতর পরিবর্তন আনবে না।

ফিলিস্তিনকে প্রায়ই একটি স্থায়ী দ্বিধা হিসাবে দেখা হয়, যার সমাধান দীর্ঘকালের জন্য আটকে আছে, কারণ ফিলিস্তিন আসলে ধাঁধার থেকেও বেশি, যেন একটি অসঙ্গতি। ফিলিস্তিনিরা উপনিবেশিক যুগের ঐতিহাসিক ক্রম উপভোগ করতে পারেনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, সাবেক উপনিবেশের গল্পটি একটি রৈখিক পথ অনুসরণ করে আসছে: উপনিবেশবাদ, উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রাম, এবং তারপর স্বাধীনতা-একটি নতুন জাতি-রাষ্ট্র। এই প্যাটার্নটি এত জোরালো ছিল এবং উপনিবেশবাদের পরাজয় এত সফল ছিল যে গত কয়েক দশক ধরে বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধানের একটি শক্তিশালী নতুন ক্ষেত্রের উত্থান ঘটেছে যাকে যথাযথভাবে ‘পোস্ট-কলোনিয়াল স্টাডিজ’ বলা হয়। হাস্যকরভাবে, এই ক্ষেত্রের গ্র্যান্ড মাস্টার ছিলেন একজন ফিলিস্তিনি – প্রয়াত এডওয়ার্ড সাইদ।

ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। জর্ডান, ইরাক এবং সিরিয়ার মতো মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য জাতির মতো ফিলিস্তিন ব্রিটিশ বা ফরাসি ম্যান্ডেটের সমাপ্তি দেখেনি যা একটি স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র গঠনের দিকে পরিচালিত করবে। বরং, ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অবসান প্রকৃতপক্ষে সেখানে উপনিবেশিকতার অন্য রূপ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

ইহুদিবাদী (জিয়োনিস্ট) আন্দোলন, সফলভাবে ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের পথের রৈখিক অগ্রগতি থামিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলো (যা পরবর্তীতে ইসরাইল গঠন করবে এবং যার ফলে ফিলিস্তিনি সমাজ ধ্বংস হবে এবং ফিলিস্তিনের জাতিগত নিধন হবে- এই ঘটনাবলি ফিলিস্তিনের ইতিহাসবিদ্যায় নাকবা বা বিপর্যয় নামে পরিচিত)। ১৯৪৮ সালের আগে এবং পরে, ফিলিস্তিনিরা প্রথমে ব্রিটিশ এবং তারপর জিয়োনিস্ট উপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে চলেছে। তাদের এই সংগ্রাম; সাম্রাজ্যবাদের নিজস্ব সুনির্দিষ্ট বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা বর্জন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন বাস্তবায়নের।

মোদ্দাকথা, ফিলিস্তিনিরা এখনও উত্তর উপনিবেশিক বিশ্ব ব্যবস্থায় প্রবেশ করতে পারেনি। ব্যক্তি হিসাবে, তারা একবিংশ শতাব্দীতে বাস করে, কিন্তু একটি রাষ্ট্রহীন জাতি হিসাবে, তারা এখনও ১৯৪৮-পূর্ব উপনিবেশিক মুহূর্তে বন্দী। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোসেফ মাসাদ এটিকে চিহ্নিত করেছেন ফিলিস্তিনের বর্তমান সময়ের সাথে অসঙ্গতি হিসেবে। ফিলিস্তিনকে ‘উত্তর-উপনিবেশিক উপনিবেশ’ বলা যায়,  এমন একটি অঞ্চল যেখানে দুটি সময়, দুটি বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি, দুটি যুগ, প্রচণ্ডভাবে সংঘর্ষের মুখোমুখি। এই কারণেই এটি উপনিবেশবাদের একটি উন্মুক্ত জাদুঘর হিসাবে কাজ করে- এটি একইসঙ্গে অতীত এবং বর্তমান, উপনিবেশিকতার শোষণমূলক নীতি এবং চর্চা যেখানে চিরস্থায়ী প্রদর্শনীতে সাজানো।

ফিলিস্তিনকে শুধুমাত্র একটি মানবাধিকার ইস্যু হিসেবে দেখা বিপজ্জনক- এটি তার থেকেও বেশি। ফিলিস্তিনিরা উপনিবেশিকতার একটি জীবন্ত প্রদর্শনী। তারা একই সঙ্গে উত্তর উপনিবেশিক আদেশের অন্তর্গত কিন্তু অবার অন্তর্ভুক্ত নয়। তাদের জন্য, ১৯৪৮ কেবল একটি স্মৃতি নয় – এটি একটি চলমান বাস্তবতা, সময়ের একটি মুহূর্ত যা তারা কী, এবং তারা কী নয় তা নির্ধারণ করতে প্রসারিত হয়ে চলেছে। ফিলিস্তিনকে নির্মমভাবে উপনিবেশিকতার এমন একটি স্থায়ী যাদুঘরে পরিণত করা হয়েছে যার দরজা অনেক আগেই বন্ধ করা উচিত ছিল।

লেখক: ওমর খলিফা, সহযোগী অধ্যাপক, আরবি সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, জর্জটাউন ইউনিভার্সিটি, কাতার। সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরা’য় প্রকাশিত নিবন্ধটি ভাষান্তর করেছেন অনন্যা দাশ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here