ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা যেভাবে বাংলায় দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছিল

0
650

এই ট্র্যাজেডির মাত্রা বোঝা প্রায় অসম্ভব। যদি মৃতদেহগুলো লম্বালম্বিভাবে লাইন ধরে সাজানো হয়, তবে তা হবে ইংল্যান্ডের দৈর্ঘ্যের সমান এলাকা, ডোভার থেকে স্কটিশ সীমান্ত পর্যন্ত, প্রায় ১০ বার ঘুরে আসবে

বাংলার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর নৃশংস দুর্ভিক্ষের ঘটনাটি ঘটেছিল তৎকালীন ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন  চলাকালীন।  ১৯৪৩ সন থেকে ১৯৪৪ সন পর্যন্ত চলা এই দুর্ভিক্ষের ফলে তিরিশ লাখেরও বেশি ভারতীয় অনাহার এবং অপুষ্টিতে মারা গিয়েছিল এবং আরও লক্ষ লক্ষ মানুষ কঠোর দারিদ্র্যের মধ্যে পড়েছিল। এই ঘটনার দায়ভার ব্রিটিশরা বহু বছর ধরে অস্বীকার করে আসছে।

তারা দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী করে আসছে আবহাওয়া এবং খাদ্যের ঘাটতিকে। যেন ঘটনাটি নিছক একটি অনিবার্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিলো। তবে আজ বেশিরভাগ গবেষকই একমত যে, এই সঙ্কটটি ছিল মানবসৃষ্ট আর এর কারণ ছিলো, যুদ্ধকালীন প্রাথমিক মুদ্রাস্ফীতি, যা পরবর্তীতে খাদ্যের দামকে নাগালের বাইরে ঠেলে দিয়েছিলো। 

ব্রিটেনের বিরুদ্ধে সেসময় দুর্ভিক্ষ নিরসনের জন্য যথেষ্ট কাজ না করার অভিযোগ রয়েছে বহু আগে থেকেই। কিন্তু অর্থনীতিবিদ উত্সা পট্টনায়েক এর সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে নতুন ও চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।

উত্সা পট্টনায়েক এর গবেষণা থেকে জানা যায়, তখনকার মুদ্রাস্ফীতিটা আদতেই আনুষঙ্গিক ছিল না বরং সেটি ছিলো একটি ইচ্ছাকৃত নীতি, যেটা ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড প্রস্তাব করেছিল এবং উইনস্টন চার্চিল প্রয়োগ করেন। এই নীতি অনুযায়ী দরিদ্রতম ভারতীয়দের আরো দারিদ্রের দিকে ঠেলে দেয়া হয়। আর তাদের থেকে আহরিত সম্পদ কাজে লাগে ব্রিটিশ ও আমেরিকান সৈন্যদের যুদ্ধ-সম্পর্কিত কার্যক্রমের সমর্থনে। 

১৯৪০-এর দশকে আসলে কী ঘটেছিল সেটা বুঝতে গেলে উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, ঘটনাটা আসলে প্রায় দুই শতাব্দীর ঔপনিবেশিক লুণ্ঠনের ফল। ১৭৬৫ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার আজকের দিনের হিসাবে প্রায় লক্ষ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য আহরণ করেছিল ভারত থেকে। সেই পণ্য হয় ব্রিটেনে ব্যাবহৃত হয়েছিল বা লাভের আশায় পুনরায় রপ্তানি করা হয়েছিল৷ এই লাভের অংক থেকে ব্রিটেনে রাস্তা, কারখানা এবং জনসেবামূলক স্থাপত্যসহ দেশীয় অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি পশ্চিম ইউরোপ এবং ব্রিটিশ বসতি স্থাপনকারী উপনিবেশগুলির শিল্পায়নে অর্থায়ন হয়েছিল। গ্লোবাল নর্থের অর্থায়ন বেশিরভাগই করা হয়েছিল ঔপনিবেশিক শোষণের মাধ্যমে। 

ক্ষুধার নীলনকশা

ভারতীয়দের জন্য ঔপনিবেশিক লুণ্ঠন ছিল ধ্বংসাত্মক। এটির তীব্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, ভারতের মাথাপিছু খাদ্যশস্যের ব্যবহার ১৯৩০-এর দশকের শেষ নাগাদ বছর প্রতি ১৫৭ কিলোগ্রামে নেমে আসে। অথচ ১৯০০-এর দশকের গোড়ার দিকে সেটা ছিলো বছর প্রতি ২১০ কিলোগ্রাম। এই ঘটনাকে পট্টনায়েক ‘গুরুতর পুষ্টির অবনতি’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যা ঘটেছিল তা এই পরিস্থিতিকে আরও বাড়িয়ে তোলে। জাপানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানোর জন্য মার্কিন ও ব্রিটিশ সৈন্যরা বাংলায় এসে জড়ো হলে ঔপনিবেশিক সরকার আদেশ দেয় যে, বিদ্যমান শোষণ ব্যবস্থার পাশাপাশি সেই অঞ্চলের মিত্রবাহিনীর কার্যকলাপের সমস্ত খরচ ভারতীয় সম্পদ ব্যয়েই বহন করা হবে, যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত।

চার্চিল এবং চ্যান্সেলর অফ দ্য এক্সচেকারের ভারতীয় আর্থিক ও মুদ্রানীতির বিশেষ উপদেষ্টা কেইনস যুদ্ধকালীন তহবিল কৌশলের পরিকল্পনায় সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি সামরিক সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করার জন্য স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার একটি ব্যবস্থা তৈরি করতে চেয়েছিলেন।

এর একটি উপায় হতে পারতো ধনী ব্যক্তিদের উপর কর আরোপ করা। কিন্তু সেজন্য যথেষ্ট পরিমাণে ধনী ব্যক্তি তখন ছিলো না। ফলে বিকল্পটি ছিল সাধারণ মানুষদের উপর কর আরোপ করা। কিন্তু কেইনস জানতেন যে, জনসংখ্যার উপর যেকোনো প্রত্যক্ষ কর আরোপ করা হলে তা দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটাতে পারে।

তাই তিনি পরোক্ষভাবে কর আদায়ের একটি প্রস্তাব দেন, ইচ্ছাকৃত মুদ্রাস্ফীতি নীতির মাধ্যমে। বুদ্ধিটা ছিলো এমন-১৯৪০-এর দশকে, ঔপনিবেশিক সরকার সামরিক ব্যয়ের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ছাপিয়েছিল। ফলে দাম বেড়ে গিয়েছিল সবকিছুর, বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের।

চালের দাম বেড়েছিল ৩০০ শতাংশ। কিন্তু সেই অনুযায়ী মজুরি না বাড়ানোর কারণে, সাধারণ মানুষ আরও দরিদ্র হয়ে পরছিলো, তাদের খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যের ব্যবহার নাটকীয়ভাবে কমাতে বাধ্য হয়ে গিয়েছিলো। এদিকে, মূল্যস্ফীতির ফলে ব্যবসার মালিকরা যেটুকু অতিরিক্ত মুনাফা করেছিল, সেটা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র দ্বারা কর আরোপ করা নিয়ে নেয়া হতো।

মুদ্রাস্ফীতি এবং এর ফলে হওয়া দারিদ্র কোন দুর্ঘটনা ছিল না। ব্রিটিশ নীতিটি স্পষ্টভাবে ‘দরিদ্রদের ভোগ কমানোর’ জন্য পরিকল্পিত হয়েছিল। যেমনটি কেইনস বলেছেন, ব্রিটিশ এবং আমেরিকান সৈন্যদের জন্য সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সামরিক বাহিনীর কাছে ‘বলপূর্বক ক্রয় ক্ষমতা হস্তান্তরের’ মাধ্যমে সংস্থানগুলি উপলব্ধ করার জন্য।

বাংলার জনগণের উপর কঠোরভাবে এই নীতি আরোপ করা হয়েছিল, ফলে তারা চরম দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়েছিল। তাদের ভাগের খাদ্য সরবরাহ সামরিক ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল। মিত্রশক্তির দোহাই দিয়ে কেইনস এবং চার্চিলের আরোপিত নীতিগুলি ত্রিশ লক্ষেরও বেশি লোকের মৃত্যুর কারণ হয়েছিলো, সংখ্যাটা ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্মিলিত যুদ্ধে মোট সামরিক ও বেসামরিক হতাহতের সংখ্যার চেয়ে বহুগুণ বেশি।

এই ট্র্যাজেডির মাত্রা বোঝা প্রায় অসম্ভব। যদি মৃতদেহগুলো লম্বালম্বিভাবে লাইনধরে সাজানো হয়, তবে সেটা ইংল্যান্ডের দৈর্ঘ্যের সমান এলাকা, ডোভার থেকে স্কটিশ সীমান্ত পর্যন্ত, প্রায় ১০ বার ঘুরে আসবে। 

এই সংকটের সময়, ভারতের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা চার্চিলের কাছে সাহায্য পাঠাতে অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু তাদের অনুরোধ বারবার প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। উল্টো তাদের কর্মকাণ্ড ছিলো সাহায্যের সম্পূর্ণ বিপরীত: ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত, আজকের দিনের মুদ্রায়, প্রায় ১৫শ কোটি পাউন্ড এর নিজস্ব অভ্যন্তরীণ ব্যয়ের জন্য ভারত থেকে আহরণ করেছে।

কেইনস এবং চার্চিলের আরোপিত নীতিগুলি ত্রিশ লক্ষেরও বেশি লোকের মৃত্যুর কারণ হয়েছিলো, সংখ্যাটা ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্মিলিত যুদ্ধে মোট সামরিক ও বেসামরিক হতাহতের সংখ্যার চেয়ে বহুগুণ বেশি

পট্টনায়েক উল্লেখ করেছেন যে, যুদ্ধ প্রচেষ্টার নামে এই হস্তক্ষেপকে সমর্থন করা যায় না। কেইনস এবং চার্চিল ঔপনিবেশিক জনগণের কাছ থেকে খাদ্য এবং অন্যান্য সংস্থানে বরাদ্দ দিয়ে মিত্রশক্তির ক্রিয়াকলাপে অর্থায়ন করেছিলেন। এক্ষেত্রে জনগণের কোন বক্তব্য দেয়ার উপায় ছিলো না। এই অর্থসংস্থান তারা চাইলেই অন্য উপায়ে করতে পারত। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন তাদের নিজস্ব সম্পদ ব্যবহার করতে পারত, যার জন্য তাদের দেশের নাগরিকদের জনপ্রতি ১ পাউন্ড বেশি কর দিতে হতো।

কলঙ্কিত উত্তরাধিকার

এই ইতিহাস আমাদেরকে এমন সব ব্যক্তিত্বের সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শেখায়, যারা আজ বিশ্বের চোখে নায়ক। এটা অনেক আগেই বোঝা গেছে যে, চার্চিল শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেতেন।

১৯০২ সালের একটি সাক্ষাতকারে, তিনি দাবি করেছিলেন, ‘বর্বর দেশগুলির’ উপর ‘আর্যরা বিজয়ী হতে বাধ্য’। তিনি ভারতীয়দের একটি ‘অমার্জিত জাতি’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন, একটি ‘পশুতুল্য ধর্মানুসারী পশুর ন্যায় মানুষজন’।

২০২০ সালের ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার বিক্ষোভের সময়, ওয়েস্টমিনস্টার থেকে চার্চিলের মূর্তি সরানোর আহ্বান জানানো হয়েছিল। বরিস জনসন, চার্চিলের একজন প্রশংসক, এই বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যে, আমাদের ব্রিটেনের ইতিহাস ‘সম্পাদনা’ করা উচিত নয়। যদি তাই হয়, তবে আমাদের নিশ্চিত করা উচিত যে, চার্চিলের ইতিহাসের সম্পূর্ণটা লোকে জানে – এবং তার প্রতিটি মূর্তির পাশাপাশি একটি স্মারক স্থাপন করা উচিত ত্রিশ লক্ষ ভারতীয়দের জন্য যারা তার প্রণীত নীতির কারণে নিহত হয়েছিল এবং যাদের কাছে মিত্রবাহিনীর বিজয় চূড়ান্তভাবে ঋণী।

কেইনস এর ইতিহাস আরো জটিল। তাকে আজ সবাই চেনে একজন প্রগতিশীল হিসেবে; কিন্তু তিনি ছিলেন একজন সাম্রাজ্যবাদীও, যিনি নিজেদের ভালোর জন্য ‘অধিভুক্ত জাতি’র উপর শাসন করার জন্য ‘হোয়াইট ম্যানস বারডেন’ বা সাদা মানুষের দায় -এর আখ্যান প্রচার করেছিলেন।

কেইনস ঔপনিবেশিক ভারত শাসনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন এবং ১৮৫৭ সালের ভারতীয় বিদ্রোহের নিন্দা করেছিলেন। যখন তিনি ১৯৪৪ সালে বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল গঠন করেন, তখন তিনি নিশ্চিত করেন যে, ভারত এবং অন্যান্য উপনিবেশগুলি অসম শর্তে সেখানে যুক্ত হতে পারে, যাতে করে ভোটিং ক্ষমতার যতখানি ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে থাকবে তার একটি ভগ্নাংশমাত্র থাকবে তাদের হাতে। এই ব্যবস্থা আজ অবধি রয়ে গেছে।

পট্টনায়কের গবেষণা বাংলার দুর্ভিক্ষ ঘটাতে কেইনসের ভূমিকা প্রকাশ করে তার চরিত্রের এই দিকটি আরো স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। এটি এমন একটি অপরাধ যা প্রকাশ্যে আসা প্রয়োজন।

এই ইতিহাসের আলোকে ব্রিটেনের কী করা উচিত? অবশ্যই ক্ষমাপ্রার্থনা – যা আজ পর্যন্ত কখনও তারা করেনি। কিন্তু সেটাও ক্ষতিপূরণের জন্য যথেষ্ট নয়। জার্মানি যদি শোহ এবং হেরো-নামা গণহত্যার জন্য ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করতে পারে তবে ব্রিটেন একই কাজ কেনো করবে না?

সূত্র: নিউ ইন্টারন্যাশনালিস্ট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here