লেবাননের গুরুত্বপূর্ন শহর ত্রিপোলির উত্তরে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবির বেদদাউই। আশ্রয়শিবিরটিতে ব্যাপক হারে চোখে পড়বে মাদকের ভয়াবহতা। অ্যামফিটামিন নামক ওষুধের অপব্যবহার হচ্ছে এখানে হরহামেশাই।
২৪ বছর বয়সী মোহাম্মদ, শরণার্থী শিবিরের রাস্তার নিচে এক আবর্জনা স্তূপের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। ‘এখানে কোনো কাজ নেই, টাকা নেই, জ্বালানি নেই, সামান্য খাবারও নেই, কিন্তু এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে মাদক,’ হাবলেশহীন দৃষ্টি নিয়ে কথাগুলো বলে যাচ্ছেন এই যুবক।
লেবাননের এই জায়গাটিতে এক বর্গকিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার শরণার্থী বসবাস করছে, যাদের বেশিরভাগই ফিলিস্তিনি। ভেঙ্গে যাওয়া জীর্ণ শীর্ণ এই ঘিঞ্জি ঘর বাড়িগুলি যেন একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য একে অন্যের সঙ্গে লড়াই করে দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলো এত কাছাকাছি ঠেসে থাকার কারণে নীচের রাস্তায় আলো ঢুকতে পারে না, ছায়ায় ঢেঁকে থাকে।
মোহাম্মদের বন্ধু লুয়ে ঈদ, হাত নেড়ে, মৃদু হেসে, গুরুত্ব সহকারে বলতে থাকে ‘যখন কোনও উপার্জন নেই, তখন জীবনেরও মানে নেই।’ তাই, মানুষের কাছে শুধু মাদক আছে।’
তিনি বলতে থাকেন ‘এই প্রবণতা শুরুতে যুবকদের মধ্যেই ছিল। ‘কিন্তু এখন বয়স্ক পুরুষেরা, শিশুরা এবং নারীও মাদক সেবন এবং বিক্রি করছে।’
রাস্তার আরও নিচে, একটি শিশু, দেয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে, জ্বলজ্বল চোখে আকাশের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। সে নড়ছে না, কোনো প্রশ্নের উত্তরও দিচ্ছে না। মোহাম্মদ তার দিকে ইশারা করে যেন বলছে ‘ওখানে, তুমি কি কিছু দেখতে পাচ্ছ?’
লেবানন ২০১৯ সাল থেকে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক এই সংকটকে আধুনিক সময়ের সবচেয়ে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি হিসাবে বর্ণনা করেছে। লেবানিজ পাউন্ডের মান একবারেই ধসে পড়েছে, যার ফলে উচ্চ মাত্রার মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছে। মজুরি, পেনশন এবং সঞ্চয়ের মূল্য বাষ্পীভূত হয়ে গেছে। জনসংখ্যার অন্তত ৭৫ শতাংশ দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে।
এই সংকট সারা দেশে জীবনযাত্রার মানে বিধ্বংসী প্রভাব ফেলেছে। জ্বালানি খাত পঙ্গু হয়ে পড়েছে, যার অর্থ হল যে বেশিরভাগ বাড়ি দিনে মাত্র দুই ঘন্টা বা তার বেশি রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ সেবা পাচ্ছে। গুটিকয়েক সামর্থ্যবান মানুষ ব্যক্তিগত জেনারেটরের মাধ্যমে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাচ্ছে। কিন্তু জ্বালানি আরও দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাওয়ায় এগুলো চালানো অত্যধিক ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে।
ক্যাপ্টাগন নামে একটি নকল ওষুধের ব্র্যান্ড অ্যামফিটামিনের উপর বিভিন্ন নাম বসিয়ে শরণার্থী শিবিরগুলোতে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই মাদক অবিশ্বাস্যভাবে সস্তায় কিনতে পাওয়া যায়। এটি সেবনের ফলে শরীরের শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং এক ধরনের উচ্ছ্বলতা জাগিয়ে তোলে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন,২০১১ সালে সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে যখন সিরিয়ানরা লেবাননে আসতে শুরু করে তখন সমস্যাটি আরও বেড়ে যায়। কারণ কিছু সিরিয়ান ছিল, যারা আগে থেকেই এই মাদকটি উৎপাদনের কৌশল বেশ ভালোভাবে রপ্ত করেছিল।
আহমেদ হাসান বেদদাউই ক্যাম্পের প্রধান সড়কে একটি ছোট ফার্মেসি চালান। তিনি বলছিলেন, ‘তরুণদের জন্য কোন কাজ নেই। কোন ওষুধের ব্যবস্থা নেই এবং খাবার দাম ও অনেক বেশি।’
লেবাননে ক্রমবর্ধমান ভীতিকর ও দুর্বিষহ জীবনযাপনের পরিস্থিতির সত্ত্বেও তিনি অন্যদের মতো, অ্যামফিটামিনকে প্রধান উদ্বেগ হিসাবে উল্লেখ করেছেন।
আরো পড়ুন
▪মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অঞ্চলের মানুষ কীভাবে মানসিক বিপর্যয় মোকাবেলা করছে?
তিনি বলেন ‘এখানে একটি পিলের দাম ৭ হাজার লেবানিজ পাউন্ড, যা লেবাননে একটি পেপসির ক্যানের সমান দাম। কালো বাজারের বিনিময় হার অনুসারে মাদকটির দাম মোটামুটি ৩৫ সেন্ট এর সমতুল্য। অর্থাৎ এটি কিছু খাবারের চেয়েও সস্তা।
কোনো পুনর্বাসন কেন্দ্র নেই
লেবানন ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে একটি বৃহৎ ফিলিস্তিনি জনসংখ্যাকে আশ্রয় দিয়েছে। ১৯৪৮ সালে ইহুদি মিলিশিয়া বাহিনী দ্বারা বিতাড়িত হয়ে, তারা লেবাননে আশ্রয় নেয়।
ইউএনআরডব্লিউএ-এর মতে, সমগ্র অঞ্চল জুড়ে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করছে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা। লেবাননে চার লাখ ৭৯ হাজারেরও বেশি নিবন্ধিত ফিলিস্তিনি রয়েছে – যদিও সাম্প্রতিক সমীক্ষায় প্রকৃত সংখ্যা আড়াই লাখের কাছাকাছি, কারণ অনেকেই এখান থেকে পালিয়েছে।
এসব ফিলিস্তিনিরা সবসময়ই অনিশ্চিয়তার মধ্যে বসবাস করেন। ফিলিস্তিনিদের কাজ করার অধিকারের সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং আনুষ্ঠানিক নাগরিকত্ব না থাকায় স্বাস্থ্যসেবা বা ভ্রমণের ক্ষেত্রেও জটিলতায় পড়তে হয়। ক্যাম্পগুলি দীর্ঘকাল ধরে জণাকীর্ণতা, উচ্চ দারিদ্র্যের হার এবং সহিংসতার শিকার হয়েছে। এ সবই বর্তমান সংকটের কারণে আরো গুরুতর হচ্ছে।
আহলাম চালাবি, আনেরা নামক একটি এনজিও এর এরিয়া ম্যানেজার, যিনি লেবানন এবং ফিলিস্তিনের হতদরিদ্র সম্প্রদায় নিয়ে কাজ করেন। তিনি অনুধাবন করছেন, ফিলিস্তিনিদের পাশাপাশি সিরীয় ও লেবাননের স্থানীয় জনগণ আজ যে পরিস্থিতির মুখোমুখি, তা এককথায় অপ্রতিরোধ্য।
‘আমরা জানি না আগামীকাল কি হবে। খুব কঠিন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এই শিবিরে বসবাসকারীদের জন্য পর্যাপ্ত কোনো সংস্থান নেই।’
তিনি বলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে অনেকের জীবনযাপনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে মাদক। কিন্তু এই বিষয়ে কেউ কাজ করছে না, আসক্তদের জন্য কোনো পুনর্বাসন কেন্দ্র নেই।’
লেবাননের নিরাপত্তা বাহিনী শিবিরের উপর সতর্ক নজর রাখে – কিছু ক্ষেত্রে, তারা পাহারা দেয়, কিন্তু তারা শিবিরে প্রবেশ করে না। শিবিরের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সশস্ত্র দল দ্বারাই সেখানের সবকিছু পরিচালিত হয়।
আহলাম চালাবি বলছিলেন, ‘আমরা এখন সবাই সমান। এটিই সত্য যে, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর পটভূমি যাই হোক না কেন, গুরুতর দারিদ্র্য এখন উত্তর লেবাননের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে প্রভাবিত করছে।
মিডলইস্ট আই অবলম্বনে