ধরিত্রীর সুরক্ষার প্রশ্নে যেখানে বিনা বাক্যে একমত হওয়ার কথা বিশ্ব নেতৃবৃন্দের, সেখানে নিজ স্বার্থ ঠিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা দেখা গেল স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয় অনুষ্ঠিত কপ২৬ জলবায়ু সম্মেলনে। যেকারণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা করে পৃথিবীকে রক্ষায় একমত হওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বনেতাদের সময় লাগলো বাড়তি একদিন। তবে আশার কথা হলো, বিশ্ব নেতাদের জটিলসব হিসাব-নিকাশ আর যুক্তি তর্কের পরিসমাপ্তিতে শেষ পর্যন্ত পৌঁছানো গিয়েছে কয়েকটি সিদ্ধান্তে।
মোটা দাগে বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তির প্রধান অর্জন হিসেবে উঠে এসেছে কয়েকটি বিষয়-জলবায়ুর বিপর্যয় ঠেকাতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রিতে সীমাবদ্ধ রাখার অঙ্গীকার, কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি ও উন্নয়নশীল দেশগুলির জন্য আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধির অঙ্গীকার।
এখন প্রশ্ন হলো, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রথম সারিতে থাকা বাংলাদেশের জন্য এই অর্জন কতোটা সুফল বয়ে আনবে? গ্লাসগোর প্রতিশ্রুতির হাওয়া বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের চরম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যে কি পরিবর্তন আনবে?
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় একটি গ্রামের বাসিন্দা আবদুস সাত্তার। চোখের সামনে যেন তিনি প্রতিদিনই দেখতে পান, সমুদ্র থেকে ধেয়ে আসা একেকটি ঢেউ তার জীবনকে একটু একটু করে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বন্যতোলা গ্রামের কর্দমাক্ত রাস্তা ধরে এগিয়ে চললে দেখা মেলে আবদুস সাত্তারের বসতবাড়ি।
গ্রামটিতে একসময় ২ হাজার মানুষের বসবাস ছিল। এখানে বসবাসরতদের বেশিরভাগই ৫৪ বছর বয়সী আবদুস সাত্তারের মতো কৃষক ছিলেন। একটা সময় ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকা সমুদ্রের নোনা পানি তাদের গ্রামটির মাটিকে বিষাক্ত করে তোলে।
গত দুই বছরে দুটি ঘূর্ণিঝড় এখানকার মাটির বাঁধগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এই বাঁধগুলোই মূলত জোয়ারের ঢেউ থেকে গ্রামটিকে রক্ষা করেছিল। বর্তমানে এই গ্রামে সাকুল্যে ৪৮০ জন মানুষ অবশিষ্ট আছেন। বাকিরা সমুদ্রের তাণ্ডবে গৃহহীন হয়েছেন।
সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট এর প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ শামসুদ্দোহা বলেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে-বিশেষ করে মাত্রারিক্ত ঘুর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের কারণে সমুদ্রের নোনা পানি উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক হারে প্রবেশ করেছে। এর ফলে দেশের স্থলভাগের একটা বৃহত্তর অংশ বিনষ্ট হয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন-জীবিকা হারিয়েছে। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়।’
তিনি জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এভাবে চলতে থাকলে দেশের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে প্রায় ৩০ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যূত হতে পারে।
শ্যামনগর উপজেলার আরেকটি ইউনিয়ন গাবুরা। এখানে বসবাস করেন নাজমা খাতুন (৪৩)। তিনি তার দুই মেয়ের মুখে দুবেলা ভাত তুলে দিতেই হিমশিম খাচ্ছেন। কাপড় সেলাই ও বিক্রি করে তিনি প্রতিদিন গড়ে প্রায় দুইশত টাকার মতো রোজগার করেন। যার অর্ধেকটাই আবার চলে যায় চর্মরোগের ঔষুধ কেনার পেছনে।
তিনি জানান, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে জমি ও পানি দূষিত হচ্ছে, এর ফলে তাদের গ্রামের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ‘আমাদের চারপাশে পানি আছে। কিন্তু পুকুর বা কূপ থেকে পান করার জ্যন্য আর এক ফোঁটা পানিও অবশিষ্ট নেই’-বলছিলেন নাজমা খাতুন।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নাজমা খাতুন বলে চলেন, এই জমি এক সময় উর্বর ছিল। আম-কাঁঠাল ফলতো, প্রত্যেকে বাড়ির উঠোনে সব্জি চাষ করতো। খাবার পানির জন্য পুকুর, নদী ও কূপই ছিল ভরসা। ‘যা কিনা এখন অসম্ভব। এখানে পুকুরগুলো দেখুন, বিশুদ্ধ পানিতো উধাও হয়ে গেছে’।
১৯৭৩ সালে ৮ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর (৩,২১৬ বর্গ মাইল) ভূমি সমুদ্রের পানির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। মূলত সেসময় বারবার ঘুর্ণিঝড় ও স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত জোয়ারের কারণে বিশুদ্ধ পানিব্যবস্থা বিনষ্ট হয়েছিল।
বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের মতে, এই বৃদ্ধির পরিমাণ ২০০০ সালে ১ দশমিক ২ মিলিয়ন হেক্টর (৩,৯৩৮ বর্গ মাইল) এবং ২০০৯ সালে ১ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন হেক্টরে (৪,০৭৭ বর্গ মাইল) গিয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি আরো তথ্য দিয়ে বলছে, গত ৩৫ বছরে মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ ২৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বনবিবি তলা গ্রামে নারীরা প্রতিদিনই হস্তচালিত টিউবওয়েল থেকে রান্না ও খাবার পানি সংগ্রহ করতে যান। পানি সংগ্রহ করতে তাদের প্রতিদিন ৪ কিলোমিটার (২.৫ মাইল) পথ হাঁটতে হয়।
দুঃখের বিষয় হলো, এত দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে পানি সংগ্রহ করার সামর্থ্যও হয়তো আগামীতে আর দীর্ঘস্থায়ী হবে না। এই অঞ্চলের টিউবওয়েলগুলিতে শুধু বর্ষাকালের কয়েক মাসই খাবার পানি পাওয়া যায়। গ্রীষ্মকালে যখন নদীর প্রবাহ কমে যায় তখন সাধু পানির সংকট দেখা দেয়। মহেশ্বরী হালদার নামে একজন নারী নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এসব কথা বলছিলেন। তিনি বলেন ‘এই দুর্ভাগ্যের কাছে আমরা সবাই আত্মসমর্পণ করেছি।’
প্রতি বছর বাংলাদেশের মোট অভ্যন্তরীন উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাবে নষ্ট হয়ে যায় এবং আগামী দশকে তা ৯ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।
এবার আসা যাক, কপ২৬ জলবায়ু চুক্তির অর্জননামা বিষয়ে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রিতে সীমাবদ্ধ রাখার অঙ্গীকার করলেও তা কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব তা নিয়ে সন্দিহানও বিশ্লেষকরা।
ফ্রেন্ডস অফ ডি আর্থ ইন্টারন্যাশনাল এর প্রতিনিধি সারা শ বলেন যে, এই জলবায়ু চুক্তিটির ফলাফল একটি কেলেঙ্কারির চেয়ে কম কিছু নয়’
‘তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রী কমানোর প্রতিশ্রুতি অর্থহীন, কারণ এখানে প্রতিশ্রুতি রক্ষার কোনো স্থায়ী বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি। তিনি বলেন, কপ২৬ বিশ্বব্যাপী দক্ষিণ অঞ্চলের জন্য একটি বিশ্বাসঘাতকতা বৈ আর কিছু না।
চুক্তিতে কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও শেষ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের আহ্বান জানায় ভারত ও চীন। তাদের পক্ষ থেকে কয়লার ব্যবহার ‘ফেজ আউটের’ পরিবর্তে ‘ফেজ ডাউন’ করার কথা বলা হয়। শেষ পর্যন্ত তা অনুমোদন পেলেও বাংলাদেশের জন্য এটা মোটেই সুখকর নয়। যদিও কয়লাভিত্তিক ১০টি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
এবার আসা যাক, আর্থিক হিসাব নিকাশে। উন্নয়নশীল দেশগুলিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ধনী দেশগুলো ২০২০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক জলবায়ু তহবিল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু তা পূরণ করতে পারেনি।
বাংলাদেশভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পরিচালক সালেমুল হক সাম্প্রতিক একটি তথ্যচিত্রে বলেছেন- দুর্ভাগ্যবশত, ক্ষয়ক্ষতির জন্য একটি পয়সাও পরিশোধ করা হয়নি।’
মালদ্বীপের পরিবেশ মন্ত্রী শাওনা আমিনাথ এই চুক্তি বিষয়ে মন্তব্য করেছেন যে, ‘বিশ্বব্যাপী কার্বন নির্গমন অর্ধেকে নামিয়ে আনতে আমাদের হাতে ৯৮ মাস সময় আছে। ১ দশমিক ৫ এবং ২ ডিগ্রির মধ্যে পার্থক্য আমাদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের সমান।’
প্রতিদিন সকালে শ্যামনগরের আব্দুস সাত্তারের বাড়ির সীমানায় সমুদ্রের জোয়ার আসে। এই জোয়ারের পানিতেই বাড়ির উঠানে পরম মমতায় আগলে রাখা তার পিতার কবরটুকুও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এভাবে সমুদ্র তার অতীত-স্মৃতি কেড়ে নিয়েছে, ভবিষ্যতও ফেলে দিয়েছে হুমকির মুখে।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে স্কটল্যান্ডে বসে নেয়া বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্তগুলো যদি না আন্তরিকতার সঙ্গে দ্রুত বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে সেইদিন আর খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশের শ্যামনগরের বন্যতোলা, গাবুরা ও বনবিবি তলার মতো শত শত গ্রামে বসবাস করা হাজারো আবদুস সাত্তারকে পরিবার পরিজন নিয়ে শেকড় ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে নতুবা ভেসে যেতে হবে সাগরের অথৈ নোনা জলে।