সুইডেনের কঠোর অভিবাসন আইন ও ডক্টরাল শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ

0
842

সুইডেনের নতুন অভিবাসন আইন বা এলিয়েন অ্যাক্ট পিএইচডি শিক্ষার্থীদের জন্য দেশটিতে ক্যারিয়ার গড়ার ক্ষেত্রে কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। নতুন এই অভিবাসন আইনে সুইডেনে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য কঠোর শর্ত আরোপ করা হয়েছে।

জেনি আইও-জর্গেনসেন এবং বেনি বোরগেই । ছবি: সংগৃহীত

সুইডিশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইউনিভার্সিটি টিচার্স এর চেয়ারপার্সন ও ডক্টরাল ক্যান্ডিডেটস অ্যাসোসিয়েশন (এসইউএলএফ) এর গবেষক জেনি আইও-জর্গেনসেন এবং (এসইউএলএফ-ডিসিএ) এর মনোনয়ন কমিটির সদস্য ও প্রাক্তন বোর্ড সদস্য বেনি বোরগেই যুক্তি দেখিয়েছেন যে, নতুন এই আইন বিশ্বের শীর্ষ মেধাবী শিক্ষার্থীদেরকে সুইডেন বিমুখ হতে উৎসাহিত করবে। যেটি দেশটির জন্য দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির কারণ হতে পারে।

নতুন অভিবাসন আইন ও সুইডেনে ডক্টরাল পেশার ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন এই বিশেষজ্ঞদ্বয়।

সুইডেনের অভিবাসন আইন বা ‘এলিয়েন অ্যাক্ট’ এ মূলত স্থায়ী বসবাসের অনুমোদন পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলিতে সংশোধন আনা হয়েছে।

২০ জুলাই, ২০২১-এ কার্যকর হওয়া নতুন শর্তগুলি সুইডেনে বিদেশি ডক্টরাল প্রার্থী এবং গবেষকদের মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে। এটি সুইডেন থেকে হাজার হাজার বিদেশি পিএইচডি স্নাতক এবং গবেষকদের বিতাড়িত করে গবেষণায় কয়েক বছরের কর-অর্থায়নকৃত বিনিয়োগ নষ্ট করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন এই দুই বিশ্লেষক।

সেইসঙ্গে, এটি সুইডেনের গবেষণা ও উন্নয়নের আকর্ষণকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং দেশটিতে আন্তর্জাতিক প্রতিভাবানদের দ্বারা অর্জিত বৈজ্ঞানিক সাফল্য ও অগ্রগতির ধারাও স্তিমিত হয়ে পড়ছে।

স্থায়ী বসবাসের অনুমতির জন্য প্রয়োজনীয় নতুন যে শর্তগুলি আরোপ করা হয়েছে, সেখানে আবেদনকারীদের তাদের আবেদনগুলি যাচাই করার তারিখ থেকে কমপক্ষে ১৮ মাস স্থায়ী বা নির্দিষ্ট-মেয়াদী কর্মসংস্থান চুক্তির প্রমাণ দেখাতে হবে। অথবা কিছু ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলক নিয়োগ বা খরচ নির্বাহের অন্যান্য উপায়ের প্রমাণ দেখানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

এক্ষেত্রে বেকারত্ব বীমা সুবিধাকে আর্থিক সংস্থানের উপায় হিসাবে গণনা করা হবে না। বর্তমান পারমিটের মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৪ দিন আগেই কেবল স্থায়ী বসবাসের জন্য আবেদন করার সুযোগ পাওয়া যাবে। অর্থাৎ মধ্যবর্তীকালীন অতিরিক্ত কোন সময় থাকছে না; তাই যারা ২০ জুলাইয়ের আগে আবেদন করেছেন তারাও খুব অল্প সময়ের নোটিশে নতুন আরোপিত শর্তের আওতায় পড়বেন।

বিশ্লেষকদ্বয় বলছেন, ‘এসইউএলএফ ডক্টরাল ক্যান্ডিডেটস অ্যাসোসিয়েশনে আমাদের অনেক সদস্য এই শর্তগুলির বিষয়ে তাদের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। যার মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, ডক্টরাল কর্মসংস্থান খাত সাধারণভাবে নাজুক পরিস্থিতিসম্পন্ন ব্যক্তিদের সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করছে। ইইউ অখবা ইইএ এর বাইরের কারও পক্ষে এত কঠোর শর্ত পূরণ করা কার্যত অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে।’

আরো পড়ুন

ডেনমার্ক ও সুইডেন ভ্রমণের অনুমতি পাবেন যারাটানা তৃতীয়বার প্রবাসীদের পছন্দের শীর্ষ দেশ সুইজারল্যান্ডনরওয়েতে বসে রাশিয়ার দিকে মূত্রত্যাগ করলে, গুনতে হবে জরিমানা
এসইউএলএফ সদস্যদের জন্য অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি করেছে, এমন নিম্নলিখিত বিষয়গুলির প্রতি বিশ্লেষকদ্বয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন:

• গবেষক এবং ডক্টরাল প্রার্থীদের চাকরির চুক্তি স্বল্প বা নির্দিষ্ট মেয়াদী এবং প্রায়ই তা বার্ষিক চুক্তিতে বাড়ানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে, চুক্তিগুলি আরও স্বল্প মেয়াদী হয়ে থাকে, কখনও কখনও একবারে তিন থেকে ছয় মাস।

• ডক্টরাল চাকরির জন্য বিশেষভাবে জারি করা অস্থায়ী রেসিডেন্সি পারমিটের কারণে ডক্টরাল প্রার্থীরা চাকরি পরিবর্তন করতে পারবেন না। তাই, তারা একটি বৃত্তাকার অচলাবস্থার মধ্যে পড়েন, যেখানে তাদের অস্থায়ী বসবাসের পারমিট কর্মসংস্থানের ধরন পরিবর্তনের অনুমতি দেয় না। বিপরীতে, তাদের স্থায়ী বসবাসের অনুমতি নিতে দীর্ঘমেয়াদী বা স্থায়ী কর্মসংস্থানের প্রমাণ দেখাতে হয়।

• ডক্টরাল প্রার্থীরা গ্র্যাজুয়েশনের সময়টাতে সবচেয়ে চাপের মধ্যে থাকেন। তাদের ডক্টরেট ডিগ্রির চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছানোর প্রস্তুতি হিসেবে বাধ্যতামূলক নিবন্ধ প্রকাশ করতে হয় এবং একটি ডক্টরেট গবেষণামূলক বিশ্লেষণ লিখতে হয়। এই সময়ে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পেতে নতুন প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য তাদের দীর্ঘমেয়াদী বা স্থায়ী কর্মসংস্থানের সন্ধান করতে হবে; অন্যথায়, তাদের অস্থায়ী বসবাসের অনুমতির মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে তারা সুইডেন থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বেন।

• তাদের বেশিরভাগই ইতোমধ্যে সুইডেনে বেশ কয়েক বছর ধরে বসবাস করছেন, সুইডিশ একাডেমিক পদ্ধতি এবং স্থানীয় সামাজের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক তৈরি করেছেন। তাদের অনেকের পরিবার এবং সন্তান সুইডেনে জন্মগ্রহণ করেছে এবং বহু বছর ধরে সুইডেনে বসবাস করছেন, সুইডিশ সমাজে বিভিন্ন উপায়ে অবদান রাখছেন তারা।

চার বছর পর স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দেওয়া ‘আগের আইনের’ ভিত্তিতে অনেকেই সুইডেনে চাকরি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এই নতুন শর্ত অনুযায়ী দেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার সম্ভাবনা এইসব সামাজিক বন্ধনকে সম্পূর্ণভাবে ভেঙে দিয়েছে।

সুইডিশ উচ্চ-শিক্ষা কর্তৃপক্ষ (ইউকেএ) এর তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালে নিবন্ধিত মোট ১৭ হাজার ডক্টরাল প্রার্থীদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ বিদেশ থেকে এসেছেন; যাদের প্রতি দশজনের মধ্যে ছয়জন স্নাতক শেষ করে সুইডেন ছেড়ে চলে গেছেন।

অন্যান্য প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, এর আগে ইইউ অথবা ইইএ অঞ্চলের বাইরের ৬৬ শতাংশ গবেষকরা দেশটিতে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য যোগ্য হওয়ার সত্ত্বেও, এখন সুইডেন ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন। সাম্প্রতিক সময়ে আরোপিত কঠোর শর্তাবালির সঙ্গে সুইডেনের বিরূপ বসবাস আইনের কারণে এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মনে করছেন এই বিশ্লেষকগণ। তারা বলছেন, এর ফলে বিরাট সংখ্যক মানুষকে ডক্টরেট বা গবেষণামূলক চাকরি গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

বিশ্লেষকদ্বয় বলছেন, এই পরিবর্তনগুলি উচ্চ-শিক্ষা এবং বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির আন্তর্জাতিকীকরণের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ। সেইসঙ্গে বিশ্বব্যাপী প্রতিভাবানদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান হিসাবে সুইডেনের খ্যাতিতেও ভাটা পড়বে। সুইডেন সাম্প্রতিক বছরগুলিতে গবেষণা এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিমান বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু স্থায়ী বসবাসের অনুমতির জন্য কঠোর শর্তাবালির কারণে, এর ফলাফল ভোগ করবে অন্যান্য দেশ।

সুইডেনের নতুন আবাসন আইন আবাসিক অনুমোদনধারীদের জন্য কী বার্তা দিচ্ছে?

বিশ্লেষকদ্বয় বলছেন, ‘২০১৪ সালের ল্যান্ডমার্ক আইন ডক্টরেট প্রার্থীদের স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দেয়, তখন আমরা অন্যান্য দেশ থেকে সুইডেনে মেধাবীদের আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে দুর্দান্ত অগ্রগতি লক্ষ্য করেছি।’ কিন্তু নতুন আইনের এই শর্তাবালি সেই অগ্রগতিকে পিছিয়ে দিয়েছে, সুইডেনে হাজার হাজার গবেষক এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য দুর্বলতার আরেকটি স্তর যুক্ত করেছে৷

‘আমরা দাবি করছি যে রাজনীতিবিদ, বিচার মন্ত্রনালয়, শিক্ষা মন্ত্রনালয় এবং অভিবাসন এজেন্সি, এলিয়েন আইন দ্বারা তৈরি এই নিরাপত্তাহীনতা প্রশমিত করার জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। এলিয়েন আইনের প্রয়োগ যাতে সুইডিশ জনস্বার্থের বিরুদ্ধে না হয় তা নিশ্চিত করতে তাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

ইতোমধ্যে, আমরা উল্লিখিত চ্যালেঞ্জগুলি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীদের অবহিত করেছি এবং বিদেশি ডক্টরাল প্রার্থী ও গবেষকদের তাদের বিবেচনা এবং সমর্থনের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’

সূত্র: ইউরো নিউজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here