সৌদি আরবের রাস্তায় যে নিয়মগুলো মানতেই হবে

0
10804
সৌদি আরবের ট্রাফিক
ছবি: পিন্টারেস্ট

সৌদি আরবে অবস্থানরত যেকোনো নাগরিককে ট্রাফিক আইন ভঙ্গের জন্য গুণতে হয় বড় অংকের জরিমানা, যার পরিমাণ ৬০ হাজার সৌদি রিয়েল পর্যন্তও হয়ে থাকে। সৌদি আরবে গাড়ি চালনা পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন অনেক প্রবাসী বংলাদেশি। আবার বিদেশ গমনে ইচ্ছুক অনেকে সৌদি আরবে গাড়ি চালনাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে চান। সেক্ষেত্রে অবশ্যই সৌদি আরবের ট্রাফিক আইন, সড়ক ব্যবস্থাপনা ও গাড়ি চালনার নিয়ম কানুন বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। সড়ক দুর্ঘটনা, জরিমানা ও অনাকাঙ্খিত ঝামেলা এড়াতে জেনে নিতে পারেন সৌদি আরবের ট্রাফিক সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা ও নিয়মনীতি-

সৌদিতে কারা গাড়ি চালাতে পারে?

গাড়ি চালানোর অনুমোদন পেতে চালকের বয়স কমপক্ষে ১৭ বছর হতে হবে। কিন্তু ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে হলে বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হতে হবে। ইইউ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, পাশাপাশি প্রতিবেশী জিসিসি রাজ্য (বাহরাইন, কুয়েত, ওমান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত)-এ ইস্যু করা ড্রাইভিং লাইসেন্সধারীরা তিন মাসের জন্য তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যবহার করতে পারবেন। আর আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং লাইসেন্স করা থাকলে তার বৈধতার মেয়াদ থাকবে এক বছর। এর পর চালকের লাইসেন্সটিকে সৌদি লাইসেন্সে রূপান্তর করতে হবে। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে নারীরা প্রথমবারের মতো সৌদি আরবে গাড়ি চালানোর অনুমোদন পায়।

সৌদি আরবে রাস্তায় চলাচলের সাধারণ নিয়ম-কানুন

সৌদি আরবে রাস্তার নিয়ম ভঙ্গ করলে জরিমানা, লাইসেন্সের পয়েন্ট এমনকি ড্রাইভিং নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে। সিট বেল্ট চালক এবং সামনের সিটের যাত্রীর জন্য বাধ্যতামূলক। ১০ বছরের কম বয়সী শিশুকে গাড়িতে একা রাখা যাবে না। ওভারটেক করার সময় সামনের যানবাহনটির বাম পাশ দিয়ে যেতে হবে। রাস্তার মাঝখানে দুটি শক্ত লাইন থাকলে চালক ওভারটেক করতে পারবে না। গোল চক্করে প্রবেশ করার সময়, চালককে অবশ্যই ইতিমধ্যে গোল চক্করে থাকা যানবাহনগুলিকে যেতে দিতে হবে। পুলিশ চাওয়ামাত্র লাইসেন্স ও আকামা দেখাবেন। নম্র ও ভদ্র আচরণ করুন। পুলিশকে কখনও ঘুষ দিতে যাবেন না।

ছবি:সংগৃহীত

গাড়ির গতিসীমা

সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ উচ্চ গতি। শহরাঞ্চল ও শহরের বাইরে সর্বোচ্চ গতিসীমা ৫০ থেকে ৭০ কি.মি/ঘন্টা এবং হাইওয়েতে ১২০ কি.মি./ঘন্টা নির্ধারণ করা আছে। এই সীমা অতিক্রম করলে তাকে ৯০০ সৌদি রিয়াল জরিমানা করা হবে, সেই সঙ্গে ৬টি ট্রাফিক বিধি লঙ্গন পয়েন্ট যুক্ত হবে। দেশটির গুরুত্বপূর্ণ রুটগুলোতে গতিসীমা নজরদারির জন্য স্পিড ক্যামেরা বসানো আছে।

সৌদি আরবের ট্রাফিক বিষয়ক তথ্য

দেশটিতে সাধারণত সড়কের নির্দেশনা সংকেত ইংরেজি ও আরবি দুই ভাষাতে লেখা থাকে। তবে দূরবর্তী গ্রামাঞ্চলে শুধু আরবিতে লেখা হয়। গাড়ি চালনার সময় গুগল ম্যাপের সাহায্য নিতে পারেন, আপনার স্মার্টফোনের মাধ্যমে স্থানীয় একটি অ্যাপ ‘ওয়েজ’ (Waze) ব্যবহার করে ট্রাফিকের পরিস্থিতি জানতে পারবেন।

গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা

শহরের মধ্যে গাড়ি পার্কিং এর জন্য আপনাকে অর্থ প্রদান করতে হবে। তবে শহরের কেন্দ্রে হাঁটা দুরত্বে বিনামূল্যে পার্কিং এর ব্যবস্থাও রয়েছে। সৌদিতে গাড়ি পার্কিং এর জন্য ১০ রিয়েল বা তার কিছু বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হয়। তবে আবাসিক এলাকায় পার্কিংয়ে সেরকম কোনো বিধিনিষেধ নেই।

সড়ক দুর্ঘটনা

দুঃখজনকভাবে সড়ক দুর্ঘটনা সৌদি আরবের প্রাত্যহিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে দুর্ঘটনাগুলো সচারচার খুব বেশি মারাত্মক হয়ে থাকে না। দেশটির সড়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটে থাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উচ্চ গতি, মুঠোফোনে কথা বলা, উটের সঙ্গে ধাক্কা লাগা ও চাঁকা খুলে যাওয়ার কারণে।

চালক যদি দুর্ঘটনায় পড়ে, তাহলে প্রথম কাজ হলো ৯৩৩ নম্বরে ফোন করে দুর্ঘটনাস্থল ও বিস্তারিত তথ্য পুলিশকে জানানো, তারপর গাড়ির কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। পুলিশের প্রতিবেদনে চালক দোষী প্রমাণিত হলে জেল-জরিমানা হতে পারে। তবে পুলিশ আসার আগে কখনই দুর্ঘটনাস্থল ত্যাগ করবেন না।

ছবি:সংগৃহীত

জরিমানা এবং স্থগিতাদেশ

ড্রাইভিং লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন ডকুমেন্টস (ইস্তিমারা), ইন্স্যুরেন্সের বিবরণ এবং আকামার কপি গাড়িতে রাখুন, কারণ ট্রাফিক পুলিশ এসব যাচাই করতে পারে। জরিমানার পরিপ্রেক্ষিতে, যদি কোনও ড্রাইভার ২৪ পয়েন্ট সংগ্রহ করে তবে লাইসেন্স স্থগিত করা হয়। জরিমানার পয়েন্ট পাওয়ার পর আর কোনো ট্রাফিক লঙ্ঘণ ছাড়াই এক বছর পার করতে পারলে চালকের লাইসেন্স থেকে এসব পয়েন্ট মুছে ফেলা হয়।

২০২১ সালে সৌদি আরবের নতুন ট্রাফিক জরিমানার তালিকা:

সৌদি আরবের ট্রাফিক আইনে আটটি ক্যাটাগরিতে জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

ক্যাটাগরি-১:

২০২১ সালে সৌদি আরবে নতুন ট্রাফিক জরিমানার এই ক্যাটাগরিতে যেকোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ড্রিফটিংয়ের(ইচ্ছাকৃতভাবে অনেক জোরে গাড়ির ব্রেক করা, সাধারণত রোমাঞ্চ তৈরির জন্য তরুণরা এটি করে থাকে) অভিযোগে ন্যূনতম ২০ হাজার এবং সর্বোচ্চ ৬০ হাজার সৌদি রিয়েল জরিমানা করা হবে।

ছবি:সংগৃহীত

ক্যাটাগরি-২: ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার সৌদি রিয়েল।

২৪টি ট্রাফিক লঙ্ঘন পয়েন্টসহ অ্যালকোহল বা মাদকের প্রভাবে গাড়ি চালানো। গাড়ির চেসিস নম্বর পরিবর্তন করলে অথবা লুকিয়ে রাখলে।

ক্যাটাগরি-৩: ৩ হাজার থেকে ৬ হাজার সৌদি রিয়েল।

ট্রাফিক সিগন্যালে লাল আলো জ্বলা অবস্থায় না থামলে। রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় প্রতিযোগিতা করা। শিক্ষার্থীদের উঠা-নামার সময় স্কুল বাসকে ওভারটেক করতে দেখা গেলে। যানবাহনের ভেতরে অননুমোদিত ডিভাইস ব্যবহার করলে। ১২টি ট্রাফিক লঙ্ঘন পয়েন্টসহ রাস্তার ভুল দিকে বা বিপরীত দিকে গাড়ি চালানো।

ক্যাটাগরি-৪: ১ হাজার থেকে ২ হাজার সৌদি রিয়েল।

ছয়টি ট্রাফিক লঙ্ঘন পয়েন্টসহ রেললাইনে থামানো বা দাঁড়ানো। অনুমোদিত সংখ্যার চেয়ে বেশি যাত্রী বহন করা। সড়ক লেনের নিয়ম না মানা। গাড়ির নম্বর প্লেট না থাকা অথবা নকল/অবৈধ নম্বর প্লেট ব্যবহার করা। যেখানে সেখানে পার্কিং। ইস্তিমারা এবং আকামা পুলিশকে দেখাতে অস্বীকার করা। মোটরসাইকেলে চলাকালীন হেলমেট না পরা। নির্ধারিত স্থান ব্যতীত যেখানে-সেখানে রাস্তা পার হওয়া।

ছবি:সংগৃহীত

ক্যাটাগরি-৫: ৫০০ থেকে ৯০০ সৌদি রিয়েল।

লাইসেন্স ছাড়াই বা মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানো। যদি রাতে গাড়ি চালানোর সময় হেডলাইট ব্যবহার করা না হয়, বিশেষ করে খারাপ আবহাওয়ায়। অপ্রয়োজনে হর্ণ ব্যবহার করা। যদি যানবাহনের টিনিং নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়। ট্রাফিক পুলিশের সংকেত অনুসরণ না করা। দুইটি ট্রাফিক লঙ্ঘন পয়েন্টসহ গাড়ি চালানোর সময় ফোন ব্যবহার করা।

ক্যাটাগরি-৬: ৩০০ থেকে ৫০০ সৌদি রিয়েল।

সর্বোচ্চ গতি সীমা অতিক্রম করা নিষিদ্ধ। তবে যানবাহনের চরম ধীরগতি থাকলে যা যানজটের সৃষ্টি করে, সেক্ষেত্রেও গুনতে হবে জরিমানা। মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালানো। জরুরি যানবাহনের জন্য ভিআইপি-কে অগ্রাধিকার দেওয়া রাস্তার চলাচলে বিঘ্ন ঘটানো। রাস্তায় বস্তু/জিনিসপত্র ফেলে দেওয়া যা অন্যদের ক্ষতি করতে পারে। অপ্রয়োজনে ব্রেক ব্যবহার করা। গাড়ির মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ করা। অননুমোদিত লেন অতিক্রম করা।

ক্যাটাগরি-৭: ১০০ থেকে ৩০০ সৌদি রিয়েল।

ফাহর বা মোটর পরিদর্শন নেই এমন গাড়ি চালানো। দুটি গাড়ির মধ্যে নিরাপদ দূরত্ব বজায় না রাখলে। অনুমোদিত নয় এমন আলো ব্যবহার করলে। জনগনের চলাচলের রাস্তায় পার্কিং করলে। বৈধ ইস্তিমারা নেই এমন যানবাহন চালানো। ২টি ট্রাফিক লঙ্ঘন পয়েন্ট সহ সিট বেল্ট ছাড়াই গাড়ি চালানো। শিশুদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ না করে গাড়ি চালানো। লেন পরিবর্তন করার সময় নির্দেশক ব্যবহার না করা।

ক্যাটাগরি-৮: ১০০ থেকে ১৫০ সৌদি রিয়েল

চলন্ত অবস্থায় যেকোনো যানবাহন থেকে বের হওয়া। পথচারীরা ট্রাফিক সিগন্যাল উপেক্ষা করে রাস্তা পার হলে। গাড়ির ইঞ্জিন চালু থাকা অবস্থায় চালক গাড়ি থেকে নেমে যাওয়া। বৈধ বীমা ছাড়া যে কোন যানবাহন চালানো।

এছাড়াও সম্প্রতি সৌদি আরবের ট্রাফিক বিভাগ জরিমানা পরিশোধ না করা বা অমান্যকারীদের বিচারের জন্য আদালতে প্রেরণেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সূত্র: লাইফ ইন সৌদি আরব ডট নেট

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here