আমরা যারা বিদেশ-বিভুঁইয়ে কর্মসংস্থান তথা শ্রমিক হিসেবে অভিবাসন করি, আমরা কি কখনো আমাদের অভিবাসনের সামাজিক মূল্যের লাভ ক্ষতির হিসাব করি? একজন শ্রমিক যখন বিদেশে যায়, তখন দেখা যায় যে, সে শুধু অর্থনৈতিক লাভ ক্ষতির হিসাব করেই অভিবাসনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। কত বেতন পাবো, কত টাকা দেশে পরিবারের কাছে পাঠাতে পারবো, কিংবা অভিবাসনের জন্য লগ্নিকৃত অর্থ উত্তোলনের পরে সঞ্চয় করা বা সম্পত্তি ক্রয় করার মতো হিসাব-নিকাশেই আমরা আমাদের চিন্তা ভাবনা সীমাবদ্ধ রাখি।
একটি পরিবারের সদস্য, যিনি হতে পারেন একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি বা পরিবারের প্রধান, তিনি দীর্ঘদিনের জন্য দেশ থেকে, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন- যার প্রভাব পরিবারের উপরে সামাজিকভাবে কতোটা পড়তে পারে সে চিন্তা কি আমরা কখনো করি বা অভিবাসনের পূর্বে করেছি?
অর্থনৈতিক মূল্যের পাশাপাশি, অভিবাসনের কারণে একটি শ্রমিককে ও তার পরিবারকে যে সামাজিক মূল্য দিতে হয়, সে বিষয়ে আমরা কতোটা বিশ্লেষণ করছি। কিংবা একজন অভিবাসী কর্মীকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ দিতে পারছি কিনা, তা প্রশ্নের দাবি রাখে।
অভিবাসনের সামাজিক মূল্য:
একজন অভিবাসী শ্রমিক যখন প্রবাসে যান, তখন তাকে অর্থনৈতিক মূল্যের পাশাপাশি দুটি ক্ষেত্রে সামাজিক মূল্য দিতে হয়: নিজের জন্য এবং পরিবারের জন্য। বিভিন্ন বিশ্লেষক ও গবেষকদের মতে, দীর্ঘদিন পরিবার ও স্বজনের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা, একাকিত্ব, পরিবারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য মানসিক চাপ, সন্তানদের সুশিক্ষার জন্য উদ্বিগ্ন হওয়া, দুর্ঘটনায় বা অসুস্থতায় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা ইত্যাদি একজন অভিবাসীর সামাজিক মূল্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে পরিগণিত হয়।
অপরদিকে, স্ত্রী বা স্বামীর শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তাহীনতা, পরিবারের বয়ো:বৃদ্ধ সদস্যদের শারীরিক অসুস্থতায় সহায়হীন অনুভব করা, সন্তানদের অভিভাবকহীন বলে মনে করা, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পত্তি ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে অহেতুক বিবাদে জড়ানো ইত্যাদিকে – অভিবাসীর পরিবারের সদস্যদের সামাজিক মূল্য হিসেবে অনেকে গণ্য করে থাকেন।
বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি গবেষণায় দেখা যায়, একটি অভিবাসী পরিবারে বাবা অথবা মা, কিংবা কখনো দুজনের অনুপস্থিতিতে দেশে যে সন্তানরা থাকে, তারা এক ধরণের নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বড় হয়, এবং একাকীত্বে ভোগে। বিশেষত অসুখ-বিসুখ, সামাজিক বিভিন্ন উৎসবে কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানিকতায় এ বিষয়গুলো প্রকট হয়ে ওঠে ।
এমনকি দেখা গিয়েছে, প্রবাসী নয় এমন পরিবারের ছেলে-মেয়েদের তুলনায় প্রবাসীর ছেলে-মেয়েদের ঘরের কাজ বেশি করতে হয়। আবার, স্বামী প্রবাসে থাকে এমন নারীর নানাক্ষেত্রে সামাজিক মূল্য অনেক বেশি দিতে হয়, এর মধ্যে রয়েছে একাকীত্ব, চলাফেরায় বাড়তি বিধিনিষেধ, শ্বশুরবাড়ির নিয়ন্ত্রণ, শারীরিক নিরাপত্তার অভাব ইত্যাদি।
পুরুষ অভিবাসী কর্মীর অনুপস্থিতির কারণে নিরাপত্তাহীনতার জন্য কিংবা সামাজিক চাপের কারণে অনেক সময় একটি অভিবাসী পরিবার তাদের কন্যা সন্তানকে উচ্চশিক্ষার পরিবর্তে বাল্য বিবাহ দিতে বাধ্য হন। আবার অনেক সময় দেখা যায়, স্বামী বা স্ত্রীর অনুপস্থিতির জন্য, স্বামী বা স্ত্রী অনেকসময় পরকীয়া কিংবা অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। যার প্রভাব মারাত্বকভাবে বিদেশে অবস্থানরত স্বামী বা স্ত্রীর উপরে পরে, সৃষ্টি হয় পারিবারিক কলহ ও মনঃসামাজিক দ্বন্দ্ব। এমনকি হত্যা, আত্বহত্যার ঘটনাও ঘটে।
রেমিট্যান্সের ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ও অনেক সময় পারিবারিক কলহের সৃষ্টি হতে পারে, যার জন্য একটি অভিবাসী পরিবারকে তার খেসারত দিতে হয় নানা ভাবে। এছাড়া, বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীর একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে, অভিবাসীর পরিবার ধনী, তাদের কোনো ধরণের বিশেষ সেবা, অর্থছাড় বা কল্যানমূলক সেবা প্রাপ্তির প্রয়োজন নেই। তাই তাদেরকে কোনো কিছুতেই ছাড় দেয়া হয়না- যা অত্যাবশকীয়ভাবে একটি সামাজিক মূল্য যা ওই পরিবারকে পরিশোধ করতে হয়।
করণীয় কি?
দীর্ঘদিন যাবৎ অভিবাসীদের এই সামাজিক মূল্যের আমরা কোন গুরুত্ব দেয়নি, বা এই বিষয়ে কাজ করিনি। যার ফলে, অভিবাসীদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়নেও যে অভিবাসীদের সরাসরি অবদান রয়েছে – তা আমরা অনুধাবন করতে পারিনি। তাই পরিবারের ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যেই শ্রমিক তার পরিবারকে অনেক ক্ষেত্রে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে বিদেশে যাচ্ছেন- তাদের সামাজিক মূল্যের প্রভাব হ্রাস করার জন্য আমাদের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।
১. বিদেশে কর্মসংস্থানের সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে অর্থনৈতিক লাভ ক্ষতির হিসেবের পাশাপাশি সম্ভাব্য অভিবাসী কর্মীদের সামাজিক মূল্যের বিশ্লেষণ করানো প্রয়োজন। সেই সঙ্গে তৃণমূল পর্যায়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা ও প্রচার চালানো।
২. বিদেশগামী কর্মীদের প্রাক-বহির্গমন প্রশিক্ষণে সামাজিক মূল্যের প্রভাব ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত অধিবেশন অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়া প্রশিক্ষকদের এই বিষয়ে দক্ষতা উন্নয়নের জন্যও প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।
৩. অভিবাসী পরিবারের জন্য গৃহীত কল্যাণমূলক কার্যক্রমে তাদের অভিগম্যতা নিশ্চিতকল্পে বিশেষ প্রচারের প্রয়োজন রয়েছে- যা সরকারিভাবে করা উচিত।
৪. অভিবাসীদের বিভিন্ন সামাজিক দ্বন্দ্ব ও অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য ইউনিয়ন পর্যায় হতে শুরু করে, জাতীয় পর্যায়ে বিশেষ অভিযোগ নিষ্পত্তি সেল তৈরি করতে হবে।
৫. বিশেষ ব্যবস্থাপনায় অভিবাসীর পরিবারের জন্য কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা করাও জরুরি।
এছাড়া, অভিবাসীর সন্তানদের সুশিক্ষা নিশ্চিতের জন্য ও সফল অভিবাসীদের স্বীকৃতি প্রদানের জন্য চলমান কার্যক্রমের পরিধি ও সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে দেশব্যপী ব্যাপক জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মনে রাখতে হবে, অধিকতর কম সামাজিক মূল্য একজন অভিবাসীর সার্বিক সফলতার মাপকাঠি।