আজ আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস। দুই দশক ধরে জাতিসংঘের সদস্যভূক্ত প্রতিটি দেশ দিবসটি একযোগে উদযাপন করে আসছে। বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালনের পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ এক ইতিহাস। পৃথিবীব্যাপী অভিবাসীদের মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা রক্ষায় বিভিন্ন সময়ে সংগঠিত হয়েছে নানা ধরনের আন্দোলন, সংগ্রাম ও প্রতিবাদ। ১৯৯০ সালে ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সমস্ত অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের অধিকার সংরক্ষণ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহবান করে। ১৯৯৭ সালে মাইগ্রেন্টস রাইটস ইন্টারন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন মাইগ্রেন্টস রাইটসসহ ফিলিপিনো এবং অন্যান্য এশিয়ান অভিবাসী সংস্থাগুলি অভিবাসীদের সঙ্গে ১৮ ডিসেম্বর আর্ন্তজাতিক সংহতি দিবস হিসেবে উদযাপন এবং প্রচার শুরু করে। পরবর্তীতে ২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বিশ্বব্যাপী ১৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।
অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি নিপীড়ন, অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সর্বজনীন অধিকার প্রতিষ্ঠায় অসংখ্য ব্যাক্তি ও সংগঠন নিরলসভাবে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। ১৯৬৫ সালে ফিলিপিনো এবং মেক্সিকান হেরিটেজের খামার শ্রমিকরা ক্যালির্ফোনিয়ার ডোলানো অঞ্চলে আঙ্গুর চাষীদের বিরুদ্ধে অধিক মজুরি ও নিরাপদ কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য অবস্থান ধর্মঘটের আয়োজন করে। এই ধর্মঘটের ফলে ইউনাইটেট ফার্ম ওয়ার্কার্স (ইউএফডব্লুউ) প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। ইউএফডব্লউ এর মত বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনগুলো অভিবাসীদের নাগিরকত্ব প্রাপ্তির পথকে সুগম করা সহ অনিবন্ধিত শ্রমিকদের নির্বাসিত করার বিরুদ্ধে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছিলো। সাম্য ও ঐক্যের জন্য তাদের দীর্ঘ সংগ্রামকে বৈধতা দিয়ে আজ সমস্ত অভিবাসীরা শ্রমিকের মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। অভিবাসী দিবসে এমনই কয়েকটি সংগঠনের সংগ্রামী ব্যক্তিত্বের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হল।
১. সিজার শ্যাভেজ (১৯২৭-১৯৯৩)
একজন সত্যিকারের নায়ক মেক্সিকান আমেরিকান সিজার শ্যাভেজ ছিলেন নাগরিক অধিকার এবং খামার শ্রমিক নেতা ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। তিনি মূলত প্রথম প্রজন্মের আমেরিকান; জন্মগ্রহণ করেছিলেন অ্যারিজোনার ইউমার পার্শ্ববর্তী নিজের পরিবারের ছোট্ট বাড়িতে। ১১ বছর বয়সে, নিজেদের পারিবারিক খামার হারানোর পর পড়াশোনার ইতি টেনে অভিবাসী খামারের শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তারুণ্যকাল এবং যৌবনে সিজার পুরো ক্যালিফোর্নিয়া জুড়ে অভিবাসী খামার শ্রমিকদের সঙ্গে বিভিন্ন খামার, ক্ষেত ও বাগানে কৃষিকাজ করেছেন, সেখানকার কৃষকজীবনের কষ্ট ও অবিচারের অভিজ্ঞতা থেকে যুক্ত হন ইউনাইটেট ফার্ম ওয়ার্কার্সে। শ্যাভেজ এবং তার ইউনাইটেড ফার্ম ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন অহিংস প্রতিবাদ করে ক্যালিফোর্নিয়ার আঙ্গুর চাষীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। ১৯৬৮ সালে তিনি অহিংসার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ইউনাইটেড ফার্ম ওয়ার্কার্সের সমর্থনে ২৫ দিন উপবাস করেছিলেন। তিনি মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতিতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তার ইউনিয়ন ১৯৬০-১৯৭০ এর দশকে কৃষক শ্রমিকদের বেতন ও কাজের ক্ষেত্রে উন্নতি এবং ১৯৭৫ সালে কৃষক শ্রমিকদের যুগান্তকারী আইন গঠনের পথকে প্রশস্ত করে।
২.ইউরি কোচিয়ামা (১৯২১-২০১৪)
ইউরি কোচিয়ামা ১৯৬০ এর দশক থেকে ২০১৪ সালে তার জীবনাবসান হওয়া অবধি সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের জন্য লড়াই করেছিলেন। ক্যালিফোর্নিয়ার সানপেড্রোতে জন্মগ্রহনকারী এই জাপানি অভিবাসী তার বিশ বছর বয়সের আত্মাকে বর্ণনা করেছেন ‘একটি ছোট্ট শহরে একজন আপোসিত স্বচ্ছন্দ্যে জীবনযাপনে অভ্যস্থ মেয়ে’ হিসেবে। ১৯৪২ সালে পার্ল হারবারে বোমা হামলার পর কোচিয়ামাকে আরকারসাসের ক্যাম্প জেরোমে আটক করা হয়েছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১ লাখ ২০ হাজার জাপানি ও জাপানি আমেরিকানদের বন্দী শিবিরের মধ্যে এটি ছিলো একটি। কোচিয়ামা এটিকে তার ‘রাজনৈতিক জাগরণের সূচনা’ বলে উল্লেখ করেন।
সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য এশিয়ান আমেরিকান সংগ্রামে কোচিয়ামার কাজ ছিলো বিস্তৃত-সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। তিনি ভিয়েতনাম বিরোধী যুদ্ধের প্রতিবাদে অংশ নেওয়া থেকে শুরু করে, শ্রমিকদের সংগঠিত করা, এথনিক স্টাডিজ কর্মসূচির বিকাশকে সমর্থন করাসহ জাপানি আমেরিকান কারাগারে বন্দীদের মুক্তির পক্ষে আন্দোলন করেছেন। কোচিয়ামা ৯/১১ এর পর আরব মুসলিম এবং দক্ষিণ এশীয়দের জাতিগত সংকটের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।
৩.ডলোরেস হুয়ের্তা (১০ এপ্রিল ১৯৩০)
ডলোরেস হুয়ের্তা একজন জীবিত নাগরিক অধিকারের আইকন। তার জন্ম নিউ মেক্সিকোতে হলেও শৈশবেই পরিবারের সঙ্গে পাড়ি জমান ক্যালিফোর্নিয়ার স্টকটনে। তিনি রাজনীতিবীদ হিসেবে জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেছেন কৃষকদদের মুক্তির জন্য। ১৯৬২ সালে হুয়ের্তা সিজার শ্যাভেজের সঙ্গে ইউনাইটেট ফার্ম ওয়ার্কাস ইউনিয়নের সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যোগ দেন। এই আন্দোলনের বিখ্যাত স্লোগান “হ্যাঁ, আমরা পারি” এর কৃতিত্বও তার। ১৯৮০ এর দশকে হুয়ের্তা (ইউএফডব্লুউ) এর রেডিও স্টেশনে অভিবাসন নীতি এবং খামার শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন তহবিল সংগ্রহের কাজ করেন। ১৯৮৮ থেকে ৯৩ সাল পর্যন্ত হুয়ের্তা কৃষিশিল্পে বিশেষ শ্রমিক বিধান এবং শ্রমবাজার মূল্যায়ন করার জন্য কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত কৃষি শ্রমিকদের উপর মার্কিন কমিশনে কাজ করেছিলেন।
