জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর নতুন প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগর পাড়ি দেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ ও নৃশংসতম বছর ছিল ২০২০ সাল। মূলত কোভিড-১৯ এর প্রকোপ ঠেকাতে গত বছর দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশ সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করায় বিকল্প মাধ্যম হিসেবে সমুদ্রপথে দেশ ছাড়ার ঝুঁকি নেয় এই শরণার্থীরা।
যার ফলে ২০১৫ সাল থেকে নৌপথে বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগর এলাকা দিয়ে শুরু হওয়া যাত্রায় আরো বেশিসংখ্যক রোহিঙ্গা যুক্ত হয় এবং ২০২০ সালটি পরিণত হয় সবচেয়ে ভয়াবহতম বছর হিসেবে।
‘সমুদ্রে ভাসমান: আন্দামান ও বঙ্গোপসাগরে শরণার্থীদের বিপজ্জনক যাত্রা’ শিরোনামে প্রতিবেদনটিতে আরো জানানো হয়েছে যে, ২০২০ সালে ২ হাজার ৪১৩ জন ভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল, যাদের মধ্যে ২১৮ জন মারা গেছে অথবা সমুদ্রে নিখোঁজ হয়েছেন। প্রতিবেদনটি বলছে, ২০১৯ সালে যারা যাত্রা করেছিল তাদের চেয়ে আটগুন বেশি বিপজ্জনক ছিল ২০২০ সাল।
এদিকে বিগত বছরগুলোর যাত্রার চেয়ে বর্তমান যাত্রার চিত্রে কিছুটা ভিন্নতা যোগ হয়েছে। বিগত বছরগুলো পুরুষের সংখ্যা বেশি হলে বর্তমানে সে চিত্র উল্টে গেছে। এখন নারী ও শিশুদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। এর ফলে এরকম ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রায় যোগ দেয়ায় পাচারকারীদের দ্বারা নিপীড়নের শিকার হওয়ার আশঙ্কা বেশি বেড়ে গেছে নারী ও শিশুদের ওপর।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অভিবাসনের চেষ্টা নতুন কোনো ঘটনা নয়। গত দশকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে জীবন বাঁচাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌপথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। মুলত মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে।
পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা নানারকম সংকটের মধ্যে আছে বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনটিতে। বলা হয়, চলাচল, জীবনযাপন ও শিক্ষার ওপর নানারকম বাধানিষেধ আরোপের কারণে তারা অন্য কোথাও পাড়ি দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাছাড়া দিনশেষে নিজ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার স্বপ্নেও তারা এই দুঃসাহসিক ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রায় অংশ নেয়।
এমন অসংখ্য শরণার্থী রয়েছে, যারা ২০২০ সাল থেকে টানা কয়েক মাস অসহায় অবস্থায় নৌকায় পড়ে আছে, চোরাচালানকারীদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, অপর্যাপ্ত খাদ্য ও অস্বাস্থ্যকর পানি পান করে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, এবং সমুদ্রের কঠিন পরিস্থিতি সহ্য করছে। যার মধ্যে রয়েছে তীব্র তাপদাহ, প্রবল ঢেউ এবং ঝড়। মূলত এই ঝুঁকিগুলি সেই সময়গুলিতে দীর্ঘায়িত হয় যখন কিনা নৌকায় চড়ে কাঙ্খিত গন্তব্য ঠেকাতে শরণার্থীদের পুশব্যাক করে দেয়া হয়।
নৌপথে ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসন ঠেকানো এবং সমুদ্র থেকে উদ্ধার হওয়া শরণার্থীদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিতে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে ইউএনএইচসিআর।
প্রতিবেদনের মুখবন্ধে ইউএনএইচসিআর-এর এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরিচালক ইন্দ্রিকা রাতওয়াত্তে সবাইকে একযোগে কাজ করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে বলেছেন, ‘যতক্ষণ না আন্দামান সাগর এবং বঙ্গোপসাগরের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলি সমুদ্রে বিপদগ্রস্তদের উদ্ধার ও অবতরণ করতে অনাগ্রহ দেখাবে ততক্ষণ সবাই ব্যর্থ হবে। যা দুঃখজনক এবং মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘চাইলেই আমরা আরো ভালো কাজ করতে পারি।’