আয়েশা সিদ্দিকা, সম্প্রতি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং বিভাগীয় কমিশনার, ঢাকা বিভাগের আয়োজনে বিভাগীয় পর্যায়ে পরিচালিত ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ ’ শীর্ষক কার্যক্রমের আওতায় নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন যে নারী- ক্যাটাগরীতে জয়িতা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তিনি কাজ করছেন ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার ফিল্ড অর্গানাইজার হিসেবে। আয়েশা সিদ্দিকা তার সংগ্রামী জীবনের গল্প নিয়ে কথা বলেছেন অভিবাসী ডটকম এর সঙ্গে।
আয়েশা সিদ্দিকা ছোটবেলাতেই হারিয়েছেন মাকে। বাবা দ্বিতীয়বারের মতো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ায়, বিচ্ছিন্ন হয়েছেন তার কাছ থেকেও। ইচ্ছে থাকার সত্ত্বেও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পর আর পড়াশুনাটাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। তাই পরিবারের সিদ্ধান্তে বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু করেন।কিন্তু বিয়ের একমাসের মাথায় জানতে পারেন তার স্বামী মাদকাসক্ত। তিনি তখন অনুধাবন করতে পারছিলেন একজন কর্মহীন মাদকাসক্ত মানুষকে জীবনসঙ্গী করে চলা কতোটা দুঃসহ যন্ত্রণার। শ্বশুরবাড়িতে তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা তাকে কোনো সহযোগিতা তো করেইনি বরং মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালাতেন আয়েশার উপর।
আয়েশা একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ফিরে আসার, কিন্তু ততোক্ষণে তিনি অন্তঃসত্তা হয়ে পড়েন। তাই সন্তানের কথা ভেবে, সবকিছু মেনে নিয়ে থেকে যান স্বামীর কাছে। এভাবেই চলতে থাকে আয়েশার জীবন, তার কোলজুড়ে আসে তিনটি সন্তান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, প্রতিটি সন্তান জন্ম নেয়ার পরই তাদেরকে আয়েশার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হত। ২০১৬ সালে তার স্বামী মারাত্মক অসুস্থ হয়ে মারা যান। এরপর, শ্বশুরবাড়ির সদস্যরা তিন সন্তানকে কেড়ে নেয় আয়েশার কাছ থেকে। সেইসঙ্গে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। মা-বাবা-সন্তানহীন আয়েশার জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্যোগ। তিনি চলে আসেন মুন্সিগঞ্জে নানার বাড়িতে।
সন্তানদের ফিরে পেতে আইনি সহায়তার আশ্রয় নিয়েও তাদেরকে ফিরে পাননি আয়েশা। কিন্তু তিনি ভেঙ্গে পড়েননি, জীবনকে নতুন করে খুঁজে নেওয়ার যুদ্ধে নেমে পড়লেন। তিনি নানাভাবে চেষ্টা করছিলেন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে, নিজের একটি পরিচয় খুঁজে পেতে। একপর্যায়ে ২০১৭ সালের শেষের দিকে যুক্ত হন ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের ফিল্ড অর্গানাইজার হিসেবে। কাজ শুর করলেন বিদেশ ফেরত অভিবাসীদের নিয়ে।
আয়েশা বলছিলেন, ‘ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম আমার জন্য একটা নতুন জীবন, এই মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম যেন আমার নতুন বেঁচে থাকা। সারাদিন মনে আনন্দ নিয়ে বিদেশ ফেরত ভাই, আপাদের নিয়ে কাজ করি, তাদের সুখ, দুঃখ শুনি। তারপর বাসায় এসে চিন্তা করি, এই আপা বা ভাইয়ের জন্য আমি আর কী কী করতে পারি।’
‘একদিন ফাতেমা নামে এক বিদেশ ফেরত আপার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম’- বলছিলেন আয়েশা। ‘বিদেশ থাকাকালীন তার পাঠানো সব টাকা এক প্রতারক আত্বসাৎ করে নেয়। এখন সে নিঃস্ব, আমার হাত ধরে তিনি কন্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন আমার তো মাথা গোজার ঠাঁইটুকু নেই।’ লম্বা শ্বাস নিয়ে আয়েশা বলে যাচ্ছিলেন, ‘তখন আমার মনে হল আমি তো তার থেকে অনেক ভাল আছি, আমার কষ্টটা তখন কমে গেল।’
‘আমার কোনো পরিচয় ছিল না, আজকে যখন আমার গ্রামে বের হই, কাজ করতে যাই, সবাই আমাকে আয়েশা আপা বলে চেনে। আয়েশা সিদ্দিকা একটা নতুন পরিচয় আমার কাছে। এর আগে আমাকে কেউ আয়েশা সিদ্দিকা নাম ধরে ডাকত না। আমি আমার এই পরিচয়টুকু ধরে রাখতে চাই, আমার মাধ্যমে যেন আরো দশটা মানুষ উপকৃত হতে পারে আমি সেটা চাই’- বলছিলেন আয়েশা।
জয়িতা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলছিলেন, এখন আরো অনেকে জানল যে আয়েশা সিদ্দিকা জয়িতা হয়েছেন, তিনি অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করেন। ‘আমার দায়িত্ব আরো বেড়ে গেল, আমাকে আরো ভালভাবে কাজ করতে হবে।’
আয়েশা বলছিলেন, ‘আমি জয়িতা হবার জন্য কিছু করি নাই, আমি জানতামও না আমাকে কী সার্টিফিকেট দেওয়া হবে। আমি শুধু আমার কাজটা করে গেছি। আমি বিদেশ ফেরত অভিবাসীদের মধ্যে খুঁজে খুঁজে বের করতাম প্রয়োজনটা কার, কে সহায়তা পাওয়ার যোগ্য। আমার প্রোগ্রামের মাধ্যমে তার জন্য কিছু করতে পারি কিনা, আমি এই চিন্তাটাই করি। ওরা (বিদেশ ফেরত ভুক্তভোগীরা) যখন আমাকে দেখে একটা হাসি দেয়, তখন মনে হয় আমার আর কিছুর প্রয়োজন নেই। ওরা যখন বলে আয়েশা আপা, আপনাদের সহযোগিতা পেয়ে আমি ভালো আছি, তখন মনে হয় এটাই আমার বড় পুরস্কার।’
সমাজের নির্যাতিত নারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘যার যেখানে জীবন থেমে গেছে, কেউ যদি মনে করে আমার আর পাওয়ার কিছু নেই, সে ধারণাটা ভুল। মনে সাহস রাখতে হবে। আমি যখন নতুন করে জীবন শুরু করতে চেয়েছি, তখন আমার কাছে টাকাও ছিল না, শিক্ষাগত যোগ্যতাও বেশি ছিল না। আমার শুধু সাহস ছিল, যার জন্য আজ আমি বেঁচে আছি।’