সময়ের অস্থিরতা কমেনি এতটুকু। নতুন বছরকে উপলক্ষ্যে রেখে বিশ্ব নেতৃত্বের পক্ষ থেকেও এমন কোনো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কোনো শব্দ উচ্চারিত হয়নি যে, পৃথিবীর মানুষের বেদনা লাঘবের জন্য তারা লড়াই করে যাবে। ফলে বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা সংশয়ের পুনরাবৃত্তি এবছরও বিশ্বকে অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। এবছরও যুদ্ধ, সংঘাত আর নিপীড়নের শিকার হয়ে শুধু নিজেকে এবং প্রিয়জনদের জীবন বাঁচানোর তাগিদে হাজার হাজার মানুষ জন্মভূমি ছাড়তে বাধ্য হতে পারে, বাধ্য হতে পারে স্বদেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে। সবমিলিয়ে অভিবাসী পরিচয়ে হাজারো মানুষের সীমানা পেরোনোর সারি চলতি বছর বর্তমান থাকার ইঙ্গিত স্পষ্ট।
২০২০ সালে হাজার হাজার অভিবাসী কেউবা মরুভূমি, সাগর, পাহাড় ও পর্বতমালা পাড়ি দিয়েছে,কেউবা বনের মধ্য দিয়ে হেঁটে হেঁটে ইউরোপের কাঙ্খিত দেশে প্রবেশের চেষ্টা করেছে, যা কিনা মারাত্বক বিপর্যয় ডেকে এনেছিল অভিবাসীদের জীবনের ওপর। স্বপ্নের দেশগুলোতে ঢুকতে গিয়ে অনেকেরই সলিল সমাধি হয়েছে সমুদ্রের ঢেউয়ের তোড়ে, আবার অনেকেই লিবিয়ার ডিটেনশন সেন্টারগুলোর মতো জায়গায় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আবার অনেকেই গ্রিসের মোরিয়া শরণার্থী শিবিরে লাগা আগুনে পুড়ে নিঃস্ব হয়েছেন, হারিয়েছেন মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু।
এই তো কদিন হলো, নতুন বছর শুরু হয়ে গেছে। হাজারো মানুষ নতুন জীবন আর ভবিষ্যতের সন্ধানে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অভিবাসনপ্রত্যাশী এইসব মানুষদের ইউরোপের সীমান্ত জয়ের পথে চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকির নানা বিষয় নিয়ে সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান কথা বলেছে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ, স্বেচ্ছাসেবক ও উন্নয়নসংস্থায় জড়িতদের সঙ্গে। গার্ডিয়ানের বিশ্বেষণ অভিবাসী ডটকম এর পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলো:
বলকান রুট
গত বছরের জুলাইয়ে উত্তর আফ্রিকার সাতজন নাগরিক সার্বিয়ার এক রেলওয়ে ইয়ার্ডে একটি শিপিং কনটেইনারে চেপেছিলেন, উদ্দেশ্য ছিল একটাই-কিছুদিনের মধ্যে স্বপ্নের শহর মিলানে যাওয়া। এর তিন মাস পর ২৩ অক্টোবর প্যারাগুয়ের কর্তৃপক্ষ তাদের পঁচে যাওয়া দেহবাশেষ উদ্ধার করে। বলকান দেশগুলোর নিরাপত্তা বাহিনিগুলোর সহিংসতার কারণে মানুষজন ইউরোপে পৌঁছানোর জন্য এভাবেই ঘোরতর ঝুঁকি নিতে বাধ্য হয়।
ইউরোপের দেশগুলোর সাথে সার্বিয়ার সীমান্ত কার্যত ২০১৮ সাল থেকে বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে শরণার্থীরা বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা হয়ে ক্রোয়েশিয়া ঢোকার চেষ্টা চালায়। এই পথের ব্যবহার শুরু হয় মূলত তুরস্ক থেকে। এখান থেকে অভিবাসীরা বুলগেরিয়া অথবা গ্রিস ঢোকার চেষ্টা করে। এরপর সেখান থেকে মেসিডোনিয়া অথবা সার্বিয়ায়। সেখান থেকে বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও স্লোভেনিয়ায়। এরপর এখান থেকেই চূড়ান্তভাবে ইতালি ও অস্ট্রিয়ায় প্রবেশ করে।
বলকান রুটের একেবারে শেষপ্রান্ত, যা পেরোতে গেলে পর্বত ও তুষারে ঢাকা জঙ্গলসহ নানা দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয় একজন অভিবাসীকে। জায়গাটি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সবচেয়ে দীর্ঘতম বহিঃমুখী সীমান্ত, যা কিনা ভয়ংকর ও ঝুঁকিপূর্ণ। যেখানে টহলরত ক্রোয়েশিয়ান পুলিশের স্কোয়াড্রনাস দিয়ে পাশবিকভাবে পুশব্যাকের ঘটনা ঘটানো হয়। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বরের মধ্যে ক্রোয়েশিয়া থেকে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা পর্যন্ত ১৫ হাজার ৬৭২টি পুশব্যাকের ঘটনা রেকর্ড করেছে ড্যানিশ রিফিউজি কাউন্সিল (ডিআরসি)। এছাড়া ৬০ শতাংশের বেশি মামলা সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত বলে প্রতিষ্ঠানটি তথ্য তুলে ধরেছে
বসনিয়ায় কর্মরত ডিআরসি’র কান্ট্রি ডিরেক্টর নিকোলা বে বলেছেন-‘২০২০ এ কোভিড-১৯ মহামারির কারণে পশ্চিম বলকান রুটে অভিবাসীদের ঢল কমেছে।‘ গত বছর ১৫ হাজার ৫৩ জন মানুষ বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় প্রবেশ করেছিলে। যা কিনা ২০১৯ সালের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। ওই বছর এ অঞ্চলে ঢুকেছিল প্রায় ২৯ হাজার ১৯৬ জন। ‘কিন্তু সত্যিকারের কোনো সুরাহার অনুপস্থিতিতে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় প্রবেশকারীদের মানবিক পরিস্থিতি অগ্রহণযোগ্য ও অমর্যাদাকর হয়ে উঠছে’ বলে তিনি মন্তব্য করেন ।
এদিকে গত ডিসেম্বরে, বসনিয়ায় আগুন লেগে শরণার্থী শিবির ধ্বংস হয়ে যায়। যদিও আইওএম শরণার্থীদের জন্য যথাযথ আবাসস্থল নির্মাণের প্রচেষ্টা শুরু করেছিল তৎক্ষণাৎ। আগুন লাগার এই ঘটনার পর শরণার্থীরা সংকটে পরলে বসনিয়া সরকারের কাছে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। এছাড়া ওখানকার শরণার্থীরা বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যেও তীব্র প্রতিবাদে মাঠে নেমে পড়েছিল।
আট সেপ্টেম্বর রাতে লেসবসের গ্রিক আইল্যান্ডের মোরিয়া শরণার্থী শিবির, যা কিনা ইউরোপের অন্যতম প্রধান ও বৃহৎ শরণার্থী শিবির হিসেবে পরিচিত, সেখানে আগুন লাগে। এরপর সরকার এই আইল্যান্ডে চার মাসের জন্য জরুরী অবস্থা জারি করে। এর ফলে হাজার হাজার আশ্রয়প্রার্থী বাস্তুচ্যূত হয়ে পড়ে। ১৫ হাজারের বেশি পুরষ, নারী ও শিশু দ্বীপটিতে অমানবিকতার মুখোমুখি হয়ে অবর্ণনীয়ভাবে জীবন পার করছে। তারপরও তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণের সুতো একটুও ঢিলে করা হয়নি।
ভূমধ্যসাগর রুট
নভেম্বরে, মাত্র তিনদিনের ব্যবধানে ভূমধ্যসাগরে চারটি জাহাজডুবির ঘটনায় ১১০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। এর মধ্যে কমপক্ষে ৭০ জনের মরদেহ পশ্চিম লিবিয়ার আল খুমসের তীরে হারিয়ে গেছে। শীতের সুন্দর আবহাওয়ার সুবিধাগত কারণে, দালালরা শত শত মানুষকে সাগরের বুকে ঠেলে দিয়েছিল। যাদের বেশিরভাগকেই বরণ করে নিতে হয়েছিল ট্র্যাজেডিকে।
গত বছর মধ্য ভূমধ্যসাগরের রুটে কমপক্ষে ৫৭৫ জন মানুষ মারা গেছে। আইওএম এর মতে, এ সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই আরো বেশি। রুটটি ব্যবহার করা মানুষেরা লিবিয়ার ত্রিপোলি বা জুওয়ারা অথবা তিউনিসিয়ার স্ফাক্স থেকে ছোটো নৌকায় করে সিসিলিয়ান দ্বীপপুঞ্জ ল্যাম্পেডুসা বা মাল্টায় আসে।
করোনা মহামারির শুরুর দিকে ইতালি ও মাল্টা তাদের বন্দর বন্ধ ঘোষণা করেছিল। রোম ‘কোয়ারেন্টাইন নৌকা’ চালু করেছিল, যেখানে অভিবাসীদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হতো, যা কিনা মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মাধ্যমে সমালোচিত হয়েছিল। প্রোঅ্যাকটিভা ওপেন আর্মস এর প্রতিষ্ঠাতা ওস্কার ক্যাম্প জানান- ‘নৌকাটিতে পর্যাপ্ত ঔষুধের ব্যবস্থা ছিল না। স্বাভাবিকভাবে সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছিল।’
স্টিফেন ওবেরেট বলেন, ‘সত্যিই এটা অনুমান করা খুবই কঠিন যে, চলতি বছর কী ঘটবে। ‘কিন্তু আমাদের কাছে যে বার্তা আছে, তা আমাদের জন্য একটু হলেও আশার সঞ্চার করছে। তাহলো গ্রিক আইল্যান্ডে আসার জন্য যারা প্রস্তুতি নিয়েছে তাদের অবস্থা উন্নতি লাভ করবে নতুবা দমন ও বাধার ওপর ভিত্তি করে ইউ তাদের পদ্ধতি ত্যাগ করবে।’