ইতালিতে তরুণ অভিবাসীদের জীবনে রং ছড়াচ্ছে স্ট্রীট আর্ট

0
761

১৮ বছর বয়সী সুমন হাসান (ছদ্মনাম), ১০ মাস আগে বাংলাদেশ থেকে ইতালিতে এসেছিলেন, কিন্তু ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে মানব পাচারকারীদের সঙ্গে তার সেই দুঃসহ ভ্রমণের স্মৃতি এখনও তাড়া করে বেড়ায় তাকে।

‘একটি ছোট নৌকায় ১৫৬ জনকে ঠাসাঠাসি করে বসানো হয়েছিল। সেখানে নারী ও শিশু ছিল। সুমন বলছিলেন- ঢেউগুলো যেন নৌকার ভেতর উপচে পড়ছিল। নৌকার সব যাত্রীরা তখন প্রাণভয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। বেঁচে থাকার কোনো আশা ছিল না আমাদের।’

ইউরোপে উন্নত জীবনের সন্ধানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সুমন স্থলপথে লিবিয়া পৌঁছানোর আগে দুবাই হয়ে আকাশপথে মিশরে এসেছিলেন। তিনি ত্রিপোলিতে একটি সুপার মার্কেটে এক বছর কাজ করেছিলেন ওয়েল্ডার হিসাবে – যেখানে তাকে ১১ দিন জেল খাটতে হয়েছিল। জেলের মধ্যে তাকে নির্যাতনও করা হত এবং তার বাবা -মা মুক্তিপণের টাকা পাঠানোর পরেই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।

সুমন সামনের রাস্তার কোনায় আঁকা হতে থাকা একটি বিশাল শিল্পকর্মের দিকে তাকিয়ে জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে বলে যায় লিবিয়ার কারাগার সম্পর্কে, ‘পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ ছিল ওখানে। কখনও কখনও আমাদের সারাদিনে মাত্র একটি বানরুটি এবং ছোট এক বোতল পানি দেওয়া হত।’

ইতালিতে হাজার হাজার তরুণ অভিবাসীদের জীবনের গল্প ঠিক এইরকমই। বছরের শুরু থেকে মহামারি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি ৩৯,০০০ অভিবাসীও নৌকায় করে দেশটিতে পৌঁছেছে । ১২ মাস আগের একই সময়ের তুলনায় সংখ্যাটি দ্বিগুণ। এদের মধ্যে প্রায় ছয় ভাগের এক ভাগ ১৮ বছরের কম বয়সী অপ্রাপ্তবয়স্ক, যারা তাদের বাবা-মা ছাড়া একাই আসে। বিশেষজ্ঞরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি আরও অভিবাসী আগমনের কারণ হতে পারে।

ইতালিতে ক্রমাগত বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং অভিবাসন খাতে সরকারি সম্পদের স্বল্পতার কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিবাসনের সবচেয়ে বড় হটস্পটের এই দেশে বহু নতুন অভিবাসীদের কষ্টকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে।

এরই মধ্যে আশার আলো দেখিয়েছে একটি উদ্ভাবনী প্রকল্প । ২০১৯ সালে ইতালিতে চালু হয়েছে মাতেরার এটেলিয়ার ডি’আর্ট পাবলিকা (এমএএপি)। যা  ইতালিতে চলমান কয়েকটি উদ্যোগের মধ্যে একটি। প্রকল্পটি ইতালিতে আসা নতুন অভিবাসীদের সংহত করার জন্য পাবলিক আর্ট ব্যবহার করছে। বার্সেলোনা-ভিত্তিক স্ট্রিট আর্ট শিল্পী মোহাম্মাদ ল গচাম এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে অভিবাসীদের সঙ্গে যোগদান করেছেন। টানা ১৭ দিন দক্ষিণ ইতালির একটি দুর্গম অঞ্চল বাসিলিকাটার তিনটি শহরে প্রকল্পের কাজ করেছেন তারা। প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল প্রতিটি স্থানের একটি ভবনকে উঁচু ম্যুরালে রুপান্তরিত করা।

সান চিরিকো রাপারোতে এটেলিয়ার ডি’আর্ট পাবলিকা স্ট্রিট আর্ট প্রকল্পে অংশ নেয়া তরুণরা। ছবি: পিয়ারপাওলো সাররা/এমএএপি

সান চিরিকো রাপারোতে ল গচাম একটি স্থানীয় কেন্দ্রে অবস্থানরত ১১ জন তরুণ অভিবাসীদের একটি দলের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। যদিও শিল্পী একাই ম্যুরাল আঁকার কাজটা করছিলেন, কিন্তু তিনি তরুণ অভিবাসীদেরকে আঁকার সৃজনশীল প্রক্রিয়ার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করছিলেন। নকশার বিষয়বস্তু কি হতে পারে সে বিষয়ে তাদের কাছ থেকে ধারণা চাইছিলেন তিনি।। কীভাবে রং মিশ্রিত করতে হবে তা শিখিয়ে দিচ্ছিলেন গচাম। ধীরে ধীরে বিকশিত হতে থাকা ম্যুরালটি শহরের একটি কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। মফস্বল গোছের মাত্র ১০০০ জনসংখ্যার শান্ত এই শহরটির রাস্তাকে প্রাণবন্ত করে তুলেছিল ম্যুরালটি।

প্রকল্প আয়োজকরা তরুণ অভিবাসীদের ছোট গোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। অংশগ্রহণকারীরা তাদের অতীত নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। কৌতুহলী বাসিন্দারাও কথোপকথনে যোগ দেন।

প্রাচীরের উজ্জ্বল রংগুলি অংশগ্রহণকারীদের অন্ধকার অতীতের গল্পের সঙ্গে সম্পূর্ণ বৈপরীত্য ফুটিয়ে তোলে। ১৭ বছর বয়সী নকিয়া (ছদ্মনাম), মাত্র ১০ বছর বয়সে মিশর থেকে যাত্রা করে এবং ছয় বছর রাস্তায় কাটিয়ে তুরস্ক, গ্রীস এবং বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় কাজ করেন। এরপর একটি লরিতে করে ক্রোয়েশিয়া এবং স্লোভেনিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করেন। ১৫ বছর বয়সী গাম্বিয়ান সোলায়মান (ছদ্মনাম), লিবিয়ায় যাওয়ার আগে মালি এবং নাইজারে কাজ করেছিলেন।

সান চিরিকো রাপারোতে একটি দেয়ালে ম্যুরাল আঁকছেন শিল্পী মোহাম্মাদ ল গচাম। ছবি: পিয়ারপাওলো সাররা/এমএএপি

সোলায়মান, যিনি চারবার জেল খেটেছিলেন, তিনি তার শরীরের একটি দাগের দিকে ইঙ্গিত করেন বলেছিলেন যে, একজন প্রহরী তার কব্জি কেটে দিযেছিল। এসময় সুমন তার জামার কলার ভাঁজ করে কারাগারে তাকে কিভাবে সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়া হয়েছিল তা দেখাতে থাকেন।

ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন এর তথ্যানুসারে, লিবিয়া থেকে ইতালিতে পৌঁছানোর জন্য অভিবাসীদের মধ্য ভূমধ্যসাগরের ১৮০-২৫০ মাইল পথ অতিক্রম করতে হয়।

সোলায়মান বলেন, ‘যখন আপনি ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করেন, তখন তিনটি ফলাফল পাওয়া যায়, হয় আপনি ইতালিতে পৌঁছাবেন, নাহয় আপনি লিবিয়ানদের হাতে ধরা পড়বেন অথবা আপনি ডুবে যাবেন।’

সান চিরিকো রাপারোতে ল গচাম এর আঁকা ম্যুরাল রাস্তার নীচের ধূলিকণায় যেন অভিবাসীদের দুঃসহ জীবনকে প্রতিফলিত করছে । নকশায় দেখানো হয়েছে যে, একজন মহিলা একটি খোলা দরজার পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন, সামনে রাতের খাবারের জন্য রাখা একটি টেবিল, অল্পবয়সী অভিবাসীদের যোগাড় করা একটি নৌকা, একটি ঐতিহ্যবাহী আফ্রিকান ড্রাম এবং পাকিস্তানের ইসলামাবাদের ফয়সাল মসজিদের একটি ছবি।

অল্প বয়স্ক অভিবাসী এবং ইতালীয় শিশুরা ম্যুরাল আঁকার দৃশ্য দেখতে থাকে একটি প্যাকেট থেকে কার্ড সংগ্রহ করে তার উপর লেখা শব্দগুলি নিয়ে আলোচনা করতে থাকে তারা। বাসিন্দারা তাদের বাড়ি থেকে ফল, কফি এবং লিমনসেলো দেওয়ার জন্য বেরিয়ে আসে।

শিল্পী গচাম এর আঁকা এই ম্যুরাল ইতালীয় সমাজে নতুন অভিবাসীদের প্রবেশের প্রতীক। শিল্পের সৌন্দর্য এখানেই যে, এটি মানুষকে একত্রিত করে। মিশর থেকে আগত ১৭ বছর বয়সী করিম বলেন।-‘আমরা চিরকালের জন্য সান চিরিকোতে হয়ত থাকব না, তবে এখানে আমরা আমাদের চিহ্ন রেখে গেছি।’

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here