‘বিদেশ নিয়ে মানুষ যে গল্প শোনে, সেই গল্পের বিদেশ আর বাস্তবতা ভিন্ন জিনিস। যখন বিদেশ গিয়ে আপনি কাজ পাবেন না, না খেয়ে থাকবেন কিংবা ঘুমানোর জায়গা পাবেন না, তখনকার সেই অসহায়ত্ব ভাষায় প্রকাশ করা যায় না’- অভিবাসী ডটকমকে বলছিলেন খুলনার দাকোপ উপজেলার ওমান ফেরত প্রবাসী আব্দুর রহমান।
২০১৬ সাল, এক বুক স্বপ্ন নিয়ে ওমানে পাড়ি জমান আব্দুর রহমান। নানা চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে করোনা মহামারির ছোবলে কাজ হারিয়ে গত বছর দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
মূলত, এক আত্মীয়ের (দালাল) মাধ্যমে ওমানে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন জনাব রহমান। তিনি তখনও ভাবতে পারেননি, তার জন্য অপেক্ষা করছে প্রতারণার ভয়ংকর সব ফাঁদ। একে একে তিনি আবিষ্কার করতে থাকেন দালালদের নানা ছদ্মবেশী কর্মকাণ্ড।
মাদ্রাসা পড়ুয়া হওয়ায় রহমানকে ওমানে মসজিদের ইমামের চাকরির প্রলোভন দেখানো হয়; সঙ্গে মোটা অংকের বেতন পাওয়ার আশ্বাস তো ছিলই। জমি বন্ধক রেখে, আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে ধার দেনা করে এবং এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ টাকা দালালের হাতে তুলে দেন জনাব রহমান।
ভিসা বদল
ওমানে পৌঁছানোর পর রহমান জানতে পারলেন, চাকরির পাওয়া তো দূরে থাক, দালালরা তাকে ওয়ার্ক ভিসার পরিবর্তে ট্যুরিস্ট ভিসায় নিয়ে এসেছে। ‘আমার কোনো কাজ ছিল না, তাই দিনের বেশিরভাগ সময় না খেয়ে থাকতে হতো। এমনকি রাতে ঘুমানোরও জায়গা ছিল না’- বলছিলেন রহমান।
‘বিদেশ নিয়ে মানুষ যে গল্প শোনে, সেই গল্পের বিদেশ আর বাস্তবতা ভিন্ন জিনিস। যারা বিদেশ যায়নি তারা ছাড়া এ কষ্ট আর কেউ বুঝবে না। যখন বিদেশ গিয়ে আপনি কাজ পাবেন না, না খেয়ে থাকবেন ঘুমানোর জায়গা পাবেন না, তখনকার সেই অসহায়ত্ব ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।’
এভাবে কেটে যায় তিন থেকে চার মাস। আব্দুর রহমান একদিন জানতে পারেন, ওমানে মসজিদে ইমামের চাকরি দেয়া হয় সরকারিভাবে শুধু স্থানীয়দেরকে। তার বুঝতে বাকি থাকে না, তাকে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তারপর ওমানে কাজের কোনো ব্যবস্থা করতে না পেরে পুলিশের সহায়তায় শুণ্য হাতে দেশে ফিরে আসেন তিনি।
দেশে ফেরার পর তার জন্য অপেক্ষা করছে চার লক্ষ টাকার ঋণের বোঝা। আবারো দিশেহারা হয়ে পড়েন রহমান। কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে, বাধ্য হয়ে আবারো ওমান যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ওমানে পরিচয় হওয়া আরেক ব্যক্তির কাছ থেকে আশ্বাস পান, কোনো একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিবেন তিনি। সেক্ষেত্রে ওয়ার্ক ভিসা ইস্যু করে তাকে আনা হবে, কিন্তু ভিসায় উল্লিখিত কাজের পরিবর্তে অন্য কাজ করতে হবে তাকে।
সেই শর্তে রাজি হয়ে পুনরায় ওমান চলে যান রহমান। এবার গাড়ি ধোওয়া-মোছার কাজ পান তিনি। এ কাজেও শর্ত জুড়ে দেয়া হয় তাকে। মাসিক চুক্তিতে গাড়ি প্রতি ৫-১০ রিয়াল করে দেওয়া হবে থাকে। আবার তাকে কাজ করতে হবে পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে, রাতের বেলা।
‘আমরা রাত দশটার পরে বের হতাম, দুই ঘন্ট কাজ করতাম। আবার রাত তিনটায় বের হয়ে দুই ঘন্টা করে কাজ করতে পারতাম। বাসার নিচে পার্কিং করা গাড়ি ধোয়া-মোছাই ছিল আমাদের কাজ। মাঝেমধ্যে আমাদের ভেতর থেকে অনেকে ধরাও পড়তো পুলিশের কাছে। তারপর পুলিশের কাছে অনুনয়-বিনয় করে, বুঝিয়ে কাউকে হয়তো ছাড়িয়ে আনা সম্ভব হতো, আবার কাউকে শাস্তি পেতে হতো-বলছিলেন রহমান।’
‘ভাল’ গল্পের নতুন ফাঁদ
ওমানে বাংলাদেশি কিছু দালাল রহমানকে পরামর্শ দিত তার এলাকা থেকে লোক এনে দিয়ে তাদের সাহায্য করার জন্য। ‘তারা আমাকে বলতো- তুমি শুধু বাড়িতে তোমার পরিচিতদের ফোন করে বলবে, আমি অনেক ভাল আছি, এখানে এসে ভাল একটি কাজ পেয়েছি, তোমরাও চলে আসো। এসমস্ত আশ্বাস দিয়ে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে। আর এভাবে যদি আরো লোক আনতে পারিম তাহলে আমাকে বড় অংকের টাকা দেওয়া হবে। একজন পুরুষ আনতে পারলে ৫০ হাজার টাকা, আর নারী হলে ২০ হাজার টাকা করে পাবে। এর বাইরে তুমি তার কাছ থেকে আরো যত টাকা নিয়ে পার। তোমাকে এখানে অন্য কোনো কাজ করা লাগবে না তখন।’
অভিবাসী ডটকম এর সঙ্গে আলাপচারিতায় আব্দুর রহমানের বর্ণনায় উঠে আসে আরো ভয়াবহ প্রতারণার তথ্য। তিনি বলেন, ‘ওমানে কর্মী হিসেবে কাজ পাওয়ার বৈধ প্রক্রিয়া হচ্ছে- নিয়োগকর্তা কর্মীর ভিসা, মেডিকেল ও যাতায়াত বাবদ এবং সেই কর্মীর পরিবারের তিন-চার মাসের ভরণপোষণ বাবদ (প্রায় এক লক্ষ টাকারও বেশি) অর্থ পরিশোধ করে দিবে। কিন্তু দেখা যায়, বাংলাদেশে দালালরাই নিয়োগকর্তার কাছ থেকে এসব ভিসার কাজ সম্পন্ন করে থাকে। ফলে ওই টাকাটা দালাল আত্মসাৎ করে। তাছাড়াও যিনি কাজ করতে আসছেন, তার কাছ থেকেও আবার অতিরিক্ত টাকা দালাল নিয়ে নিচ্ছে।’
‘তারা আমাকে বারবার এ কাজে যুক্ত হওয়ার জন্য জোর করতে থাকে। এলাকার প্রায় সবার কাছেই আমাদের পরিবারের একটা বিশ্বাসযোগ্যতা আছে। তাই আমি চাইলেই অনেককে এভাবে রাজি করাতে পারতাম। কিন্তু আমি ভাবতাম, আমার মতো আর কেউ যেন এমন বিপদে না পড়ে’-বলছিলেন রহমান।
আব্দর রহমান সিদ্ধান্ত নেন, এসব মানুষদেরকে সে যেন সতর্ক করতে পারে। ‘ওমানে আসতে ইচ্ছুক এরকম অনেকের পাসপোর্টের কপি থাকতো দালালদের কাছে। তারা ঘুমিয়ে পড়লে, তখন আমি খুব সুকৌশলে পাসপোর্টগুলো থেকে গোপনে সেইসব ব্যক্তির ফোন নম্বর লিখে নিতাম। তাদেরকে বোঝাতাম, যেন ঋণ-দেনা করে তারা এই ভিসায় ওমানে আসার চেষ্ট না করে। এসব দালালদের প্রতারণার কৌশল ও মিথ্যা আশ্বাসের ধোকায় যেন না পড়ে। এভাবে প্রায় বেশ কয়েকজনকে দালালদের হাত থেকে বাঁচাতে পেরেছি’-বলেন রহমান।
আরো পড়ুন ওমানে ভালো নেই বাংলাদেশের নিম্ন আয়ের শ্রমিকরা
যেভাবে তৈরি হয় নকল ভিসা
এমনকি ওমানে টাকা দিয়ে নকল ভিসার কপি বানানো যায়। আব্দুর রহমানের বর্ণনায় উঠে আসে এমনই চাঞ্চল্যকর ঘটনা- ‘অনেক বাংলাদেশি দালাল ১০ ওমানি রিয়াল বা আড়াই হাজার টাকা দিয়ে অবিকল আসল ভিসার নকল কপি করিয়ে নিত। শুধু নাম আর তারিখ পরিবর্তন করে সেখানকার ইমিগ্রেশন অফিসের কর্মকর্তাদের সিল স্বাক্ষর ঠিক রাখা হতো। যেটা দেখে বোঝার উপায় থাকতো না, এটি আসল না নকল ভিসা। অর্থাৎ, দালাল খরচ করলো আড়াই হাজার টাকা, আর সেই ভিসা দিয়ে বাংলদেশি ব্যক্তিদের কাছ থেকে চার-পাঁচ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিল।’
ভিসা দেওয়ার পর বিভিন্ন অজুহাতে দালালরা কর্মীদের ঘোরাতে থাকে। এ প্রসঙ্গে জনাব রহমান বলেন, ‘অনেককে কিছু টাকা পয়সা ফেরত দিয়ে মিটমাট করে নেয়, আবার কাউকে ‘ফ্রি ভিসা’ (যে ভিসা দিয়ে কোনো কাজ পাওয়া যায় না) ধরিয়ে দিয়ে ওমানে এনে ছেড়ে দেয়। আবার অনেক নারী কর্মীদের কোনো পরিবারের কাছে গৃহকর্মী হিসেবে বিক্রি করে দেয় তারা। সেখানে নারীরা নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়।’