মোঃ শফিকুর রহমান
ত্রিশোর্ধো মোমেনা বেগম কাজ করতেন মগবাজারের একটি রেস্তোরাঁয়। নদী ভাঙ্গনে হারিয়েছেন ভিটেবাড়ি, সহায় সম্বল। বছর তিনেক আগে জীবিকার সন্ধানে তাই পরিবার নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন বরিশাল থেকে ঢাকা। তিন শিশু সন্তান আর স্বামীকে নিয়ে মাথা গোজার একটু ঠাঁই পেয়েছিলেন বস্তির খুপরি ঘরে।
কিন্তু করোনার থাবায় এই আশ্রয়টুকুও হারাতে হচ্ছে তাদেরকে। লকডাউনে রেস্তারাঁ বন্ধ থাকায় ছাঁটাই করা হয়েছে তাকে, দিনমজুর স্বামীও কর্মহীন। আহার যোগানোর সব রাস্তা তাই বন্ধ। এমন অজস্র গল্প এখন ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে।
বিশ্বের অন্যতম জনবহুল শহর ঢাকা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর তথ্য মতে, বর্তমানে ঢাকা শহরে বসবাস করছে ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ এবং প্রতি বর্গকিলোমিটারে এই সংখ্যা ৪৩ হাজার ৫০০জন ।
এই শহরে প্রতিদিন ১ হাজার ৭০০ মানুষ নতুন করে প্রবেশ করছে শুধু জীবন ও জীবিকার আশায় । খরা, বন্যা, অতিবৃষ্টি, নদী ভাঙ্গন, ব্যবসার মুলধন নষ্ট, কর্মের অভাব প্রভৃতি কারণে এই মানুষগুলো রঙ্গিন স্বপ্ন নিয়ে একটু সুখ ও স্বাছন্দ্যের আশায় ছুটছে শহরের দিকে ।

ঢাকা শহরে নিন্মবিত্ত শ্রেণির একটা বড় অংশ পোশাক শ্রমিক হিসাবে কর্মরত। পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্যমতে, দেশে পোশাক শ্রমিকের সংখ্যা ৪২ লাখ। যার সিংহভাগই ঢাকায় অবস্থিত।
এক গবেষণায় বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতের কারখানাগুলোতে বেতন, ভাতা ও কর্মপরিবেশসহ নানা কারণে শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা প্রায়ই ঘটে। তবে এর সমাধানের জন্য কোন স্থায়ী ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত হলেও এখানে শ্রমিক, মালিক এবং সরকার এই তিন পক্ষের প্রতিনিধিত্ব আছে এমন কোন স্থায়ী কাঠামো এত দিনেও গড়ে উঠেনি।
বর্তমান করোনা মহামারির প্রভাবে এই শ্রমিকদের জীবনে নেমে এসেছে ঘোরতর অন্ধকার। বেতন না পাওয়া, কারন ছাড়াই ছাঁটাই ,লে অফ ইত্যাদির কারনে শ্রমিকরা মানসিক দ্বন্দ্বে দিন পার করছেন।
এর পরের অবস্থানে আছে রিক্শা শ্রমিকরা। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার রাইটস বা ‘বিলস’ নামে একটি শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠানের জরিপে ওঠে এসেছে, ঢাকা শহরে বর্তমানে ১১ লাখ রিকশা আছে এবং রিকশা শ্রমিকের সংখ্যা ২৭ লাখ ।
সংস্থাটির তথ্যমতে, এই শ্রমিকদের ৯৪ শতাংশই শারীরিক ভাবে কোনো না কোনো অসুস্থতায় ভুগে থাকেন। যাদের মধ্যে আবার ৩০ শতাংশই জন্ডিসে আক্রান্ত। তবু্ও তারা শ্রম দিচ্ছেন পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে ।

এমনি করে হকার্স, দিনমজুর, বিপনন কর্মী, নিম্ন আয়ের চাকুরিজীবী, এনজিও কর্মী, ফুটপাতের ব্যবসায়ী, চাকুরি প্রার্থী, টিউশনি করে জীবন চালোনো ছাত্রসহ অসংখ্য নিম্ম আয়ের মানুষরা যাদের হাত চললে পেট চলে আর হাত বন্ধ থাকলে পেটও বন্ধ; এই সকল মানুষরা আজ ভীষণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এই মহামারির কবলে পড়ে।
আমরা জানি ঢাকা শহরে অধিকাংশ শ্রমিক ও নিম্ম আয়ের মানুষ একা বসবাস করেন। করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হলে তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাবে কে?
কে তার সেবা করবে?
কে পাশে থাকবে?
হাসপাতালে অর্থাভাবে তার চিকিৎসা হবে তো?
যান চলাচল বন্ধের এই সময় পাশে আসতে পারবে কি তার প্রিয়জন?
মৃত্যুর পর তার মরদেহ দাফন করতে পারবে কি তার আপনজনেরা?
এতসব প্রশ্নের উত্তর মেলাতে না পারা অনেককেই বেছে নিতে দেখা গেছে আত্মহননের পথ। আর শেষ পর্যন্ত বেঁচে যাওয়া ভাগ্যবান মানুষটির সামনে তখন অবশিষ্ট যে প্রশ্নটি ঘুরপাক খায়, তা হল- আহার যোগানোর কর্মসংস্থানটুকু টিকে থাকবে তো?
এ রকম হাজারো চিন্তা, দুঃস্বপ্নে, অন্ধকারের চোরাবালিতে হাবুডুবু খাচ্ছে একেকটা জীবন। এইসব মানুষেরা যে সোনালী স্বপ্নকে ধারন করে পরিবার পরিজন ফেলে অভিবাসিত হয়েছিলো ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষের এই প্রাণের শহরে, সেই স্বপ্ন আজ ধূসর। তাদের দুচোখে যেন আজ ফুটে উঠেছে চরম একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা, অমানবিকতা এবং জীবনের মূল্যহীনতা।