সিয়েরা নেভাদার পর্বতমালা থেকে শুরু করে আমাজান বন-বিস্তৃত এ অঞ্চলজুড়ে কলাম্বিয়ার অবস্থান। আর এ দেশেই রয়েছে ৯০টি ভিন্ন ভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস।
ভিন্ন ভিন্ন জাতিস্বত্তার চমৎকার এই মেলবন্ধন দেশটিকে পৃথিবীজুড়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে আদিম শেকড়ের বহতা ঘেরা অন্যতম সমৃদ্ধশালী ভূমি হিসেবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এর মধ্যে অনেক গোষ্ঠীই আজ হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় রয়েছে।
মূলত দেশটিতে বিবাদমান পক্ষসমূহের চলমান সশস্ত্র দ্বন্দ্বের বলি হয়ে বাস্তুচ্যূতির পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন আদিবাসী মানুষেরা। খোদ দেশটির সাংবিধানিক আদালতই বলছে, এরকম অস্থিতিশীলতার কারণে দেশটির উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আদিবাসী মানুষ বসতবাড়ি হারিয়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
এদিকে পরিসংখ্যান বলছে, এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৩০ লাখ মানুষ কলাম্বিয়ায় অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যূতির শিকার হয়েছে, যা কিনা পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যা।
পরিবার ও দেশ ছেড়ে বাধ্য হয়ে বাস্তচ্যূতির মুখোমুখি হওয়া এই মানুষগুলোকে পার করতে হচ্ছে কঠিন সময়। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষদের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রথার সঙ্গে তাদের নিজেদের পূর্বপুরুষদের ভিটেবাড়ির সম্পর্ক জড়িয়ে থাকে। ফলে শেকড়কে উপড়ে ফেলে যখন কিনা তাদের সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হয়, তখন তা সত্যিই হৃদয়বিদারক হয়ে ওঠে।
সিয়োনা জনগোষ্ঠীর একজন আদিবাসী বলেছিলেন, ‘আমাদের জমি হারানো মানে আমাদের নিজেদের স্বত্তাকে হারানো’ ।
সম্প্রতি তিনি তার বসতবাড়ি ফেলে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
৪০ বছরের বেশি সময় আগে কলাম্বিয়ায় শুরু হয় সশস্ত্র গৃহযুদ্ধ। বিচ্ছিন্নতাবাদী কয়েকটি সশস্ত্র গ্রুপ সরকারের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ চালিয়ে আসছে। এর মধ্যে ফারস ও ইএলএন নামের দুটি প্রধান গেরিলা বাহিনী রয়েছে। অবৈধ কোকো ব্যবসায়ের উৎপাদন ও রপ্তানি এই যুদ্ধের অন্যতম কারণ বলে বিবেচিত।
এরকম আরো ঘটনার কারণে দেশটিতে ৩০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যূতির শিকার হয়েছেন। তালিকাভূক্ত অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যূতির শিকার মানুষের মধ্যে আদিবাসীদের সংখ্যা প্রায় ৮ শতাংশ।
অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যূতির শিকার হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণসমুহের মধ্যে রয়েছে যুদ্ধ, সশস্ত্র হামলা, হুমকি, গণহত্যা, ল্যান্ডমাইন, যুবক ও শিশুদের কাজে পাঠানোর জন্য জোরপ্রয়োগের মতো বিষয়।
গত ১০ বছরে সশস্ত্র যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট সংঘাতে আদিবাসীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাপকমাত্রায়। ওএনআইসি এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯৮-২০০৮ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৯৮০ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে, আওয়া গোষ্ঠীর ১৭ জনকে হত্যার ঘটনাটি এ বছরের সবচেয়ে নিকৃষ্ট হতাযজ্ঞ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। জোরপূর্বক কাজ করানো, জমি বেদখলের মতো বিষয় অন্যতম প্রধান প্রভাবক হিসেবে কলাম্বিয়ায় বাধ্য হয়ে বাস্তুচ্যূতির সংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে, বিশেষ করে আদিবাসী মানুষ আরো বেশি অসহায় হয়ে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, যেসব জায়গায় দীর্ঘকাল ধরে আদিবাসীদের বসবাস, সেসব জায়গা জৈব গ্যাস, পেট্রোল ও কোকোর প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। এছাড়া সীমান্ত এলাকার কাছাকাছি অঞ্চলসমূহ তাদের বসবাসের প্রধান জায়গা হওয়ায় কৌশলগত কারণেও তাদের ভূমি গুরুত্বপূর্ণ।
কলাম্বিয়ায় বছরের পর বছর ধরে চলা ভয়াবহ এই মানবিক সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য একযোগে কাজ করছে দেশটির আইনপ্রণেতা, অ্যাক্টিভিস্ট ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ। বিশেষ করে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউএনএইচসিআর অবস্থা পরিবর্তনের জন্য দেশটির সরকার, বিরোধী দলসমূহসহ সবার সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করছে।
এখন দেখার বিষয়, আদতে ঠিক কখন দেশটির আদিবাসী মানুষেরা তাদের অধিকার ফিরে পেয়ে নিশ্চিন্তে শেকড় আগলে নিজেদের মাটিতেই স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারে!