দেশে বিনিয়োগে প্রবাসীদের অনাগ্রহ ও আমাদের দায়

0
592
দেশে-বিনিয়োগে-প্রবাসী
দেশে-বিনিয়োগে-প্রবাসী

বিশ্ব ব্যাংকের এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে প্রেরিত মোট রেমিট্যান্সের ২৭ শতাংশ ডায়াস্পোরা বা অনিবাসী বাংলাদেশিদের। আর বাকি প্রায় ৭৩ শতাংশে অবদান রয়েছে অভিবাসী শ্রমিকদের। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা বা আইওএম এর প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড মাইগ্রেশন রিপোর্ট ২০২২’ অনুসারে, বর্তমানে অনিবাসী বাংলাদেশির (চুক্তিভিত্তিক/ স্বল্পমেয়াদি শ্রমিক ছাড়া) সংখ্যা প্রায় ২১ লাখ ১০ হাজার, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১ দশমিক ২৮ শতাংশ।

আইওএম এর ওই একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, অভিবাসী পরিবারের প্রায় ৬০ ভাগ সম্পূর্ণভাবে পরিবারের সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য রেমিট্যান্সের উপর নির্ভরশীল। তাই স্বাভাবিক অর্থেই উপলব্ধি করা যায়, দেশের ও সমাজের উন্নয়নে প্রবাসী তথা অনিবাসী বাংলাদেশীদের অবদান কতোটা গুরুত্বপূর্ণ, যা মহামারির সময়গুলোতেও থেমে থাকেনি।

সামাজিকভাবে দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে অনেক প্রবাসীরাই এই করোনা মহামারির সময় বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। যেমন: কয়েকজন আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশির সহায়তায় দেশে প্রায় ৫০ মিলিয়নের বেশি ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হয়েছে। এছাড়া অনেকেই অসহায়দের জন্য করোনা সঙ্কটকালীন সময়ে ত্রাণ তথা জরুরি খাদ্য, চিকিৎসা ও নগদ অর্থ সহায়তা দিয়েছেন, যা দেশের প্রতি তাদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ।

অনিবাসী বাংলাদেশিরা (বিদেশে স্থায়ী নাগরিকত্ব প্রাপ্ত বাংলাদেশি, ব্যাবসায়ী, ছাত্র- ছাত্রী, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পেশাদার / দক্ষ চাকুরিরত কর্মী ও অন্যান্য) সাধারণত মোটাদাগে তিনটি কারণে দেশে রেমিটেন্স প্রেরণ করে থাকেন:

  • দেশে নিজের ব্যাংক একাউন্টে সঞ্চয় হিসেবে ।
  • স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি (যেমন জমি ও ফ্ল্যাট ক্রয়) এবং ব্যাবসায়িক বিনিয়োগের জন্য।
  • দেশে অবস্থিত আত্মীয়- স্বজনদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক প্রয়োজন মেটাতে অথবা কোন সমাজকল্যাণমূলক কাজের জন্য।

যদিও সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নেই, কিন্তু আমরা জানি বিদেশে বাংলাদেশিরা অনেকেই চাকুরি ছাড়াও বিভিন্ন ব্যবসা বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা সফলতা ও সুনামের সঙ্গে তা পরিচালনা করে আসছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, উল্লেখযোগ্য পরিমান বাংলাদেশিরা ব্রিটেন ও সৌদি আরবে রেস্তোরাঁ ও হোটেল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বেশ কয়েক বছর ধরে।

এছাড়া অনেক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রবাসী ইউরোপ ও আমেরিকাতে সুপারশপ পরিচালনা, তৈরি পোশাক, সব্জি ও মাছ আমদানি ব্যাবসার সঙ্গে জড়িত আছেন। অনিবাসী বাংলাদেশিরা যে দেশে একবারেই বিনিয়োগ করছেন না তা নয়, অনেকেই ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করার পাশাপাশি তৈরি পোশাক রপ্তানি, ফার্মাসিউটিক্যালস, চামড়া শিল্প, হোটেল ও রেস্তোরাঁ ব্যবসা, ইলেকট্রনিক্স ও আইটি খাতে বিনিয়োগ করছেন। কিন্তু সম্প্রতি প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেশ ঘাটতি দেখা গিয়েছে, যা অদূর ভবিৎষতের জন্য এক ধরণের অশনি সংকেত ।

সম্প্রতি সিলেট চেম্বার অব কমার্স থেকে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে ইংল্যান্ডে প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশি বসবাস করছেন। যাদের মধ্যে ৯০ শতাংশই সিলেট অঞ্চলের বাসিন্দা। সিলেট বিভাগের প্রায় ১৬ শতাংশ পরিবার প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থের ওপর নির্ভশীল। এসব প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে চেম্বার অব কমার্সসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান থেকে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে।

তবে এতে তেমন সুফল মিলছে না। দেশে বিনিয়োগে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না প্রবাসীরা। উপরন্তু দেশের বিনিয়োগ বিক্রি করে টাকা প্রবাসে নিয়ে যাচ্ছেন তারা। সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সিলেটের অর্থনীতি আর জীবন মানেও। কমে গেছে সিলেটের জমির দাম। এটি শুধুমাত্র সিলেটেরই চিত্র নয়, আরো অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই অনিবাসীদের প্রায় একই অবস্থা।

অন্যদিকে, ইআরডি-ইউএনডিপির অর্থায়নে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের মাত্র ২৫ দশমিক ৩২ শতাংশ ব্যাবসায়িক খাতে বিনিয়োগ হয়ে থাকে।

প্রবাসীদের বিনিয়োগে অনাগ্রহ থাকার কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা যায়:

  • বাণিজ্যিক পণ্য আমদানি ও রফতানি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা।
  • অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির সরবরাহ।
  • দক্ষ কর্মীর অভাব।
  • দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্য।
  • আমলাতান্ত্রিক জটিলতা।
  • দেশে বিনিয়োগ করে প্রতারিত হওয়া ও কাঙ্ক্ষিত মুনাফা না পাওয়া।
  • প্রবাসে ব্যবসার মন্দা।
  • জমি অধিগ্রহণে জটিলতা।
  • মেধাস্বত্ব আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাব।
  • ফান্ড স্থানন্তরে জটিলতা।
  • প্রবাসীদের নতুন প্রজন্মের দেশের প্রতি আগ্রহ না থাকা বা দেশে বিনিয়োগকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা ইত্যাদি।

এসব কারণে অনেকে দেশের সম্পদ ও বিক্রি করে দিচ্ছেন। করোনা সংকট, বৈশ্বিক চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ও সর্বোপরি ব্যবসায়ীক মন্দার কারণেও তারা বিক্রি করে দিচ্ছেন দেশের সম্পদ, উঠিয়ে নিচ্ছেন তাদের সঞ্চয় । এছাড়া আমরা তাদের দেশে বিনিয়োগের জন্য উৎসাহিত বা আকর্ষণ করার জন্য যা করছি তাও অপ্রতুল। যদিও বলা হয়ে থাকে প্রায় ১ কোটির অধিক প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন, কিন্তু প্রবাসী বন্ড বা শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ রয়েছে মাত্র ৯০ হাজার ৫০০ প্রবাসীর।

অনিবাসী বাংলাদেশিদের জন্য প্রিমিয়ার ডলার ও অন্যান্য বন্ডগুলোতে বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় মুনাফা দেয়া প্রয়োজন। শুধুমাত্র দেশে বিনিয়োগের জন্য বললেই হবে না, বরং তাদের উৎপাদন ও রপ্তানিমুখী ব্যাবসায় বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণ করার লক্ষ্যে ভূমিক্রয় বা অধিগ্রহণ, ইউটিলিটি সেবা প্রাপ্তি সহজীকরণ, লাইসেন্স বা যেকোনো ধরণের রেজিস্ট্রেশন বা ছাড়পত্র আবেদন গ্রহণ ও সেবা প্রদান ডিজিটাল ও সহজ করতে হবে।

তার পাশাপাশি অর্থ বা ফান্ড স্থানানান্তর বা ট্রান্সফার সুবিধা দিতে হবে ও রেমিট্যান্সের অর্থের বিনিয়োগের উপরে কর মওকুফের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আইনগত ও সামাজিকভাবে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে প্রবাসীদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।

বিনিয়োগ বোর্ডের প্রয়োজন বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে সময়োপযোগী উদ্যোগ নেয়া যেমন: বিশেষ ক্যাম্পেইন করা, খাতভিত্তিক বিনিয়োগে আকর্ষণীয় ছাড় প্রদান ইত্যাদি। প্রয়োজনে প্রবাসীদের বড় বিনিয়োগের জন্য পৃথক অর্থনৈতিক জোন স্থাপন করতে হবে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের কাছে সঠিকভাবে অনিবাসী বাংলাদেশিদের সংখ্যা বা ডাটা নেই। যদিও সম্প্রতি তা প্রস্তুত করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে- কিন্তু তার বেশির ভাগ নিবন্ধনকারী হচ্ছেন অভিবাসী চুক্তি ভিত্তিক শ্রমিক। আমরা চাইলে তাদের একটি ডাটাবেস করতে পারি, যার জন্য আমাদের কাজ করতে হবে: এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন বিভাগ, জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের মিশন ও হাইকমিশন সমূহ, পর্যটন কর্পোরেশন, চেম্বার অব কমার্স বা ব্যাবসায়িক এসোসিয়েশন, ব্যাংক, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় সরকারি প্রতিষ্ঠান সমূহের সঙ্গে যৌথভাবে।

প্রবাসীদের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারীদের দেশপ্রেম বা দেশের প্রতি আগ্রহ ও আকর্ষণ বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, ভ্রমণ বা পর্যটন কেন্দ্রিক আয়োজন করতে হবে – যা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও পর্যটন কর্পোরেশন যৌথভাবে করতে পারে এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশি মিশনসমূহকে এই ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে কাজ করতে হবে।

বিদেশে বাংলাদেশিদের অসংখ্য ক্লাব, এসোসিয়েশন বা সংগঠন রয়েছে- তাদেরকেও আমরা এক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারি। অর্থে, মেধায় ও কারিগরি দক্ষতায় প্রবাসীদের নতুন প্রজন্ম অনেক এগিয়ে। তাদের দেশের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। দেশে নিয়ে আসতে হবে। আমরা যদি তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের উদ্রেক করতে পারি, তাহলে তারা জন্মভূমির উন্নয়নে বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন।

লেখক: অভিবাসন বিশ্লেষক ও উন্নয়ন কর্মী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here