করোনা মহামারির দেশজ ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতি এবং জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রভাবের বলয় থেকে উত্তরণের চেষ্টায় দিশেহারা প্রবাসী শ্রমিক এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল পরিবারের সদস্যদের জীবন থেকে চলে গেলো আরও একটি বছর। নিম্নমুখী শ্রম অভিবাসন ধারা, আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারে কর্মসংস্থানের স্বল্পতা, উচ্চ অভিবাসন ব্যয়, সময়মতো ভ্যাকসিন না পাওয়ার বিড়ম্বনা, এয়ারপোর্টে করোনা টেস্টের অপর্যাপ্ততা ও বিমানের সিডিউল বিপর্যয়ের মতো প্রতিকূলতার মাঝেই পার করতে হয়েছে দেশের জন্য দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী মানুষগুলোকে ।
বছর শেষে যখন সময় আসে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিশ্লেষণ করার, তখন হয়তো তা রূপান্তরিত হয় কেবল কিছু সংখ্যায়, তথ্য-উপাত্ত, ও পরিসংখ্যানে। রাষ্ট্রীয়ভাবে এই সব প্রবাসী বা অভিবাসী কর্মীরা কেবল বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী হিসেবে গণ্য হলেও, তারা তাদের পরিবারের কাছে সর্বাগ্রে একজন মানুষ, অন্নদাতা, অর্থনৈতিক ভিত নির্মাতা, সামাজিক মর্যাদার অংশীদার; হোক তা সন্তান, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, কিংবা পিতা-মাতা, যারা আপনজনের মায়া ত্যাগ করে সবার মুখে হাসি ফোটাতে ভিন দেশে পড়ে রয়েছে বছরের পর বছর।
অভিবাসীদের অবদান রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তুলে ধরার জন্য আমরা প্রতিবছর বেশ ঘটা করে উদযাপন করি আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস, যা ১৮ই ডিসেম্বর পালন করা হয়। সরকারের পাশাপাশি বেশ কিছু বেসরকারি সংস্থাও পাল্লা দেন ওই দিবসে তাদের ও অভিবাসীদের সাফল্য তুলে ধরতে। ব্যতিক্রম নয় আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলো, তারাও তাদের বিভিন্ন প্রকল্পের সাফল্য ও অর্জন প্রচারণা করতে উদ্দমী হয়। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা বা আইওএম প্রতি বছর প্রকাশ করে অভিবাসন প্রতিবেদন; যেখানে তারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভিবাসনের গতি-প্রকৃতি ও ধরণ, গৃহীত কল্যাণমূলক কার্যক্রম- বিভিন্ন সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে উপস্থাপন করে।
যাই হোক, এই সমস্ত কর্মকাণ্ড যদিও ৭৪ লক্ষের অধিক প্রবাসী (আইওএম) শ্রমিক ও তাদের পরিবারের উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য করা হয়। কিন্তু পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শতকরা একভাগ বা তার নিচের প্রবাসীর পরিবার এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে অথবা তারা দিবসটি সম্পর্কে জানে ও উদযাপন করে।
অর্থাৎ, সেই হিসেবে ৯৯% প্রবাসী কর্মী ও তাদের পরিবার এই দিবসের তাৎপর্য সম্পর্কে জানে না বা বোঝে না। অর্থনৈতিক প্রাপ্তি ছাড়া প্রবাসী কর্মীরা যে অন্য আরও ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে- তা তাদের ধারণার বাইরে। তাই সাধারণভাবেই তারা প্রবাসী ও তাদের পরিবারের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপসমূহ ও আন্তর্জাতিক সনদ অনুযায়ী অধিকার সমূহ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন।
কোভিড-১৯ মহামারির কারণে যদিও বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় ২ মিলিয়ন কমে গেছে (আইওএম), এবং প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে অনেক অভিবাসী পরিবার। তারপরও এ বছর বাংলাদেশ হতে ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৮৯৩ জন বিদেশে গিয়েছেন (সূত্র: বিএমইটি, নভেম্বর ২০২১), যা বিগত ২০২০ সালের তুলনায় ২ লাখ ৬৮ হাজার ২২৪ জন বেশি।
কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক ও দেশভিত্তিক লকডাউনের কারণে বিগত বছর এপ্রিল থেজে জুন পর্যন্ত শ্রম অভিবাসন এক প্রকার স্থবির হয়ে পরেছিল। এমনকি যারা কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের পূর্বে শ্রম অভিবাসনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল, তারাও মহামারির কারণে অভিবাসন করতে পারেননি। অন্যদিকে, সরকারি শ্রম অভিবাস নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বিএমইটি বিদেশগামী কর্মীদের তথ্য ও সংখ্যার হিসেবে রাখলেও (যদিও তা সম্ভব হয় শুধুমাত্র কর্মীদের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করণের জন্য), বিদেশ ফেরত কর্মীদের বা দেশে প্রত্যাবর্তিত অভিবাসীদের তথ্য ও সংখ্যার কোনো সঠিক হিসেব তারা রাখেন না।
সম্প্রতি মহামারির কারণে বিদেশ ফেরত কর্মীদের কল্যাণে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ সঠিকভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০২০ সাল হতে এই তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে আইওএম এর সহায়তায় ‘রিটার্ন মাইগ্রান্ট ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (রেমিমিস)’ সফটওয়্যারের মাধ্যমে। এবং সেই হিসেবে ৪ লাখ ৮,০০০ এর অধিক কর্মী ২০২০ সালে ফেরত এসেছেন। এই উদ্যোগ যদিও একটি তাৎপর্যপূর্ণ, কিন্তু ফেরত আসা ওইসব কর্মীদের ভিতর হতে পুনরায় যিনি বা যারা অভিবাসন করেছেন – তার সমন্বয় বা ট্র্যাকিং করা সম্ভব হচ্ছে কিনা, তা চিহ্নিত করা বোধহয় এখনো শুরু হয়নি।
মহামারি প্রভাব কাটিয়ে বিদেশ ফেরত কর্মীদের কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক কল্যাণের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে ২০২০- ২০২১ অর্থ বছর পর্যন্ত ৫৩ হাজার ৩৯৬ জনকে ৭৭৬ দশমিক ১৩ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দিয়েছে। আবার দেখা যায়, চলতি ২০২০- ২০২১ সালে ১১ হাজার ৫৩০ জনকে ২৬৭ কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য সহায়তা করা হয়েছে। এই নিয়মিত ঋণ সহায়তা ছাড়াও ব্যাংকটি কল্যাণ বোর্ডের সহায়তায় করোনা মহামারি কারণে ফেরত কর্মীদের মাঝে ২০০ কোটি টাকার বিশেষ সফট লোন প্যাকেজ বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে।
যদিও জুন ২০২১ অব্দি প্রতিষ্ঠানটি মাত্র ৩ হাজার ২৪১ জন অভিবাসী কর্মীর মাঝে ৮১ দশমিক ৩৮ কোটি টাকা ৪ শতাংশ সরল সুদে ঋণ বিতরণ করতে পেরেছে- যার অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ ও চিহ্নিতকরণ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। অপরদিকে, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত মহামারির কারণে ক্ষতিগ্রস্থ অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের জন্য অভিবাসী জন্য বরাদ্দকৃত ৫০০ কোটি টাকার ঋণ তহবিল হতে জুন ২০২১ অব্দি ৮ হাজার ২৮৯ জনের মাঝে ১৮৬ দশমিক ৫৬ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এই সব ঋণ সহায়তার প্রতি বিদেশ ফেরত প্রায় ৪ লক্ষাধিক মানুষের আগ্রহ বেশ কমই। যার ফলে এই ঋণ তহবিলের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে।
আমাদের প্রাপ্তি কি ছিল?
বিগত বছরগুলোর তুলনায় ও মহামারির প্রভাব থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশ রেকর্ড ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স (২০২০ – ২০২১ অর্থ বছরে) গ্রহণ করেছে, যার সিংহভাগেই অবদান রয়েছে অভিবাসী শ্রমিকদের। প্রত্যেক অভিবাসী কর্মীর (প্রায় ৩ লক্ষাধিক) জন্য ‘সুরক্ষা’ পোর্টালের মাধ্যমে বিনামূল্যে কোভিড-১৯ প্রতিরোধক ভ্যাকসিন প্রদান, হজরত শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদেশগামী কর্মীদের জন্য আরটিপিসিআর টেস্ট বুথ স্থাপন, বিদেশ ফেরত অভিবাসী কর্মীদের ডাটাবেজ তথ্য নিবন্ধন, পুনর্বাসনের জন্য সরল ও স্বল্প সুদে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ৮৯টি শাখা হতে ঋণ বিতরণ- ইত্যাদি সবই ছিল তাৎপর্যপূর্ণ ও সময়োপযোগী উদ্যোগ।
অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে অধিকতর তথ্যসমৃদ্ধ ও সর্বত্র গ্রহণযোগ্য ই-পাসপোর্ট বিতরণ ও একটি বিশেষ কার্যক্রম ছিল, যা ভবিষ্যতে অভিবাসী কর্মীদের সময় ও অর্থ দুটোই সাশ্রয় করতে সহায়তা করবে। এছাড়া বিমান বন্দরে কর্মীদের ফ্লাইট সহ অন্যান্য জটিলতা নিরসনের জন্য ‘কুইক রেসপন্স টিম’ ও ‘প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক’ কাজ করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে, গুলশানের ভাটারাতে প্রবাসী ও অভিবাসী কর্মীদের জন্য একটি বিশেষ ‘হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার’ স্থাপন করা হবে। যা ছিল প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবি। এছাড়া বিদেশ গমন ও প্রত্যাবর্তনকালে সাময়িক অবস্থানের জন্য ঢাকা বিমানবন্দরের সন্নিকটে ‘বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স সেন্টার’ স্থাপন করা হয়েছে-যা অবশ্যই প্রবাসী কর্মীদের স্বস্তি দিবে।
৪০টি উপজেলায় বিএমইটির উদ্যোগে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে আশা করা যাচ্ছে, উপজেলা পর্যায় হতে দক্ষ শ্রমিক তৈরী ও বিদেশ প্রেরণ করা সম্ভব হবে। সেবা ডিজিটালাইজকরণের উদ্যোগ হিসেবে ‘আমি প্রবাসী’ এপ্লিকেশনের যাত্রা শুরু অব্দি প্রায় ৮ লক্ষাধিক কর্মীর রেজিস্ট্রেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমান প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আরো সুসংহত করতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের আরটিও নিবন্ধন ও এনটিভিকিউএফ এর আওতায় প্রশিক্ষকদের উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদানের লক্ষ্যে ঢাকা টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন নিঃসন্দেহে একটি কার্যকরী ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আইএলও ও ডিনেটের সহায়তায় রিত্রুটিং এজেন্সিসমূহের তথ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কার্যক্রম সম্পাদনে বিশেষ সফটওয়্যার চালু সাম্প্রতিক সময়ে একটি বিশেষ পদক্ষেপ, যা শ্রম অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় এক নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে আশা করা যায়। এছাড়া ‘প্রবাসী হেল্পলাইন’ হতে টেলিমেডিসিন সেবা গ্রহণ করেছে ৩ হাজার ২৬০ এর অধিক প্রবাসী কর্মী। সবচেয়ে বড় সুখবর হচ্ছে, ১৯ ডিসেম্বর ২০২১-এ বাংলাদেশ সরকার মালয়েশিয়ার সরকারের সঙ্গে একটি নতুন সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে, যার দরুন পুনরায় বাংলাদেশ হতে মালয়েশিয়ায় শ্রম অভিবাসন চালু হবে ও বাংলাদেশ ফিরে পেতে যাচ্ছে পুরাতন শ্রম বাজার।
আমাদের অপ্রাপ্তি কি ছিল?
সারা বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্মতা বৃদ্ধির মতোই একটি প্রধান আলোচনার বিষয় আজ অভিবাসী কর্মী, শিক্ষার্থী, পর্যটক ও ডায়াস্পোরাদের অধিকার. তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে অভিবাসীদের আইনি অধিকার ও ন্যায্যতা কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ও তার মেকানিজম কি কি রয়েছে?
যদিও অভিবাসী কর্মীদের স্বার্থ সুরক্ষায় ও অধিকার নিশ্চিতকরণের জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় অভিযোগ গ্রহণের জন্য ডিজিটালসেবা চালু করছে। যার মাধ্যমে প্রবাসীরা ও তাদের পরিবার খুব সহজেই দেশ বা বিদেশ হতে অভিযোগ দাখিল করতে পারে। কিন্তু সেই অভিযোগসমূহ কীভাবে নিষ্পত্তি হচ্ছে, কতটি এখন পর্যন্ত হয়েছে-সেই সংক্রান্ত তথ্য বা পরিসংখ্যান সংরক্ষণ করা হয় না বা ঘাটতি রয়েছে বললেই চলে।
এছাড়া বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশী মিশনসমূহ পর্যাপ্ত জনবল ও অর্থের বরাদ্দের স্বল্পতার জন্য প্রবাসী কর্মীদের আইনি সহায়তা, নির্যাতনের শিকার কর্মীদের উদ্ধার ও অন্যত্র কর্মসংস্থান, এমনকি বকেয়া মজুরি প্রাপ্তিতে সহায়তা প্রদান করতে পারে না। যেকারণে, বিশ্বব্যাপী অভিবাসীদের নিয়োগকর্তা কর্তৃক ‘মজুরি চুরি’ বা ‘ওয়েজ থেফ্ট’- বিষয়টি নজরে আসে এবং বাংলাদেশের লক্ষাধিক কর্মী মহামারি চলাকালীন বাধ্যতামূলকভাবে চলে আসায় বেশ কয়েক মাসের মজুরি থেকে বঞ্চিত হন ও দেশ হারায় বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা। যদিও কিছু উন্নয়ন সংস্থা ও অভিবাসন বিষয়ক সংগঠন এ বিষয় সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে বেশি কিছু করা সম্ভব হয়নি। এমনকি তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের জন্য সরকার কোন ধরনের জরিপ বা গবেষণার উদ্যোগও নেয়নি।
এছাড়া করোনা মহামারির প্রভাব কাটিয়ে বৈদেশিক কর্মসংস্থান সম্প্রসারণ ও চাকুরি হারানো কর্মীদের পুনঃনিয়োগ, গন্তব্য দেশেই বিকল্প কর্মসংস্থান সংক্রান্ত উদ্যোগ সরকারের বা বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি, যার ফলে অভিবাসী শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়।
নিয়মিত অভিবাসন প্রক্রিয়ায় জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতার দরুন অনেক অভিবাসন প্রত্যাশীই বেছে নিয়েছিলেন বিকল্প ও অনিয়মিত পথ, যা সরকারের পর্যাপ্ত কৌশল, নিরীক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের অভাবে মানব পাচারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করেছে। আবার দেখা যাচ্ছে, বিগত বছরগুলোর মতো এ বছরও অনিরাপদ অভিবাসন প্রতিরোধে এবং অভিবাসীদের অধিকার নিশ্চিতকল্পে রিত্রুটিং এজেন্টদের কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য ভিজিলেন্স টাস্কফোর্স ও মোবাইল কোর্ট যেভাবে পরিচালনা করা প্রয়োজন ছিল, সেভাবে নিয়মিত করা হয়নি।
জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিপদগ্রস্থ অভিবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের সামাজিক সুরক্ষার জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় হতে যে ধরণের উদ্যোগ নেয়ায় প্রয়োজন ছিল- তাও নেয়া হয়নি। আবার কল্যাণ বোর্ডের ফান্ড থেকে যতটুকুওবা নেয়া হয়েছে-তাও ছিল অপর্যাপ্ত। আবার অভিবাসীদের নির্দিষ্ট ট্রেডে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে দক্ষতা বৃদ্ধি কিংবা ফেরত অভিবাসীদের অভিজ্ঞতার স্বীকৃতির জন্য আরপিএল সার্টিফিকেশনও ছিল অপর্যাপ্ত ও সমন্বয়হীন।
আমাদের অভিবাসী কর্মীদের বিদেশে সুনাম রয়েছে কঠোর পরিশ্রম করার, তা হোক কম মজুরিতে বা স্বল্প সুযোগ সুবিধাতে। তারা বিদেশে তাদের উপার্জিত বেশিরভাগ অর্থই দেশে পাঠিয়ে দেন পরিবারের অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে। কিন্তু তাদের বেশিরভাগ পরিবারের সদস্যই জানেন না কীভাবে ও কোন উপায়ে ওই রেমিট্যান্সের টাকা সঠিকভাবে বিনিয়োগ ও তার সুষ্ঠূ ব্যবহার করবেন। তাই অভিবাসীদের টেকসই পূনর্বাসন, পুনরেকত্রীকরণ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন তাদের জন্য প্রান্তিক পর্যায়ে আর্থিক সাক্ষরতা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের আয়োজন করা এবং জেলা পর্যায়ে কল্যাণ শাখার কার্যক্রম জোরদার করা।
মোদ্দাকথা, শুধু কিছু আইন, কর্ম পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়ন করে আসলে অভিবাসীদের কল্যাণ পূর্ণাঙ্গভাবে নিশ্চিত করা দুরহ হয়ে পড়বে, যদি না তা বাস্তবায়নে সরকারের পাশাপাশি ট্রেড ইউনিয়ন, বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণ থাকে। সবার সম্মিলিত ও সমন্বিত উদ্যোগেই নিশ্চিত হতে পারে নিরাপদ ও টেকসই অভিবাসন।
লেখক: শ্রম অভিবাসন বিশ্লেষক ও উন্নয়ন কর্মী