বাড়ছে অভিবাসন, বাড়ছে সীমান্তের প্রতিবন্ধকতা

0
781

অপ্রত্যাশিত অভিবাসন রুখতে বিভিন্ন রাষ্ট্র নানান প্রতিবন্ধকতা বাড়িয়ে চলছে। বার্লিন প্রাচীর নির্মাণের ৬০তম বছর পূর্তি উপলক্ষে সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে, পৃথিবীর যেসব স্থানে প্রাচীর দেয়া হচ্ছে তা আদৌ কতটুকু কার্যকর।

হাজার মাইল দূরের দেশ হওয়া স্বত্বেও, লিথুয়ানিয়া ও ডমিনিক্যান রিপাবলিক দেশ দুটির মধ্যে খুবই নির্দিষ্ট কিছু মিল রয়েছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোয় অভিবাসনের হার বেড়ে যাওয়ার কারণে এই দুই দেশই তাদের সীমান্ত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুই দেশই প্রচলিত প্রথা বাস্তবায়ন করে চলেছে।

গত দুই দশক আগের চেয়ে বিশ্ব এখন আরো বেশি সংখ্যক শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থী দেখছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব সারা পৃথিবীতে মানুষকে বাস্তুচ্যূত হতে বাধ্য করছে।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, যেখানে গত ২০ বছরে বৈশ্বিক জনসংখ্যা এক চতুর্থাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, সেখানে একই সময়ের হিসাবে শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা তার দ্বিগুণ হয়েছে। আজ যেখানে প্রতি ৯৭ জনে একজন বাধ্য হচ্ছেন বাস্তুচ্যূত হতে, সেখানে ২০১৫ সালে এর আনুপাতিক হিসাব ছিল প্রতি ১৭৫ জনে ১ জন। যেসব মানুষ বাধ্য হয়ে বাস্তুচ্যূত হয়েছেন তাদের বেশিরভাগই পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার শরণার্থী, যেমন তুরস্ক অথবা সুদান।

ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলেও বিশালসংখ্যক শরণার্থীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। কলাম্বিয়া, চিলি ও পেরুতে এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর তথ্য অনুসারে, বিদেশে বাস্তুচ্যূত ৩ দশমিক ৬ মিলিয়ন ভেনেজুয়েলিয়ান এই তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হওয়ায় বাস্তুচ্যূতির মোট সংখ্যা দীর্ঘায়িত হয়েছে।

যত শরণার্থী তত সীমানা প্রাচীর

অভিবাসনের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার সমান্তরালে আরো একটি ঘটনা ঘটছে অথবা আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে তাহলো: ২০০০ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বে ইতোমধ্যে নির্মিত হয়ে গেছে এবং নির্মাণ কাজ শুরুর ঘোষণা দেয়া হয়েছে এমন সীমানা প্রাচীরের সংখ্যা ১৬ থেকে ৯০টির বেশি। ডয়েচে ভেলে কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য এমনটাই দেখাচ্ছে।


সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণের প্রধান কারণ হিসেবে বেশিরভাগ দেশই অবৈধ অভিবাসন বিষয়টিকেই সবচেয়ে বেশিসংখ্যকবার উচ্চারণ করেছে। এছাড়া অবৈধ ব্যবসা (পণ্যের কালোবাজারি, মানবপাচার ও মাদক) এবং সন্ত্রাসবাদের মতো বিষয়তো রয়েছেই। ১৯৬৮ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নির্মিত সীমানা প্রাচীর নিয়ে ডেলাস সেন্টার ফর পিচ স্টাডিজ কর্তৃক পরিচালিত এক সমীক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে।


প্রতিবন্ধকতা: কঠোর সামরিকীকরণ


অবৈধ অভিবাসন, অবৈধ ব্যবসা ও সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে সীমান্ত প্রতিবন্ধকতার কার্যকারিতা সবসময় মূল্যায়ন করা সহজ নয়। কারণ এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে নানামাত্রিক আন্তঃসম্পর্কিত বিষয়। একটি সীমানা কতোটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে তা কিছু মাপকাঠি দ্বারা নির্ধারন করা যায়। যেমন এটি কীভাবে তৈরী, এর উপাদান কী, প্রতিবন্ধকতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে এটি কতোটা ব্যতিক্রমী সেসবের উপর।


গবেষক ভিক্টোরিয়া ভেরনোন ও ক্লাউস জিমেরম্যান তাদের এক গবেষণায় দেখিয়েছেন: সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সীমান্তগুলির অন্যতম কুয়েত-ইরাক সীমান্ত, যা নির্মিত হয়েছে বিদ্যুৎবাহিত ক্ষুরবিশিষ্ট তার দিয়ে। এই সীমান্ত ৬ দশমিক ৬ মিটার চওড়া এবং ৬ দশমিক ৬ মিটার গভীর পরিখা দ্বারা সজ্জিত, তিন মিটার উঁচু মাটি-খড়কুটো দিয়ে পূর্ণ এবং শত শত সৈন্য, বেশ কয়েকটি টহল নৌকা এবং হেলিকপ্টার দ্বারা সুরক্ষিত।

অপেক্ষাকৃত ঝাঁজরযুক্ত সীমান্তগুলির মধ্যে রয়েছে মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ড ও ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ সীমান্ত। দুই সীমান্তই সাদামাটাভাবে টহল এবং পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং এগুলো অভিবাসী এবং চোরাচালানীদের জন্য কার্যকর প্রতিবন্ধকতা নয়। এরা প্রায়শই দুই দেশের সীমান্ত অতিক্রম করার জন্য জাল কাগজপত্র ও ঘুষ ব্যবহার করে থাকে- ভেরনোন ও জিমারম্যান এর ভাষ্য অনুযায়ী।

অভিবাসন ও নিরাপত্তা: ‘বৈশ্বিকভাবে প্রাচীর নির্মানই কার্যকর পন্থা নয়’


প্রাচীর অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে পারে কিনা তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা রয়েছে। ‘বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলো এ নিয়ে এখনো এমন কোনো ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। একারণে বলা যায় অভিবাসন ঠেকাতে প্রাচীর বৈশ্বিকভাবে কার্যকর নয়’-ডয়েচে ভেলের পাঠানো ইমেইলের উত্তরে ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগোর রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সার্জিয়ো পারদোস-প্রাদো এ বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করেন।

‘কখনো কখনো অভিবাসনের ক্ষেত্রে বিকল্প পথ হিসেবে খোঁজা হয়-সাগর অথবা পরোক্ষ ভূমি সংযোগ। প্রাচীর ধীরগতির ও ব্যয়বহুল নির্মাণকাঠামো, যা দিয়ে কখনো কখনো আপনি নির্দিষ্ট একটি এলাকায় প্রবেশ প্রতিরোধ করতে পারেন। কিন্তু অন্যদিকে এর মাধ্যমে আপনি অন্য এলাকা যেগুলো নির্মাণাধীন অথবা কম মজবুত এমন এলাকায় প্রবেশের জন্য উৎসহিত করেন।’ ‘সীমান্তের পুরো এলাকাজুড়ে একটি নিখুঁত, বিশাল মজবুত ও দুর্ভেদ্য ব্লক পাওয়া বিরল।’

প্রাচীর নির্মাণের উদ্দেশ্য অভিবাসন ঠেকানো ছাড়াও নিরাপত্তার মতো আরো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বন্ধ করা। কিন্তু পারদোস প্রাদোর নেতৃত্বে পরিচালিত সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে, সীমান্তে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি প্রকৃতপক্ষে সন্ত্রাসী হামলা প্রতিরোধের পরিবর্তে এর সম্ভাবনাকে আরো বাড়িয়ে দিতে পারে।


সৌদি আরব-ইরাক প্রাচীর ও ইসরায়েল-মিশর প্রাচীরকে আধেয় ধরে এই কেসস্টাডি করা হয়। গবেষকরা অনুসন্ধানে একটি প্রাচীর তৈরীর পর অন্য দেশের প্রতি মানুষের মনোভাবের উল্লেখযোগ্য অবনতি ঘটেছে বলে খুঁজে পেয়েছেন। ‘প্রাচীর নির্মাণ উস্কানি দেয় এবং এমনকি দ্বান্দ্বিক অবস্থার বাইরে, যা প্রাচীর নির্মাণের আগে থেকেই সুপ্তবস্থায় ছিল এমন দ্বন্দ্বকে তীব্র করে তোলে’-পারদোস-প্রাদো বলেন।

সীমানা প্রাচীর নির্মাণ পরিকল্পনার ফলাফল উল্টো হওয়ার জন্য দ্বিতীয় একটি বিষয় রয়েছে; যেসব দেশে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন রয়েছে, সেখান থেকে আসা একটি বড় শরণার্থী গোষ্ঠীর উপস্থিতি। গবেষণার ফলাফল বলছে, এটি উৎস দেশের জন্য সন্ত্রাসীদের প্রজনন ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিচ্ছে।
‘এ্রর মানে এটি দাঁড়ায় যে, যদিও শরণার্থী গোষ্ঠীর আকার বড় তারপরও তারা সন্ত্রাসবাদকে সঙ্গে নিয়ে দেশ থেকে আসেনি।’

সীমানা প্রাচীর অর্থনীতিতেও একাধিকবার আঘাত হেনেছে

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও অপ্রত্যাশিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে: সীমান্ত প্রাচীর দিয়ে মাদক পাচার ও চোরাচালানের মতো অবৈধ ব্যবসা কমিয়ে আনতে পারে, তবে তারা আইনী বাণিজ্যও বন্ধ করতে পারে।


প্রাচীরের উদ্দেশ্য নির্বিশেষে, তাদের মধ্যে নির্মিত প্রাচীরের সঙ্গে আইনী বাণিজ্য ৩১ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে, বিশ্বজুড়ে ৫০টিরও বেশি সীমান্ত প্রতিবন্ধক স্থান বিশ্লেষণ করে এমন ফলাফল পেয়েছে ওয়াশিংটন এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা। এছাড়াও প্রাচীর নির্মাণ শুধু বাণিজ্য হ্রাস করে না, একইসঙ্গে বাড়তি খরচও যোগ করে।

‘দেয়াল এবং বেড়া সম্পর্কে অর্থনৈতিক প্রশ্ন হলো: সুবিধাগুলি কী খরচকে ছাড়িয়ে যায়? অর্থনীতিবিদ ভিক্টোরিয়া ভেরনোন ডয়েচে ভেলেকে ইমেইল মারফত লিখেছিলেন। ‘যদি এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৪০ হাজার মানুষকে কাজ করতে বাধা দেয় তাহলে কি একটি প্রাচীর এতটাই মূল্যবান যে, দেয়াল নির্মাণ ও এটির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আরো অনেক বিলিয়ন অর্থ ব্যায় করতে হবে। অভিবাসী শ্রমিকদের আটকে দেওয়ার ফলে সস্তা মেক্সিকান শ্রমের যে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সুবিধা থেকে মার্কিন নাগরিকরা বঞ্চিত হয়, তার আর্থিক মূল্যও তো কম নয়।

সীমান্তে বাধার বিকল্প

কিন্তু যদি সীমানা প্রাচীর অনিয়মিত অভিবাসন মোকাবিলা, অবৈধ বাণিজ্য বন্ধ এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার জন্য একটি নিশ্চিত ব্যবস্থা না হয়-তাহলে এর মানে কি দাঁড়ায়?

ভেরনোন এবং জিমারম্যানের মতে, ‘অর্থনৈতিক তত্ত্ব ব্যাপকভাবে পরামর্শ দেয় যে, কম সীমাবদ্ধ অভিবাসন এবং বাণিজ্যের সঙ্গে উন্মুক্ত সীমান্তের নীতিগুলি প্রাচীরের চেয়ে অভ্যন্তরীণ নাগরিকদেরকে বেশি উপকৃত করে।’
তারা তাদের গবেষণায় উল্লেখ করেন, ‘অবৈধ ব্যবসা এবং পাচার মোকাবেলায় প্রাচীরের চেয়ে অর্থনৈতিক নীতিগুলি বেশি কার্যকর, কূটনীতি নিরাপত্তা সুরক্ষা প্রাচীরের চেয়ে অধিক কার্যকর।’

অর্থনীতিবিদ ক্লাউস জিমারম্যান ডয়েচে ভেলেকে জানান ‘প্রাচীর এবং বেড়া একটি স্বল্পমেয়াদী হাতিয়ার হতে পারে’ । এছাড়া অভিবাসন নিয়ে কাজ করা বেশিরভাগ সামাজিক বিজ্ঞানী মনে করেন, এটি কোনো যুক্তিযুক্ত হাতিয়ার নয়।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here