মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অঞ্চলের মানুষ কীভাবে মানসিক বিপর্যয় মোকাবেলা করছে?

0
1009
মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অঞ্চলের মানসিক স্বাস্থ্য

দীর্ঘ সময় ধরে ফিলিস্তিন, ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে সংঘাত-সংঘর্ষ চলছে। যুদ্ধ আর হানাহানির ফলে প্রতিনিয়তই অঞ্চলটির রাজপথ সাধারণ মানুষের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে। সবমিলিয়ে ভয়ঙ্কর এক দুঃসময় পার করছে ভাগ্যের জোরে বেঁচে যাওয়া সেখানকার মানুষেরা। চোখের সামনে প্রতিনিয়ত এরকম অপ্রত্যাশিত ঘটনা দেখতে দেখতে অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

কয়েকটি গবেষণার সূত্র বিশ্লেষণ করে সংবাদ মাধ্যম আরব নিউজ জানাচ্ছে, তিউনিসিয়া, ফিলিস্তিন, জর্ডান, লেবানন এবং ইরাকের মানুষ মধ্যে বিষন্নতার হার সব থেকে বেশি। এ বিষয়ে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ডাঃ থরাইয়া কানাফানির পর্যবেক্ষণ হলো, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় বসবাসরত ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী প্রায় সবারই মধ্যে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বা পিটিএসডি (একটি মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা যা কোনো আঘাতমূলক ঘটনার সম্মুখীন হওয়ার ফলে ঘটে থাকে) -এর লক্ষণ দেখা গিয়েছে।

বিশ্বব্যাপী প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ মানসিক অসুস্থতা নিয়ে বসবাস করছে।

২০২০ সালের ‘আরব যুব জরিপ’-এ উঠে এসেছে, এই অঞ্চলের ১৫ টি দেশে বসবাসরত তরুণদের প্রায় এক তৃতীয়াংশ কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভুগছে। ডাঃ কানাফানি বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে তিউনিসিয়া, ফিলিস্তিন, জর্ডান, লেবানন এবং ইরাকের মানুষেরা উচ্চ মাত্রার বিষন্নতায় ভোগেন ।

ফিলিস্তিন

গাজা উপত্যকায় ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের ৯৭ দশমিক ৫ ভাগ মানুষের পিটিএসডি আছে । ফিলিস্তিনের সংকট এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য বড় ঘটনা মানসিক অসুস্থতা বৃদ্ধির বড় কারণ ।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ মানসিক অসুস্থতার সঙ্গে বসবাস করছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, মানসিক রোগে আক্রান্তদের ৭৫ ভাগেরও বেশি মানুষ চিকিৎসা সেবা নিতে পারে না।

সিরিয়ার একটি মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের আঙ্গিনায় বসে আছেন কয়েকজন মানসিক রোগী। সিরিয়ার উত্তরে তুরস্কের সীমান্তের কাছে আজাজ শহরে বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত উত্তরাঞ্চলের একমাত্র মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র এটি । ছবি- ৬ জুলাই, ২০১৭ এ । (ফাইল/এএফপি)

সংস্থাটি বলছে, ‘প্রতি বছর প্রায় ৩ মিলিয়ন মানুষ ওষুধের অপব্যবহারের কারণে মারা যায়। প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রায় ৫০ ভাগ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ১৪ বছর বয়স থেকে শুরু হয়।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ২০১৯ সালের একটি প্রতিবেদনে বলেছে, সংঘাতময় অঞ্চলে বসবাসকারী প্রতি পাঁচজনের (২০ শতাংশ) একজন ব্যক্তির বিষন্নতা, উদ্বেগ, পিটিএসডি, বাইপোলার ডিসঅর্ডার বা সিজোফ্রেনিয়া থাকতে পারে।

ডব্লিউএইচও আরো বলছে, ‘যারা গত ১০ বছরে যুদ্ধ বা অন্যান্য সংঘাতের সম্মুখীন হয়েছে, তাদের প্রতি ১১ জনের এক জনের মাঝারি বা গুরুতর মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’

একটি সংঘাতময় অঞ্চলে যেখানে ক্রমাগত আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়, সেখান মানসিক চিকিৎসা সেবা কতোটা কার্যকর হতে পারে তা জানতে চাইলে কানাফানি বলেন: ‘গবেষণায় দেখা গেছে, যুদ্ধের ক্ষেত্রে শিশুদের জন্য বিশেষ কিছু ধরনের চিকিৎসা সেবা কিছুটা হলেও কার্যকর। বিশেষ করে শিশুদেরকে এসব পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তোলা।’

তিনি আরও বলেন, যেসব এলাকা বারবার আক্রমণের শিকার হয়, সেসব জায়গায় বসবাসরত শিশুদের মধ্যে সহিংসতার একটি ক্রমাগত ভয় তৈরি হয় এবং দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগের পাশাপাশি মানসিক চাপের শিকার হয় তারা। তিনি বলেন, তাদের বিদ্যমান পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার কৌশল শেখানো যেতে পারে ।

ইয়েমেন

ফিলিস্তিনের শিশুরা ধ্বংসস্তুপের মধ্যে থেকে তাদের গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করছে। ছবি: সংগৃহীত

ফ্যামিলি কাউন্সেলিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের ২০১৭ সালের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ইয়েমেনে, দীর্ঘদিন ধরে চলমান সংঘাতের কারণে প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে একজন মানসিক রোগে ভুগছেন।

রিলিফওয়েব, জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় কার্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত মানবিক তথ্য পরিষেবা, এক বিবৃতিতে বলেছে- ‘ইয়েমেনে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দুষ্প্রাপ্য। মানসিক অসুস্থতাকে কুসংস্কার হিসেবে দেখা হয় এবং জনসংখ্যা অনুযায়ী মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা কম। বিদ্যমান কিছু মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা মহামারীর কারণে বন্ধ হয়ে গেছে।’

সিরিয়া

স্ট্যাটিস্টার-এর ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১১ সালে সংঘর্ষ শুরুর পর থেকে সিরিয়ায় প্রায় দুই লাখ ৭০ হাজার বেসামরিক মানুষ হতাহত হয়েছে।

২০১৭ সালে রেডক্রসের আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২ দশমিক ৪ মিলিয়নেরও বেশি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, শিল্প সক্ষমতার ৬৭ শতাংশ ধ্বংস হয়েছে, ৪৫ শতাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্র বিকল হয়ে পড়েছে এবং ৩০ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে।

দুবাই এর হিরিওট-ওয়াট ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক কিরিন হিলিয়ার বলেন, ‘এটি সিরিয়ার ৮৯ ভাগ মানুষকে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। দেশের এই সংকটজনক পরিস্থিতি সিরিয়ানদের মানসিক সংকটকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।’

হিলিয়ার আরো বলেন, ‘এসব অঞ্চলে চলমান যুদ্ধ এবং হামলা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদেরও প্রভাবিত করেছে। হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন এবং বোমা হামলার খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। ব্যবহারকারীরা হয়তো খেয়ালও করতে পারে না যে, তারা প্রতিদিন কতটা নেতিবাচক তথ্য গ্রহণ করে এবং এর প্রভাব পড়ে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর।‘

যুক্তরাষ্ট্রের একাডেমিক মেডিকেল সেন্টার ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের ২০২০ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ডুম স্ক্রলিং’ নেতিবাচক চিন্তাভাবনা এবং মানসিকতা সৃষ্টি করতে পারে, যা একজন ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে।

প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়েছে, ‘নেতিবাচক খবর মানুষের ভয়, চাপ, উদ্বেগ এবং দুঃশ্চিন্তা বাড়িয়ে দেয়।’

কানাফানি বলছিলেন যে, ‘মধ্যপ্রাচ্যে মানসিক স্বাস্থ্য তহবিল, সম্পদ এবং কর্মীর অভাব রয়েছে। এছাড়াও কুসংস্কার এবং সঠিক সচেতনতার অভাবে মানুষ চিকিৎসা নিতে অনীহা প্রকাশ করে।’

কানাফানির মতে, এই অঞ্চলে সর্বাধিকসংখ্যক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কাতার, বাহরাইন, কুয়েত এবং লেবাননে পাওয়া যায়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রতি এক লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে পাঁচজনেরও কম মনোচিকিৎসক রয়েছে।

সূত্র: আরব নিউজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here