মানব পাচার বিরোধী লড়াইয়ে জয়ের জন্য আরো যা দরকার

0
999

২০১৯ সালের শেষ দিকে আমরা সৌদি আরবে সুমা আক্তার নামে একজন বাংলাদেশী নারীর মর্মান্তিক দুর্দশার কথা জানতে পেরেছি। বিদেশে তার ওপর সংঘটিত নির্যাতন ও শোষণের ঘটনা গোপনে রেকর্ড করে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেন। আক্তার বলেন, সৌদি আরবে তার নিয়োগকর্তা তাকে প্রহার করে এবং এক পর্যায়ে তার হাতে গরম তেল ঢেলে দেয়। তিনি বলেন, তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তার নিয়োগকর্তা তাঁকে আরেকজনের কাছে ২২,০০০ রিয়াল অর্থাৎ বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় পাঁচ লাখ টাকা মূল্যে বিক্রি করে দেয়। এটি মানব পাচারের একটি ধরন মাত্র। মানব পাচার এমন একটি অপরাধ যেখানে থাকে বিভিন্ন ধরনের শোষণ- যেমন বাধ্যতামূলক শ্রম বা বাণিজ্যিক যৌনকর্মে বাধ্য করতে ভুক্তভোগীর দুর্বলতার সুযোগে তার ওপর বল প্রয়োগ, জালিয়াতি বা জবরদস্তি করা। এটি এমন এক ভয়াবহ অপরাধ যেখানে কেবলই মুনাফার জন্য দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের স্বপ্ন লুট করে তাদের স্বাধীনতা হরণ করে নেয়া হয়।

২৫ জুন, যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অফ স্টেট ২০২০ সালের বৈশ্বিক মানব পাচার প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান  ‘ দ্বিতীয় স্তরের নজরদারি তালিকা’ থেকে ‘দ্বিতীয় স্তর’ এ উন্নীত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ যে পদক্ষেপগুলোর ফলে গত বছর মানব পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশের অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে সাতটি মানব পাচার ট্রাইবুনাল গঠন এবং বিদেশে কাজের জন্য গমনেচ্ছু বাংলাদেশীদের শোষণকারী নিয়োগ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ। বাংলাদেশ সরকার এবং পাচারকারীদের জবাবদিহিতা ও ভুক্তভোগীদের মুক্তি নিশ্চিত করতে অক্লান্তভাবে লড়াইরত নিবেদিত সুশীল সমাজ প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা অভিনন্দন জানাই। বৈশ্বিক মানব পাচার বিরোধী যুদ্ধে তারা বাংলাদেশের বীর। দ্বিতীয় স্তর’এ অবস্থানের অর্থ হলো, পাচার নির্মূলের লক্ষ্যে ন্যূনতম মান অর্জনে বাংলাদেশ সরকার উল্লেখযোগ্য ও ক্রমবর্ধমান প্রচেষ্টা নিচ্ছে। পুরোপুরি এই মান অর্জন এবং এই ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড নির্মূলে আরো কাজ বাকি রয়েছে।

মানব পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশের নেয়া প্রচেষ্টাগুলোতে যুক্ত থাকতে পেরে যুক্তরাষ্ট্র গর্বিত। আমরা মানব পাচার প্রতিরোধে পরবর্তী পদক্ষেপ উত্সাহিত করতে ১১ জুনে প্রকাশিত ইউএন নেটওয়ার্ক অন মাইগ্রেশন’র উপ- সম্পাদকীয়’র পুনরাবৃত্তি করি এবং পাচারকৃত মানুষদের মুক্তি নিশ্চিত করার লড়াইয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ হিসাবে বাংলাদেশের জন্য চারটি সুপারিশ রাখছি:

প্রথমত, সাতটি মানব পাচার ট্রাইব্যুনালকে মানব পাচার আইন ২০১২ অনুসারে দায়েরকৃত ৫,০০০-এর বেশি সংখ্যক মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দিন এবং জাতিসংঘের মানব পাচার প্রোটোকল ২০০০’র নির্দেশনা অনুযায়ী পাচারকারীদেরকে দ্রুত বিচারের আওতায় আনুন। যতক্ষণ না অপরাধীদের বিরুদ্ধে জোরালো আইনী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে ততক্ষণ পাচার একটি কম ঝুঁকির ও উচ্চ-লাভের কাজ হিসাবেই বজায় থাকবে। অবশ্যই এর পরিবর্তন দরকার।

দ্বিতীয়ত, মানব পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশের কার্যক্রমগুলোকে ভুক্তভোগী সহায়ক করে গড়ে তুলুন যাতে নারী-পুরুষ বা তরুণ-বয়স্ক সকল ভুক্তভোগী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবা পায়। এর অর্থ হলো, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও দাতাগোষ্ঠীর ব্যাপক প্রচেষ্টার সাথে সমন্বয়ের ভিত্তিতে ভুক্তভোগীদের সেবা জোরদার করার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে আরো সরকারী সম্পদ বরাদ্দ করতে হবে। সেইসাথে ভুক্তভোগীদের নিরাময় লাভে তাদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা, চিকিৎসা এবং মানসিক, সামাজিক, আইনী ও পুনর্বাসন সেবাও নিশ্চিত করতে হবে।

তৃতীয়ত, নিরাপদ মাধ্যমে বিদেশে কাজের জন্য গমনেচ্ছু ব্যক্তিদের সুরক্ষায় কার্যক্রম জোরদার করুন। এর মধ্যে থাকবে, নিয়োগের জন্য আন্তঃসরকারী সমঝোতার মাধ্যমে ধার্য করা দাপ্তরিক ফিস বাড়িয়ে নেয়া নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রযোজ্য আইনের প্রয়োগ অব্যাহত রাখা এবং এসব ফিস কর্মীদের থেকে আদায় বন্ধ করে সেই ব্যয়ভার নিয়োগকারীদের ওপর বর্তানোর জন্য কাজ করা। যখন কোন ব্যক্তি নিয়োগ ফিস পরিশোধের জন্য ঋণ নেয় তখন সে শোষণের এক ভয়াবহ ঝুঁকিতে পড়ে। কর্মীদেরকে শুরু থেকেই অসুবিধার মধ্যে ফেলা এই শুভঙ্করের ফাঁকির হিসাবের সম্পূর্ণ পরিবর্তন দরকার। নিরাপদ অভিবাসনের জন্য সহজ পথ তৈরি করতে নিয়োগকারীদেরকে অবশ্যই আরো বেশি প্রচেষ্টা নিতে হবে। লিবিয়ায় ২৬ জন বাংলাদেশীর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর তদন্ত সাপেক্ষে সন্দেহভাজন পাচারকারীদেরকে গ্রেফতারে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপের জন্য আমরা উৎসাহিত বোধ করেছি। আমরা আশা করি এসব পদক্ষেপ প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা ব্যবস্থায় রূপ নেবে এবং যাতে আর কখনো এমন বিয়োগান্তক ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেটা নিশ্চিত করবে।

চতুর্থত, যৌনপল্লীতে জন্ম নিয়েছে বিধায় হাজার হাজার মানুষকে যারা বাণিজ্যিক যৌনকর্মে বাধ্য করছে সেসব পাচারকারীদেরকে তদন্ত সাপেক্ষে বিচারের আওতায় আনুন। অনুমোদিত যৌনপল্লীতে যৌনকাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে পাচার সম্পর্কিত প্রতিবেদনগুলোর বিষয়ে সতর্কতার সাথে  তদন্তপূর্বক ভুক্তভোগীদের চিহ্নিত করে অবিলম্বে তাদের সুরক্ষার জন্য ব্যবস্থা নিতে আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।

এগুলোর সবই সত্যিই কঠিন কাজ এবং কোভিড-১৯’র এই বৈশ্বিক সংকটের মধ্যে এই লড়াই আরো বেশী জরুরী হয়ে পড়েছে। পাচারকারীরা মহামারী সৃষ্ট বিশৃঙ্খল অবস্থাকে পুঁজি করছে। এই অপরাধের জন্য তাদেরকে অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। আমাদের জন্য এখনই সময় স্বাধীনতা সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়ার। মানব পাচার নির্মূলের এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজে বাংলাদেশের সাথে আমাদের অংশীদারিত্বের বিষয়ে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।

(ইংরেজি থেকে অনুদিত )

লেখক:

আর্ল আর মিলার : বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত  রাষ্ট্রদূত মিলার সম্ভবত ইতিহাসের একমাত্র রাষ্ট্রদূত যিনি প্রাক্তন পেশাদার আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা হিসাবে তদন্তপূর্বক মানব পাচারকারীদের গ্রেফতার করেছেন।

জন কটন রিচমণ্ড : যুক্তরাষ্ট্রের মানবপাচার পর্যবেক্ষণ  মোকাবিলাবিষয়ক অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জ। রিচমন্ড পাচার বিরোধী বেসরকারী সংস্থার নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং পাচার বিরোধী লড়াইয়ে নিবেদিত যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারের সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়ার আগে মানব পাচার বিষয়ে একজন বিশেষায়িত কৌঁসুলি হিসাবে কাজ করেছেন। 

বি:দ্র: লেখাটি ২৬ জুন ২০২০ তারিখে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। গুরুত্বের বিবেচনায় অভিবাসী ডটকম এর পাঠকদের জন্য পুনরায় হুবুহু প্রকাশ করা হলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here