২০১৯ সালের ২৩ মে বিবিসিতে প্রকাশিত একটি সংবাদ গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করেছিল কীভাবে ছয়টি অভিবাসী শিশু যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তে মারা গিয়েছিল। গত বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে থাকা অবস্থায় ছয়টি অভিবাসী শিশুর প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল। নিস্পাপ এ প্রাণগুলো স্তব্ধ হয়ে যাবার পর থেকে একটি প্রশ্ন সামনে আসা শুরু করে তাহলো, শিশুদের জীবন রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের চিকিৎসা সেবা কী অকার্যকর? তা না হলে কেনো এই শিশুগুলো কোনো রকম চিকিৎসাসেবা ছাড়াই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো? যদিও সিবিপি (কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার পেট্রোল) এর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে ‘আমাদের কারাগার স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও মানবিক চিকিৎসা সহায়তা দেয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ উল্লেখ্য এর আগে ২০১০ সাল থেকে কেন্দ্রিয় কারাগারে কোনো অভিবাসী শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে।
মধ্য আমেরিকা থেকেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অভিবাসী পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার চেষ্টা করে। অনিরাপত্তা ও চরম দারিদ্রতা থেকে মুক্তির জন্য লাখেরও বেশি মধ্য আমেরিকান অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণ করেছে । বর্ডার পেট্রোল স্টেশনগুলি অতিরিক্ত অভিবাসীর ভারে ভারাক্রান্ত এবং সমস্যা সমাধানে টেক্সাসের মতো কিছু জায়গায় অস্থায়ী নিবাস তৈরি করা হয়েছে। মৃত্যুকে বরণ করা এসব অভিবাসী শিশু সম্পর্কে এবং কেনো তারা যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনের চেষ্টা করেছিল চলুন তা জেনে নেয়া যাক:
এল সালভাদরের ১০ বছর বয়সী অজ্ঞাত শিশু
২০১৮ সালের ৪ মার্চ টেক্সাসের সান আনটিনোর রিফিউজি রিসেটেলমেন্ট এর একটি অফিসে নিয়ে আসা হয় মারাত্মক আহত সালভাদোরিয়ান নামে এক শিশুকে। সেখানকার এক কর্মকর্তা, মিস্টার ওয়েবার বলছিলেন, নিঃস্ব অবস্থায় পাওয়া আসা এ শিশুটির জন্মগত হৃদরোগ আছে এবং তার অস্ত্রোপচারের ইতিহাসও রয়েছে। এরকম একটি জটিল পরিস্থিতিতে শিশুটিকে কোমায় থাকা অবস্থায় ফেলে গিয়েছিলেন কেউ। সান আনটিনোর হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়ার পর শিশুটিকে অ্যারিজোনার ফোনিক্সের একটি সেবালয়ে পাঠানো হয়। এরপর আরো একটি চিকিৎসা কেন্দ্রে তাকে পাঠানো হয়। সেই সঙ্গে শিশুটির পরিবারকেও নাকি খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছিলো। কিন্তু হঠাৎ তার অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে এবং সে মারা যায়।
কার্লোস গ্রেগোরিও হার্নান্দেজ, ১৬
দক্ষিণ-পূর্ব টেক্সাসের সীমান্তঘেষা শহর হিডালগো থেকে ১৩ মে হার্নান্দেজকে কারাগারে নিয়ে আসা হয়। ১৯ মে এক পরীক্ষায় শিশুটির শরীরে ভাইরাস ধরা পড়ে এবং তাকে চিকিৎসা দেয়া হয়। এরপর তাকে ওয়েলাসকো বর্ডার পেট্রোল স্টেশনে স্থানান্তর করা হয়। ক্রমশ শিশুটির অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকে। এরপর তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে তার মৃত্যুর কোনো কারণ অবশ্য জানানো হয়নি।
আড়াই বছর বয়সী গুয়াতেমালান বালক
পাসো দেল নর্তে আন্তর্জাতিক ব্রিজের কাছে গুয়াতেমালার আড়াই বছর বয়সী একটি শিশু তার মাসহ আটক হয়েছিল। সেতুটি রিয়ো গ্রান্ডে পেরিয়ে টেক্সাম ও মেক্সিকোর রাজ্য সিহুয়াহুয়ার সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়েছে। এটি যুক্তরাষ্ট্র সীমান্ত লাগোয়া একটি রাজ্য। বিবিসির সংবাদদাতা সিবিপির উদ্ধৃতি বলছে, সীমান্ত এজেন্টকে শিশুটির মা জানিয়েছিল তার ছেলে অসুস্থ। এর পরিপ্রেক্ষিতে সীমান্ত শহ এল পাসোর একটি শিশু হাসপাতালে তাকে নিয়ে আসা হয়। শিশুটি প্রচণ্ড জ্বর ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিল।
জুয়ান দে লিও গুতেরেজ, ১৬
গুয়াতেমালার এই কিশোর মারা যায় ৩০ এপ্রিল টেক্সাসের একটি হাসপাতালে। কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকাকালীন মস্তিকে রক্তক্ষরণজনিত কারণে শিশুটির মৃত্যুর হয়েছিল বলে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো দাবি করেছিল। শিশুটি যে আশ্রয় শিবিরে অবস্থান করেছিল, তা এল পাসো থেকে ১ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরে অবস্থিত। এখানে ‘নিসঙ্গ অভিবাসী’ হিসেবে তাকে আটক করা হয়েছিল। এখানে আসার একদিন পর তার জ্বর, সর্দি কাঁশি ও মাথাব্যথা শুরু হয়। কর্তৃপক্ষের ভাষ্য এরপরই নাকি তারা তাকে হাসপাতালে পাঠায়। যদিও হাসপাতালে পাঠানোর ২৪ ঘণ্টা পর তাকে ছাড়পত্র দিয়ে দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে সে যখন আরো অসুস্থ হয়ে যায় তখন তাকে স্থানীয় আরেকটি হাসাপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে তাকে শিশু হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এরপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কিছুদিন নিবিড় পরিচর্চা কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল গুতেরেজকে। ডি লিও গুয়াতেমালা ও হন্ডুরাস সীমান্ত লাগোয়া একটি মফস্বল শহর থেকে এসেছিল, যেটি কিনা চরম দারিদ্রতায় ঠাঁসা একটি জনপদ।
ফিলিপ গোমেজ আলোনজো, আট
২৪ ডিসেম্বর সীমান্ত কারাগারের মধ্যে জ্বর ও সর্দি নিয়ে মারা যায় আলোনজো। উত্তর গুয়াতেমালার তার বাড়ি থেকে বের হয়ে বালকটি তার বাবার সঙ্গে এক মাস ধরে পথে পথে ঘুরছিল। শিশুটির মা জানিয়েছিল সংসার চালানোর জন্য অর্থ জোগাতে তার স্বামী ও ছেলে অভিবাসী হয়েছিল। তারা এতটাই সংকটের মধ্যে ছিল যে, কাঠ ও বিদুৎ বিল দেয়ার মতো অর্থও তাদের হাতে ছিল না। মূলত ফিলিপের মৃত্যুর পর যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব ন্যাশনাল সিকিউরিটি ঘোষণা করতে বাধ্য হয় যে, আটকের পর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অভিবাসী শিশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে।
জ্যাকেলিন কাল, সাত
৬ ডিসেম্বর জ্যাকেলিন কাল ও তার বাবা বিরাট একটি অভিবাসী দলের সঙ্গে সীমান্ত পাড়ি দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ পূর্ব দিকের একটি মরুভূমির ভেতর দিয়ে ছিল তাদের এ দুঃসাধ্য অভিযান। টানা কয়েক দিনের ভয়াবহ কঠিন এক পথ পাড়ি দেয়ায় শিশুটি মারাত্মক দুর্বল হয়ে পড়ে। এসময় তার মুখে তুলে দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত পানি ও খাদ্য কিছুই ছিল না। একপর্যায়ে তার বমি শুরু হয়। এমতাবস্থায় তাকে জরুরী চিকিৎসার জন্য ইউএস বর্ডার পেট্রোল এমার্জেন্সি রেসপন্স টেকনিশিয়ানস এর নিকট নেয়া হয়। কিন্তু দুভার্গ্যবশত তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। তার মৃত্যুর কয়েক মাস পর এক সুরতহাল প্রতিবেদনে জানানো হয়, শিশুটি সেপটিক শক (রক্তচাপ কমে যাওয়া ও অক্সিজেন শুন্যতা) এর কারণে মারা গিয়েছিল। যদিও তার পরিবার এ প্রতিবেদন অস্বীকার করেছে এবং মৃত্যুর সঠিক কারণ খুঁজে বের করার জন্য স্বাধীন তদন্তের দাবি জানিয়েছে।