অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি মালয়েশিয়া সরকার নিষ্ঠুর আচরণ করছে- আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরায় গতবছর এমন বক্তব্য দিয়ে দেশটির সরকারের রোষানলে পড়েছিলেন বাংলাদেশী তরুণ রায়হান কবির। সত্য প্রকাশের দায়ে তাকে গ্রেফতার করে মাসখানেক কারাগারে পর্যন্ত আটকে রাখা হয়েছিল। রায়হান কবিরের প্রতি মালয়েশিয়া সরকারের এমন পদক্ষেপের ঘটনা বিশ্বের নানা প্রান্তে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। রায়হান কবির সম্প্রতি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক এর মাইগ্রেশন প্রোগ্রামে যোগ দিয়েছেন । অভিবাসী ডটকম এর সঙ্গে তার দীর্ঘ আলাপচারিতায় উঠে এসেছে মালয়েশিয়ায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া, দেশে ফেরত আসা এবং অভিবাসীদের নিয়ে নিজের লড়াইয়ের সংকল্প ও নতুন করে পথচলার গল্প।
অভিবাসী ডটকম: আপনি কাতার ভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরায় মালয়েশিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশীদের উপর নির্যাতনের কথা বলেছিলেন? কোন উপলব্ধির জায়গা থেকে আপনার মনে হয়েছিল যে সত্যটা প্রকাশ হওয়া উচিত?
রায়হান: আমি ছয় বছর মালয়েশিয়াতে ছিলাম। ওখানে পড়াশুনা শেষ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করি। যখন ছাত্র ছিলাম তখন থেকে দেখতাম বাংলাদেশীদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হত, তাদেরকে অবহেলার চোখে দেখা হত। মালয়েশিয়াতে বাংলাদেশীরা কাগজপত্রে জালিয়াতিসহ নানা ধরণের প্রতারণার শিকার হন। ২০১৬ সালের গণশুনানীতে আইনের তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশীদেরকে অবৈধ ঘোষণা করা হল।
জাতিসংঘ কনভেনশন অ্যাক্ট ১৯৯১ এ স্পষ্ট উল্লেখ আছে, কাগজ বা দলিলের অপরাধ কোনো ফৌজদারি অপরাধ নয়। এই আইনে আরো উল্লেখ আছে, কোনো অভিবাসীকে দলিলের অপরাধের জন্য নির্দিষ্ট কিছু বিধি মেনে দেশে ফেরত পাঠাতে হবে। কনভেনশন অ্যাক্ট অনুযায়ী এই অপরাধে কাউকে হাতকড়া পরানোরও বিধান নেই। সেখানে বাংলাদেশীদের হাতে শেকল পরিয়ে আটকে রাখা হয়। কোভিড-১৯ মহামারীর দুঃসহ পরিস্থিতিতে লকডাউন চলাকালে কর্মহীন ও খাবারের সংকটে থাকা বৈধ কাগজপত্রবিহীন অভিবাসী শ্রমিকদের শেকল পরিয়ে কোমরে দড়ি বেধে টেনে হিচড়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। কোনো সভ্য দেশ তো বিদেশী নাগরিকদের সঙ্গে এমন আচরণ করতে পারে না। তখন আমার মনে হয়েছে, সত্যটা প্রকাশ হওয়া জরুরি এবং এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে।
অভিবাসী ডটকম: আল জাজিরা সাক্ষাৎকারের জন্য আপনাকে কেন বেছে নিয়েছিল?
রায়হান: আমি ছাত্রদের অধিকার আদায়ে নেতৃত্ব দিয়েছি, অভিবাসী কর্মীদের পাশে থেকেছি, এসব কারণে আল জাজিরা মনে করেছে সত্যটা প্রকাশ করার সাহস আমার আছে। তাছাড়া ইংরেজিতে কথা বলতে পারাটা আমাকে নির্বাচনের আরো একটা কারণ ছিল। তারা যখন আমার সঙ্গে কথা বলতে আসে, তখন অমিও প্রতিবাদের একটা সুযোগ পেয়ে যাই। শুধু আল জাজিরা নয় অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তবে বাংলাদেশীদের মধ্যে আমিই প্রথম যে প্রবাসীদের প্রতি নির্যাতনের বিরুদ্ধে স্পষ্টভাবে প্রতিবাদ করতে পেরেছি। এটা মালয়েশিয়ান সরকার মেনে নিতে পারেনি। এজন্য তারা আমাকে গ্রেফতার করে।
অভিবাসী ডটকম: মালয়েশিয়ার কারাগারে আটক থাকার সময়গুলোতে আপনার সঙ্গে কী কী ঘটেছিল?
রায়হান: গ্রেফতারের পরপরই আমার মাথায় টুপি পরিয়ে দেওয়া হয়, মুখে মাস্ক পরানো হয়, যাতে করে আমাকে কেউ চিনতে না পারে। কিন্তু ওখানকার সাংবাদিকরা আটকের খবর আগে থেকে জানতে পেরে কারাগারে নেওয়ার আগে আমার ছবি তুলে নেয়। ছবিগুলো প্রকাশ হওয়ার পরে মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষ ঘটনাটা ধামাচাপা দিতে পারেনি। কারাগারে নেওয়ার পরে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একটি কক্ষে নেওয়া হয়। সাধারণত, অন্যান্য বাংলাদেশী শ্রমিকদের মালয়েশিয়ার কারাগারে প্রথম দিনে বিবস্ত্র করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আমার ক্ষেত্রেও তারা সেটি করতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি তখন প্রতিবাদ করি, তাদেরকে বলতে থাকি কোন আইনে, কোন সংবিধানে লেখা আছে যে আমাকে আপনারা বিবস্ত্র করতে পারেন? তারপর থেকে আমি যতদিন কারাগারে ছিলাম, তখন তারা আর কারো সঙ্গে এমন আচরণ করেনি।
আমাকে তিন দিন একা একটা কক্ষে আটকে রাখা হয়েছিল। আল জাজিরাকে যে বক্তব্য আমি দিয়েছি তা প্রত্যাহার করতে প্রতিদিনই তারা আমাকে মানসিকভাবে চাপ দিত । আমাকে একটা কাগজে লিখতে বলা হত যে, আমি আগে যা বলেছি তা মিথ্যা ছিল। কিন্তু আমি প্রত্যেকবার শুধু একটা কথা বলতাম, প্রবাসীদের সঙ্গে যেসব আচরণ করতে দেখেছি, আমি তাই বলেছি। আমি সত্য বলবই, মিথ্যার কাছে মাথা নত করব না। তারা বারবারই জিজ্ঞাসাবাদ করতো যে, আমি কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত কিনা, বা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আমাকে কোনো চাপ দেওয়া হয়েছে কিনা, আল জাজিরার সঙ্গে আমার কোনো চুক্তি হয়েছে কিনা। তারা আমার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নেওয়ার জন্য যত ধরণের চাপ প্রয়োগ করা দরকার সবই করতো।
অভিবাসী ডটকম: বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের কোনো নাগরিক বিদেশে আইনি জটিলতায় জড়িয়ে গেলে তাকে সহায়তা দিয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে আপনি দূতাবাস বা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা পেয়েছিলেন?
রায়হান: ঠিক সহযোগিতা বলবো না। আমি আটক হওয়ার পর তিন বার দূতাবাসের পক্ষ থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তারা আমাকে প্রতিবারই একটি কথাই বলতেন, আপনি পুলিশকে সহযোগিতা করুন। আমি তো যেটি সত্য সেটাই বলেছি এর বাইরে আর কীভাবে সহযোগিতা করতে পারি। দূতাবাসের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের আইনি সহায়তা আমাকে দেওয়া হয়নি। বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনগুলো স্বেচ্ছায় আইনজীবী নিয়োগ করে আমাকে সহায়তা করেছে । ২৮ দিন কারাগারে রাখার পর মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষ আমার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করতে পারেনি। তারা অফিসিয়ালি আমার বিরুদ্ধে কোনো চার্জও গঠন করতে পারেনি। পরের দিন যখন আমাকে নির্দোষ হিসেবে মুক্ত করে দেওয়া হয়, তখন দূতাবাসের পক্ষ থেকে আমাকে জানানো হয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। আমি এজন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
অভিবাসী ডটকম: অপরাধী না হয়েও আপনাকে প্রায় একমাস আটকে রাখা হয়েছে, আপনি এর কোনো ক্ষতিপূরণ চান কি?
রায়হান: আমি হাইকমিশনকে বলেছি যে, কোনো ধরণের ক্ষতিপূরণ চাই না। পড়াশোনা শেষ করে আমি কিন্তু খুব ভালো একটা চাকরি করতাম, একটি ফিল্ম প্রোডাকশন কোম্পানীতে মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ হিসেবে। যেহেতু ছয় বছর মালয়েশিয়াতে ছিলাম, আমার ভালো একটা সেভিংস ছিল। কিন্তু আটক হবার পর আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ক্লোজ করে দেওয়া হয়। এমনকি আমার একাডেমিক সার্টিফিকেটও বাতিল করা হয় এবং আমার পাসপোর্ট মালয়েশিয়ার জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। আমি হাইকমিশনারের কাছে অ্যাকাউন্ট উদ্ধারের বিষয়ে সহযোগিতা চেয়েছিলাম, তারা আমাকে আশ্বস্ত করলেও এ ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত কেনো পদক্ষেপ নেয়নি। দেশে আসার পর থেকে আমার সঙ্গে আর কোনো ধরনের যোগাযোগ করেনি তারা। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছিল।
অভিবাসী ডটকম: সম্প্রতি আপনি ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামে যুক্ত হয়েছেন। অভিবাসীদের কল্যাণে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করতে আগ্রহী হলেন কেন?
রায়হান: দেখুন, আমি শুধুমাত্র দরদ দেখিয়ে ওই একদিনই যে আল জাজিরাতে কথা বলেছি, তা কিন্তু নয়। ‘বাংলাদেশ স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশন মালয়েশিয়া’ সংগঠনটিতে যুগ্ন আহবায়ক হিসেবে কাজ করেছি । মালয়েশিয়াতে বাংলাদেশী ছাত্রদের সমস্যা নিয়ে কাজ করেছি। পাশাপাশি সেখানকার বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য চাঁদা তুলে সহযোগিতা করাসহ তাদের অধিকার আদায়ে জনমত গঠন করেছি। ছয় বছর যাবৎ আমি প্রতিনিয়তই অভিবাসীদের প্রতি অন্যায়ের বিপক্ষে সোচ্চার ছিলাম। আমি এটাতে আনন্দবোধ করি। অভিবাসীদের জন্য কিছু করতে পারাটা আমার কাছে নেশার মতো, আর সেটাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার সুযোগ ব্র্যাক আমাকে দিয়েছে। এটা আমার জন্য একটা বড় প্লাটফর্ম। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে ভুলে নতুন করে অভিবাসীদের কল্যাণের মধ্য দিয়ে আমার জীবনটাকে উপভোগ করতে চাই।
অভিবাসী ডটকম: বৈদেশিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশের জন্য কী ধরনের পরিবর্তন দেখতে চান?
রায়হান: সবকিছুকে ঢেলে সাজাতে হবে। আজকে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৩ বিলিয়ন ডলার। আমাদের মতো দেশের জন্য এই পরিমানটা অনেক বড়। এটাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে রেমিটেন্স। অথচ বাজেটের সর্বশেষ পঞ্চম তালিকার তলানিতে রয়েছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। এটা কখনই মানানসই নয়। আমি মনে করি এটা একধরনের অবিচার। যদি মালয়েশিয়ার কথা বলি, সেখানে প্রায় ২০ লক্ষ বাংলাদেশী কর্মী রয়েছে, আর সরকারের কর্মকর্তা অছে মাত্র দশ থেকে পনেরো জন। তারা তাদের মৌলিক সেবাটুকু দিতে পারেন না, সেখানে প্রবাসীদের আত্বমর্যাদা বা অধিকার নিয়ে কথা বলবেন কখন। এখানে বড় ধরণের পরিবর্তন আনা দরকার।
আরো একটি বিষয় হলো, অভিবাসন ব্যায় কমানো। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশ কর্মী নিচ্ছে তাদের প্রয়োজনে, সেখানে কর্মীদেরকে কেন অতিরিক্ত টাকা ব্যায় করতে হবে? ভারতের তুলনায় আমাদের অভিবাসন ব্যায় কয়েকগুন বেশি। ২০১৭ সালে দশ এজেন্সির সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মালয়েশিয়াতে কর্মী পাঠাতে খরচ হয়েছে জনপ্রতি সাড়ে তিন লক্ষ টাকা , যেখানে সরকারি ব্যয় ৩৭ হাজার পাঁচশত টাকা। এটি নিয়ে মামলাও হয়েছে, কিন্তু আমাদের দেশে বিচারের বাস্তবায়ন খুব একটা দেখা যায় না। এর একটা স্থায়ী সুরহা প্রয়োজন। অভিবাসন ব্যায় কমানোর জন্য কূটনৈতিকভাবে একটা সমাধানে আসা উচিত। এছাড়াও কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে স্থানীয় এজেন্ট এর পরিবর্তে জি টু জি অর্থাৎ সরকারের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ প্রক্রিয়া থাকা উচিত। এটি অন্যান্য দেশে চালু আছে।
নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতে সিন্ডিকেট বিরোধী, দালালমুক্ত অভিবাসন প্রক্রিয়া এবং স্বচ্ছ ও সহজবোধ্য তথ্যের প্রচার জনগনের দোরগোড়ায় পৌছানো জরুরি। অভিবাসীদের আত্বমর্যাদা রক্ষার, বিশ্বের বুকে লাল সবুজের পতাকার মান রক্ষার লড়াইটা আমাদের সবার।
অভিবাসী ডটকম: রায়হান কবির আপনাকে ধন্যবাদ আমাদের সময় দেওয়ার জন্য।
রায়হান: অভিবাসী ডটকমকেও ধন্যবাদ।