শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলছে সৌদি আরবে, অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশও

0
904
সৌদি স্কুল-অভিবাসী

বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ এর কারণে ১৮ মাসেরও বেশি সময় ধরে সৌদি আরবের শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকে দূরে আছে। তবে শিক্ষার্থীরা যাতে শ্রেণীকক্ষে গিয়ে ক্লাস শুরু করতে পারে সে ব্যাপারে বিস্তর পরিকল্পনা সাজিয়েছে দেশটির সরকার।
আগামী ২৯ অগাস্ট থেকে সৌদি আরবে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল খুলে দেয়া হবে এবং যথারীতি স্বাস্থবিধি মেনে শিক্ষার্থীরা শ্রেণীকক্ষে যাওয়া শুরু করবে। করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনাসহ নানাবিধ ব্যবস্থা গ্রহণের পর এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলো কর্তৃপক্ষ।


অন্যদিকে, একই সময় ধরে বাংলাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পরিপ্রেক্ষিতে তা খুলে দেয়ার জন্য বিভিন্ন মহলের দাবি স্বত্বেও সরকার এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও বিশ্লেষকদের অনেকের দাবি, সঠিক পরিকল্পনা করতে না পারার কারণেই এরকম পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। এক্ষেত্রে সমন্বিত, সুশৃঙ্খল ও সংগঠিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে সৌদি আরবের মতো বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও খুলে দেয়া যেতে পারে।

যেসব শর্ত ও নির্দেশনা মানতে হবে


সৌদি সরকার স্কুল খোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কিছু শর্ত ও নির্দেশনা যুক্ত করেছে। যেমন, শিক্ষার্থীদেরকে বইয়ের ব্যাগ, দুপুরের খাবারের বাক্স, মাস্ক ও স্যানিটাইজার সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। এছাড়া যেসব শিক্ষার্থী দুই ডোজ ভ্যাকসিন অথবা ভ্যাকসিনের পূর্ণ কোর্স সম্পন্ন করেছে কিংবা কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়েছে এবং এ বিষয়ক প্রমাণপত্র দিতে পারবে, তারাই কেবল স্কুলে গিয়ে সরাসরি ক্লাস করতে পারবে।

অন্যদিকে প্রাথমিক ও প্রিস্কুলের শিক্ষার্থীদের পূর্ণ ডোজ বা সম্পূর্ণ টিকাদানের মাধ্যমে ৭০ শতাংশের বেশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন না হওয়া পর্যন্ত স্কুলে ফিরতে দেয়া হবে না।
এছাড়াও সৌদি সরকার ‘বাদ যাবে না কোনো শিশু’ অনানুষ্ঠানিকভাবে এই প্রপঞ্চকে অনুসরণ করে ছেলেমেয়েদের টিকা দিতে অভিভাবকদের উৎসাহিত করছে। স্কুল কর্তৃপক্ষও এ বিষয়ক তথ্য পর্যবেক্ষণে রাখছে এবং এ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করছে। ‘তাওক্কালনা’ নামের একটি অ্যাপের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও স্কুলে কর্মরত শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বাস্থ্য, ভ্যাকসিন ও সংক্রমণ বিষয়ক যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণ করছে।


এই অ্যাপের ‘উই আর লার্নিং উইথ কশান’ বিভাগে গেলে সেখানে দেখা যাবে শিক্ষার্থীর সংখ্যা, কারা আক্রান্তদের সংস্পর্শে এসেছিল, আক্রান্তের সংখ্যা ও কাদের শরীরে এরই মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সে বিষয়ক যাবতীয় তথ্য।
বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ ঘোষণা করা হলেও সৌদি আরব ছিল ব্যতিক্রম। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়পড়–য়া শিক্ষার্থীদের যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বশরীরে পড়াশুনা এবং চূড়ান্ত পরীক্ষাগুলোতে অংশগ্রহণের অনুমতি দেয়া হয়েছিল।


শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া

এদিকে, প্রায় দেড় বছর পর স্কুল খুলছে-এমন খবরে বেজায় খুশি শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। অনেকদিন পর সবার সঙ্গে দেখা হবে এমনটা ভেবে ব্যাপক উচ্ছ¡সিত তারা। বিদ্যালয় খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তের পর কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে আরব নিউজ। এসময় অনেকদিন পর বিদ্যালয়ে যাবার অনুভুতি ব্যক্ত করেছে শিক্ষার্থীরা। তারা এ খবরে আনন্দ ও উৎফুল্লুতা প্রকাশ করেছে। অবশ্য তারা পড়াশোনা থেকে এতদিন দূরে থাকার তিক্ত অনুভুতিও ব্যক্ত করেছে।

পর পর তিন সেমিস্টার ক্লাস থেকে দূরে ছিলেন নাদ সাউদ আল-কুওয়াইদি (১৭)। করোনাকালীন পড়াশোনার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘কখনো কখনো তথ্য ঠিক মতো আদান-প্রদান করা যেত না এবং দূরত্বের কারণে অনেক কিছুই বুঝে ওঠা কঠিন ছিল। কখনো কখনো ইন্টারনেটের লাইনও কেটে যেত অথবা শব্দ পড়ে যেত।’ তিনি যোগ করেন, ‘আমি আমার স্কুল ও বন্ধুদের মিস করি। আমি আমার শিক্ষকদের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল। এমনকি আমি স্কুল রুটিনও মিস করি।’

সৌদি প্রবাসীদের অভিমত

সৌদি আরবে বসবাসরত অসংখ্য বাংলাদেশি আছেন, দেশে যাদের সন্তানরা অন্যান্য শিক্ষার্থীদের মতো দিনের পর দিন স্কুলে যেতে পারছে না। ফলে সন্তানদের শিক্ষাজীবন নিয়ে প্রবাসীদের মধ্যেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সৌদি আরবে স্কুল খুলে দেয়ার ঘোষণার পর অভিবাসী কয়েকজন সৌদি প্রবাসীর কাছে তাদের মতামত জানতে চেয়েছিল। রিয়াদে বসবাসরত বাংলাদেশী নির্মাণশ্রমিক জুলফিকার মোহাম্মদ বলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলে ক্লাস সেভেনে পড়ে। দীর্ঘ সময় ধরে স্কুল বন্ধ থাকায় ও লেখাপড়ায় মনোযোগ দিতে পারছে না। এখন প্রতিদিনই আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুঃশ্চিন্তা বাড়ছে ’ বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়ার ব্যাপারে তার অভিমত, ‘সরকার কঠোর নিয়ম আরোপ করে হলেও যেন অতিস্বত্বর স্কুল-কলেজগুলো খুলে দেয়।’

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

স্কুলের পরিবেশের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো কিছু শেখার ক্ষেত্রে মুখোমুখি মিথস্ক্রিয়া সহায়ক ভুমিকা পালন করে। সামাজিক পারিপার্শ্বিকতাও শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। তবে সমাাজিক দূরত্ব ও মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক হওয়া প্রয়োজন।

করোনা সংক্রমণের প্রকোপ ঠেকানোর যুক্তিতে বাংলাদেশে দীর্ঘসময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার বিপক্ষে যারা, তাদের অন্যতম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আ-আল মামুন। সম্প্রতি তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবিতে গাছতলায় শিক্ষার্থীদের নিয়ে ক্লাস করেছেন। পরবর্তীতে যা দেশব্যাপী আলোচিত হয়।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া প্রসঙ্গে অভিবাসীর সঙ্গে কথা হয় অধ্যাপক আ-আল মামুনের। তিনি বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ আরো ব্যাপক মাত্রায় ছড়িয়ে পড়বে এই এক কথার দোহাই দিয়ে বাংলাদেশ সরকার এখনই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়ার পক্ষে নয়। এই যুক্তি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।’ যুক্তি হিসেবে আ-আল মামুনের অভিমত, ‘এমন নয় যে করোনা একটি নির্দিষ্ট জায়গায় অবস্থান করছে কিংবা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিলে শুধু সেখানেই ছড়িয়ে পড়বে। এখন গড়ে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই কোনো না কোনোভাবে করোনার সংক্রমণ ঘটছে। তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা রাখলে তো দোষের কিছু নেই। এতে তো বাড়তি করে সংক্রমণ বাড়ার কোনো কারণ নেই।’

তাহলে কোন উপায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া যেতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এ সহযোগী অধ্যাপক বলেন, ‘দেখুন, সৌদি আরবসহ অন্যান্য দেশগুলো একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিচ্ছে অনেকগুলো পরিকল্পনাকে মাথায় রেখে। এখানে অর্থনৈতিক সক্ষমতার থেকেও বড় বিষয় হল, তারা সমন্বিত ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

‘ওইসব দেশের নীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে সরকার শারীরিক দূরত্ব মেনে এবং কঠোর স্বাস্থ্যবিধির মতো বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয়, শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনা। তাহলে সংক্রমণের ঝুঁকিও অনেকাংশে কমে যাবে।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here