১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, সদ্য স্বাধীন হওয়া স্বপ্নের বাংলাদেশে পা রাখলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।কিন্তু তার সে সোনার বাংলা যে তখনও বিধ্বস্ত এক ধ্বংসস্তুপ! চারিদিকে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর ধ্বংসলীলার ক্ষতচিহ্ন। নাগরিকদের খাদ্য নেই, নেই পর্যাপ্ত বাসস্থান। কলকারখানার উৎপাদন শূন্যের কোঠায়। ভেঙ্গে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। ওদিকে ভারতে অপেক্ষমান এক কোটি বুভুক্ষু শরণার্থীর মুখ। এমনই অবস্থায় রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব কাধে তুলে নিলেন বঙ্গবন্ধু।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন ছিলো বঙ্গবন্ধুর সামনে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ, যা তিনি সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করেন। একটি রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় এমন কোনো বিষয় নেই যে, তিনি স্পর্শহীন রেখেছেন। তিনি মাত্র সাড়ে তিনবছর দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন। তার মধ্যে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সুদূরপ্রসারি সব পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। বাস্তবায়ন করেছিলেন অনেক অসাধ্য কর্মসূচির। মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর একটি সময়োপোযোগী আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য তিনি সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।
বিশেষ করে ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের ফিরিয়ে এনে তাদের পুনর্বাসনসহ কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন করেন। বিপর্যস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠনে তিনি বিপুল পরিমান কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিকে নজর দেন। সেই লক্ষ্যে তিনি ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন। কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও কর্মী প্রেরণ বিষয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশসমূহের সাথে সমঝোতা সৃষ্টি করেন। যদিও সেই সমঝোতার পথ তৈরি করা সহজসাধ্য ছিলো না।
১৯৭২ সালের প্রথম কয়েক মাসেই বাংলাদেশ বিশ্বের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ দেশের স্বীকৃতি পায়। জাতিসংঘের সদস্যপদ পেতে বঙ্গবন্ধু জোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য হয়, তার মধ্যে ছিলো জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন (ন্যাম) এবং অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশন (ওআইসি)। আলজিয়ার্সের ন্যাম সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং জাতিসংঘের সদস্যপদ পেতে তাদের সমর্থন চান।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরেপেক্ষ হওয়ার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে দেরি করে। ১৯৭৩ এর শেষ এবং ’৭৪ এর শুরুর দিকে বঙ্গবন্ধু কামাল হোসেনকে তার দূত হিসেবে পাঠান বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখা করার জন্য। ফেব্রুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সফর করেন আলজেরিয়া, লিবিয়া, কুয়েত, ইরাক, লেবানন, জর্ডান, বৈরুত, কাতার, বাহারাইন, দোহা, আবুধাবি ও সৌদি আরব। তাঁর এই সফর ছিলো অত্যন্ত ফলপ্রসূ। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রচারণার সত্ত্বেও মুসলিম দেশগুলোর ভুল ধারণা তাতে দূর হয়। বঙ্গবন্ধুর সৌহার্দ্যপূর্ণ নীতির কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বের সর্ম্পক তৈরি হয়। তারই ধারাবাহিকতায় সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে বাংলাদেশী কর্মী গমন শুরু হয়।
বঙ্গবন্ধুর সুদুরপ্রসারি পদক্ষেপ আজ সুফল বয়ে এনেছে বাংলাদেশের শ্রমশক্তিতে। বাংলাদেশ বর্তমানে শ্রমশক্তি রপ্তানিতে বিশ্বে ৬ষ্ঠতম অবস্থানে পৌঁছেছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে বিদেশের শ্রমবাজারে এক কোটি ২০ লাখ বাংলাদেশী শ্রমিক কর্মরত। যার ৮৮ শতাংশই অবস্থান করছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারে পৌছেছে । দেশের অর্থনীতির চাকাকে ক্রমাগত সচল রাখছে এই রেমিট্যান্স। সবমিলিয়ে বলা যায়, আজ যে লাখ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক নানান দেশের উন্নয়নে অবদানের পাশাপাশি নিজের দেশ নির্মাণে ভূমিকা রেখে চলেছেন অবিচল, সেই সফলতার ভিত্তি একজন ব্যক্তির হাত ধরেই হয়েছিল, তিনি আর কেউ নন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।