সৌদি আরবে বাংলাদেশি গৃহকর্মী আবিরন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তার তিন আসামির কাউকে জামিন দেয়নি আদালত। আদালত এ ব্যাপারে আসামিদের লিখিত জবাব দিতে বলেছে। গত ৬ জানুয়ারি এই মামলার সর্বশেষ শুনানি ছিল। আদালত আগামী ২০ জানুয়ারি মামলার পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করেছেন। আবিরনের পরিবারকে উদ্ধৃতি দিয়ে এসব তথ্য জানিয়েছেন ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান। তিনি বলেন, আবিরনের পরিবার বলেছে তারা এই ঘটনায় কোন সমঝোতা নয়, বরং জানের বদলে জান (কিসাস) চান। তারা চান আর কোন আবিরন যেন এভাবে মারা না যায়।
খুলনার পাইকগাছার মেয়ে আবিরন পরিবারের স্বচ্ছলতার আশায় স্থানীয় দালাল রবিউল মারফত ঢাকার একটি রিক্রটিং এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন ২০১৭ সালে। ২০১৯ সালের ২৪ মার্চ তাকে হত্যা করা হয়। কিন্তু দীর্ঘদিনেও পরিবারটি লাশ পাচ্ছিল না। এরপর পরিবারটি বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির সহায়তায় ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মাধ্যমে ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর তার লাশ দেশে আনা হয়। লাশের সঙ্গে থাকা আবিরনের মৃত্যুসনদে মৃত্যুর কারণের জায়গায় লেখা ছিল মার্ডার (হত্যা)। লাশ যেদিন আসে ওই দিন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত (সুয়োমোটো) হয়ে একটি তথ্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করে। কমিশনের অবৈতনিক সদস্য নমিতা হালদারকে এই তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি ২৫ নভেম্বর খুলনার পাইকগাছা উপজেলার রামনগর গ্রামে আবিরনের বাবা আনছার সরদারের বাড়ি সরেজমিন পরিদর্শন করে, এজেন্সি, মন্ত্রণালয়, দূতাবাসসহ সবার সঙ্গে কথা বলে ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বর বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দেন। পরিবারের অভিযোগ, আবিরন যে বাসায় কাজ করতেন, সেখানে মোট আটজন পুরুষ থাকতেন। তারা আবিরনকে যৌন নির্যাতনও করতেন। খাবার খেতে না দেওয়া, গ্রিলে মাথা ঠুকে দেওয়াসহ নানান নির্যাতন তো ছিলই।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪০ বছরের বেশি বয়সী আবিরনকে পিটিয়ে, গরম পানিতে ঝলসে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করে তাকে খুন করা হয়। সাত মাস সেখানকার এক মর্গে ছিল আবিরনের লাশ। প্রতিবেদনে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড, জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) বিভিন্ন স্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি, আবিরনকে হাত বদল করে বিদেশ পাঠানো বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সি, দালালসহ অভিযুক্তদের বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরে দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির সুপারিশ করা হয়।
আবিরনকে হত্যার ঘটনায় দালাল রবিউলকে প্রধান আসামি করে ২০১২ সালের মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনেও দেশেও একটি মামলা হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে খুলনার সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পাশাপাশি এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায় এবং অভিযুক্ত নির্যাতনকারীদের আদালতের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করে মানবাধিকার কমিশন। এরপর আবিরনের পরিবারের পক্ষ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে গত ১৬ ডিসেম্বর থেকে বিচার শুরু হয়। সৌদি আরবে বাংলাদেশি কোন গৃহকর্মী হত্যার ঘটনায় বিচারের এমন ঘটনার উদাহরণ বিরল। মামলার সর্বশেষ শুনানি ছিল বুধবার। সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, ওইদিন সকালে রিয়াদের ক্রিমিনাল কোর্টের ৬ নম্বর আদালতে মামলার শুনানি শুরু হয়। আবিরনের পরিবারের পক্ষ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে রিয়াদে দূতাবাসের প্রথম সচিব মো. সফিকুল ইসলাম ও অনুবাদক সোহেল আহমেদ শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন। শুনানিতে সৌদি আরবের পাবলিক প্রসিকিউশনের প্রতিনিধি আবদুল্লাহ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া এই হত্যার ঘটনায় আটক তিন সৌদি নাগরিক আবিরনের গৃহকর্তা বাসেম সালেম, তার স্ত্রী আয়েশা আল জিজানি এবং এই দম্পতির ছেলে ওয়ালিদ বাসেম সালেম আইনজীবীসহ জেলখাান থেকে ভার্চুয়ালি উপস্থিত ছিলেন। শুনানীর শুরুতে আদালত দূতাবাস প্রতিনিধির কাছে মৃতের ওয়ারিশের পাঠানো পাওয়ার অব অ্যাটর্নি ও রাষ্টূদূত কর্তৃক অথারাইজেশন চিঠি আনা হয়েছে কী না তা জানতে চান। দূতাবাস প্রতিনিধি মৃতের ওয়ারিশদের প্রেরিত পাওয়ার অব অ্যাটর্নি ও অথরাইজেশন চিঠি আদালতে দেন। আদালত সেগুলো যাচাই করে সৌদি বিচার মন্ত্রণালয়ের সিস্টেমে আপডেট করেন। এরপর শুনানি শুরু হয়। এই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগপত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ও ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা এবং হত্যায় সহযোগিতা করার কথা উল্লেখ আছে। এ বিষয়ে আদালত দূতাবাসের প্রতিনিধির কাছে আবিরনের ওয়ারিশদের দাবি জানতে চান। জবাবে দূতাবাস প্রতিনিধি জানান, আবিররনের পরিবার জানের বদলে জান (কেসাস) চান। আদালত এ ব্যাপারে আসামিদের বক্তব্য জানতে চাইলে আসামিরা মৌখিকভাবে অভিযোগ অস্বীকার করে এবং আইনজীবীর মাধ্যমে লিখিত বক্তব্য দেবে বলে জানায়। এ সময় আসামিপেক্ষর আইনজীবী অন্তত পরিবারের কর্তা বাসেম সালেমীর জামিন আবেদন করেন। কিন্তু আদালত জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাদের লিখিত জবাব দিতে বলেছে। এরপর আদালত ২০ জানুয়ারি পরের তারিখ নির্ধারণ করে আদালত মুলতবি করেন।
শুধু আবিরন নয়, গত পাঁচ বছরে প্রায় ৫০০ নারীর মরদেহ দেশে ফিরেছে। এর মধ্যে অন্তত ২০০ জনেরই লাশ এসেছে সৌদি আরব থেকে। কিন্তু এসব ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে সাজা হয়নি। মানবাধিকার কমিশন আবিরন হত্যার ঘটনায় ৮ দফা এবং বিদেশে নারীদের সুরক্ষায় আরও ৮ দফা সুপারিশ করেছেন যেগুলোর অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়নি। ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান বললেন, ‘শুরু থেকেই আমরা আবিরনের পরিবারের পাশে আছি। কারণ সৌদি আরবে বাংলাদেশি গৃহকর্মীদের উপর নির্যাতন বা হত্যার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। কিন্তু বিচার হয় না। সেদিক থেকে আবিরণের ঘটনা ব্যতিক্রম। একটি ঘটনাতেও যদি অভিযুক্তদের শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হয়, তখন অন্য মালিকেরা কিছুটা হলেও ভয় পাবেন এবং সচেতন হতে বাধ্য হবেন।