কানাডিয়ান অভিবাসন নীতি বিশ্বে অনুকরণীয়

0
1009

‘১০০ দিনের মধ্যে পঁচিশ হাজার সিরিয়ান, কানাডিয়ান অভিবাসন নীতির শ্রেষ্ঠত্বের বহিঃপ্রকাশ ‘ শিরোনামে সিআইসি নিউজ এ প্রকাশিত কারিম এল-আসাল রচিত এই প্রবন্ধটি ভাষান্তর করেছেন, রুবেল পারভেজ |


কানাডায় ২০১৫-১৬ সালে ‘সিরিয়ান রিফিউজি অপারেশন’ এর অধীনে দেশটিতে সিরিয়ার শরণার্থীদের নিয়ে প্রথম বিমান অবতরণের পাঁচ বছর পূর্তি হলো গতকাল (১০ ডিসেম্বর ২০২০)। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ২৫ হাজার সিরিয়ান শরণার্থীকে গ্রহণ করার উচ্চাভিলাসি কর্মপন্থা ২০১৫ সালের নভেম্বরে বাস্তবায়ন শুরু করেছিল কানাডা সরকার।এই পদক্ষেপটি সবচেয়ে বেশি সমর্থন পেয়েছিল কানাডার নাগরিকদের কাছ থেকে। এটা ছিল পূর্ববর্তী মাসের নির্বাচনকেন্দ্রিক একটি ইস্যু যখন কানাডিয়ানরা ২০১৫ সালের অক্টোবরে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।


বছর শেষে ২৫ হাজার সিরিয়ানকে গ্রহণ করা হবে এমন ওয়াদা করে জাস্টিন ট্রুডো নির্বাচনী ক্যাম্পেইন করেছিলেন। সমুদ্রতীরে উপুড় হয়ে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকা তিন বছরের সিরিয়ান শরণার্থী শিশু অ্যালান কুর্দির মর্মান্তিক ছবি কানাডার জনগণের মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। মূল প্রশ্ন এটা ছিল না যে, সিরিয়ায় কানাডার অপারেশন নিয়ে এগিয়ে যাওয়া উচিৎ নয়, বরং ট্রুডোর সময়সীমা যদি অর্জন হয়।


কানাডিয়ানরা ট্রুডোকে সংখ্যাগরিষ্ট নির্ভর একটি সরকার দিয়েছে এবং তাকে এর প্রধানমন্ত্রী করেছে। তিনি ও তার সরকার দেশটিকে প্রস্তুত করার জন্য পর্যাপ্ত সময় দেয়ার এবং অপারেশন চালানোর জন্য নির্দিষ্ট বেঁধে দেয়া সময়সীমাকে পেছনে ফেলেছিলেন।


একশ দিন পর ২০১৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি কানাডা তার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছিল। লক্ষ্য অর্জনের জন্য অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছিল। ইমিগ্রেশন রিফিউজিস অ্যান্ড সিটিজেনশিপ কানাডা (আইআরসিসি) এতে কর্মরত সরকারি কর্মচারীরা রাতদিন কাজ করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে এই কার্যক্রম পরিচালনায় সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে সেখানে যাওয়ার কারণে অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাড়িতে একটু বিশ্রাম নেয়ারও ছুটি পর্যন্ত নেননি।


অটোয়া এবং দেশে কেন্দ্র ও প্রদেশসহ সারা দেশে সরকারি কর্মচারিরা বছরজুড়ে অবসরকাল, সাপ্তাহিক ছুটি না কাটিয়ে ওভারটাইম করেছেন। শীর্ষ কেন্দ্রীয় কর্মকর্তারা এবং প্রাদেশিক অভিবাসন বিষয়ক প্রজাতন্ত্রের কর্মচারিরা প্রতিদিনই কনফারেন্স কলে যুক্ত থেকেছেন। সবাই যখন সমস্বরে বলেছিল মিশন শেষ, অনেক সরকারি কর্মচারিরা এই অর্জনকে নিজেদের ক্যারিয়ারের জন্য মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

সিরিয়ার শরণার্থীদের গ্রহণের বিষয়টির মোকাবিলায় কানাডার সামর্থ্য কতোটা আছে এ নিয়ে বড় ধরনের সন্দেহ ছিল। বিশেষ করে অল্প সময়সীমা। তবে এখানে কানাডার জনগণের উদারতা নিয়ে কোনো দ্বিধা ছিল না।


শরণার্থীদের সাহায্য করা নিয়ে কানাডার সুখদুঃময় এক ইতিহাস আছে। হলোকাস্টের সময় সাইডলাইনে থাকার বিষয়টিকে দেশটি আক্ষেপজনক সিদ্ধান্ত বলে বিবেচনা করেছিল। যাহোক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি থেকে আইন সংশোধন করার চেষ্টা করেছে।


১৯৪৭ সালের পয়েলা মে সংসদে দাঁড়িয়ে দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম লিয়ন ম্যাকেঞ্জি কিং কালজয়ী এক ভাষণে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কানাডার অভিবাসন বিষয়ক লক্ষ্যমাত্রাসহ শরণার্থীদের সহায়তা করার বিষয়টিকে নৈতিক দায়িত্ব বলে উল্লেখ করেছিলেন।


যখন শরণার্থী সহায়তার কথা আসে তখন কিং সে অর্থে তারকাখ্যাতি সম্পন্ন কেউ ছিলেন না। তারপরও হলোকাস্টের সময় তার বক্তব্য কানাডিয়ান অভিবাসনের আধুনিক যুগকে সংজ্ঞায়িত করতে সহায়তা করেছিল। যুদ্ধের পরের দশকগুলিতে কানাডা বিশ্বের সমস্ত প্রান্ত থেকে শরণার্থীদের স্বাগত জানিয়েছে।


১৯৫০ এর দশকে হাঙ্গেরিয়ান শরণার্থীদের পুনর্বাসনের পাশাপাশি ১৯৭০ সালে ভিয়েতনাম, লাওস এবং কম্বোডিয়া থেকে শরণার্থী আসার পর থেকে কানাডার ইতিহাসে সিরিয়ান শরণার্থীদের নিয়ে প্রচেষ্টা শুরু হয়। কানাডিয়ানদের মহানুভবতা সত্যিকার অর্থে সামনে আসে যখন ভাসমান মানুষদের রক্ষার অভিযানের সময় কানাডিয়ানরা নতুন ‘প্রাইভেট স্পন্সরশিপ অব রিফিউজি প্রোগ্রাম’ এর মাধ্যমে দশ হাজার মানুষকে নতুন জীবন গড়ার সুযোগ তৈরী করে দেয়। ১৯৭৮ সালে চালু হওয়া প্রোগ্রামটি কানাডিয়ানদের বিদেশ থেকে শরণার্থীদের স্পন্সর করার জন্য এবং কানাডায় আসার পর মানসিক ও আর্থিকভাবে তাদের সহযোগিতার জন্য ফেডারেল সরকারের কাছে আবেদন জমা দিতে সক্ষম হয়।

সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘বোট পিপল’দের প্রচেষ্টায়, কানাডা প্রথম এবং একমাত্র দেশ হিসেবে জাগিতসংঘ থেকে ন্যানসেন মেডেল পুরস্কার লাভ করে। ১৯৮৬ সালে কানাডার জনগণ এ পুরস্কার গ্রহণ করে। শরণার্থীদের স্বীকৃতি দেয়ার জন্য এটাই জাতিসংঘের দেয়া সর্বোচ্চ পদক।


অপারেশন সিরিয়ার সময় কানাডার অভিবাসন মন্ত্রী জন ম্যাককালাম প্রায়শই জনসম্মুখে তামাসা করে বলতেন যে, তিনি বিশ্বের একমাত্র অভিবাসন মন্ত্রী, যিনি পর্যাপ্ত শরনার্থীদের স্বাগত জানাতে না পেরে সমালোচিত হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে কানাডিয়নদের উদারতার জন্য এখনও পর্যন্ত দেশটি প্রায় ৪৫,০০০ সিরিয়ান শরনার্থীদের স্বাগত জানিয়েছে। এই উদ্যোগের ৫ বছর পূর্তি বেশ কয়েকটি বিষয়কে স্মরণ করিয়ে দেয়।


প্রথমত, সক্ষমতা অগ্রাধিকার দ্বারা নির্ধারিত হয় এবং যখন কোনো বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মাধ্যমে লক্ষ্যে পৌছানো যায়। যেমন সিরিয়াদের স্বাগত জানানো বা ছয় মাসের মধ্যে এক্সপ্রেস এন্ট্রি অ্যাপ্লিকেশনগুলি প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদির মাধ্যমে কানাডা সরকার তাদের অভিবাসন লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

দ্বিতিয়ত, কানাডার একটি কঠোর অভিবাসন ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য খ্যাতি রয়েছে, যা অন্য দেশগুলোর জন্য উদাহরণসূচক। অবশ্য কানাডিয়ান অভিবাসন নীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য মানবিক দিক রয়েছে। কানাডার উল্ল্খেযোগ্য তিনটি অভিবাসন লক্ষ্যের মধ্যে অন্যতম হলো সিরিয়ানদের স্বাগত জানানো। আার বাকি দুটো হলো, পরিবারগুলোকে একত্রিত করা এবং অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা। নিঃসন্দেহে কানাডা শরনার্থী সহায়তায় বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে রয়েছে।
পরিশেষে এটাই বলা যায়, নতুন আগতদের স্বাগত জানানো কানাডাকে আরো প্রানবন্ত দেশে পরিনত করেছে। দেশটির অধিকাংশ নাগরিক, ধর্মীয় সম্প্রদায়, অলাভজনক এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান সবাই ১০০ দিনের মধ্যে ২৫,০০০ সিরিয়ানকে স্বাগত জানানোর যৌথ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করেছিলো। খুব শীগ্রই এই প্রাক্তন সিরিয়ান শরনার্থীরা কানাডার ভবিষ্যতের নতুন প্রজন্মের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে কানাডার অর্থনীতি এবং সমাজে দীর্ঘস্থায়ী অবদান রাথতে প্রথম সারিতে থাকবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here