হাফিজা হামিদের বয়স মাত্র পাঁচ মাস, যখন ১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ এ ম্যানহাটনের টুইন টাওয়ারে বিমান হামলা হয়।
কিন্তু সেই আক্রমণের প্রভাব তার জীবন ও পরিচয়ে পরোক্ষভাবে রয়ে গেছে । যখনই এই হামলার ঘটনার বার্ষিকী পালিত হয়, ব্রুকলিন কলেজের শিক্ষার্থী হাফিজা নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে যে কিভাবে সে তার সহপাঠীদের প্রশ্নের মুখোমুখি হবে।
২০ বছর বয়সী হাফিজা বলেন, ‘যখনই দিনটি আসে, এটি সত্যিই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করে এবং একরকম বিচ্ছিন্নতা অনুভব করি আমি। মূলত ‘আমি অনুভব করি যে আমার দিকে যেন বাঁকা দৃষ্টিতে তাকানো হচ্ছে।’
৯/১১ এর সময় আঞ্জুম উদ্দিনের জন্ম হয়নি, কিন্তু এই তারিখের ভীতিকর অনুভূতি তার জীবনের সাথেও সম্পর্কিত। তিনি ২০১৯ সালে হামলার ১৮তম বার্ষিকীতে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া একটি কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতার কথা স্পষ্টভাবে মনে রেখেছেন।
২০ বছর পরেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সারাবিশ্বে পররাষ্ট্র নীতি থেকে অভিবাসন পর্যন্ত সবক্ষেত্রেই এই হামলার প্রভাব অনুভূত হচ্ছে।
কিন্তু ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ২০১০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে জন্মগ্রহণ করা ‘জেড জেনারেশন’ মুসলমানদের তরুণ-তরুণী তাদের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তাদের পরিচয় সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতার মধ্যে ছিল।
মসজিদ থেকে শুরু করে ক্যাফে পর্যন্ত, নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগ হামলার পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর ব্যাপক নজরদারি চালায়। কলেজ ক্যাম্পাস এবং মুসলিম ছাত্র গোষ্ঠীর উপর তাদের নজরদারি এতদূর পর্যন্ত পৌঁছেছিল যে এর মধ্যে শহরের সীমানার বাইরের স্কুলও ছিল।
মুসলিম জনগোষ্ঠীতে অনুপ্রবেশকারী প্লেইন -ক্লোথ অফিসারদের এনওয়াইপিডি টিম, ডেমোগ্রাফিক্স ইউনিট, ২০১৪ সালে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। বিভাগটি শেষ পর্যন্ত এই বিষয়ে তিনটি মামলা নিষ্পত্তি করে, ক্ষতিপূরণ এবং আইনি ফি বাবদ ১ মিলিয়নেরও বেশি অর্থ প্রদান করে।
কিন্তু মুসলিমদের প্রতি তাক করা সন্দেহের তীর এখনও ঠিকই অবিচল রয়েছে।
প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৫ সালে নির্বাচনী প্রচারণার সময় বলেছিলেন যে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার লক্ষ্য হবে মুসলমানদের জন্য সীমানা সম্পূর্ণ এবং সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা। এমনকি তার অষ্টম কর্মদিবসে তিনি ‘মুসলমানদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন, যার ফলে সাতটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ স্থগিত করা হয়।
২০তম বার্ষিকী ঘণিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে, তরুণ মুসলমানরা ৯/১১ পরবর্তী সময়ে তাদের বেড়ে ওঠা, কীভাবে এটি সময়ের সঙ্গে তাদের পরিচয়ের উপর প্রভাব ফেলেছে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে কেমন দেখতে চান এসব নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা ও মতামত ব্যক্ত করেছেন-
এই কথোপকথনগুলি আরো স্পষ্টতার জন্য সম্পাদনা করা হয়েছে।
মোসাব সাদিয়ে (২১), স্টাটেন দ্বীপ
আমার মনে পড়ে, তখন আমার বয়স ৯ বছর হবে, তখন একজন গোয়েন্দা প্রকৃতির কোনো এক ব্যক্তির মুখোমুখি হয়েছিলাম। এই নতুন মসজিদটি যখন খোলা হয়েছিল তখন সে এখানে এসেছিল, সে আমাকে অদ্ভুত প্রশ্ন করতে থাকে। আমার কাছে এটি খুব অপরিচিত বিষয় ছিল। আমি অনেক মানুষের সঙ্গে দেখা করেছি যাদেরকে তথ্যদাতা বলে সন্দেহ করেছি। তাদের মধ্যে অনেকেই, আমরা পরে জানতে পেরেছি যে, হ্যাঁ, তারা তথ্যদাতা ছিল। তারা সবসময় জিজ্ঞাসা করে, যেমন, ‘হামাস সম্পর্কে আপনি কী ভাবেন? ফিলিস্তিন সম্পর্কে আপনি কি ভাবেন? ইসরায়েল সম্পর্কে আপনি কী ভাবেন? আপনি বুঝতে পারছেন, আমি এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি যখন আমার বয়স 8 বছর পেরিয়েছে কেবল।
হাফিজা হামিদ (২০), ব্রুকলিন কলেজ
আমার মনে আছে মিডল স্কুলে পড়ার সময় যখনই প্রসঙ্গটি আসত, মানুষেরা কেবল আমার দিকে তাকিয়ে থাকত এবং বলত- ‘ওহ তোমরাইতো তারা, যাদের জন্য এই হামলার ঘটনা ঘটেছিল ।’
আমার মনে আছে বাচ্চাদের মধ্যে এই প্রবণতা ছিল, যেমন, একটি বোতল পপ করা। যখনই এটি ‘বুম’ শব্দ করবে, তখন তারা আরবিতে এমন কিছু চিৎকার করবে যা ইসলামের সাথে সম্পর্কিত। এমনকি আমরা যে বন্ধুদের সঙ্গে সবসময় কথা বলতাম তারাও এমনটা করত। এটি এতটাই স্বাভাবিক ছিল যে এমন আচরণকে তারা খারাপ বলে মনে করত না ।
আনজুম উদ্দিন (১৬), দ্য ব্রঙ্কস
আমি ব্রঙ্কসে বসবাস করি। এটি প্রধানত নানা বর্ণের মানুষের শহর। একজন তরুণ মুসলিম নারী হওয়ার কারণে আমার খুব বেশি প্রতিক্রিয়া হয়নি, কিন্তু যখন আমি ম্যানহাটনে স্কুলে যাওয়া শুরু করি, তখন বিষয়টি অনুভব করতে থাকি। আমি বুঝতে পারছিলাম, ‘ওহ, বাহ, মানুষেরা এখনও কয়েক বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে মুসলিম জনগণের উপর তাদের রাগ বহন করছে।’
একদিন এক আগন্তুক তার কাছে এসেছিল এবং তার বাবা ও তাকে বলেছিল যে ৯/১১ এর জন্য তারা দায়ী।
`এমন একটি ঘটনার জন্য দায়ী করা হচ্ছে যে, যখন আমাদের জন্মই হয়নি, আমাদের সঙ্গে কেন এমন হচ্ছে? বলছিলেন আনজুম।
‘যেহেতু আমি ধার্মিক পিতামাতার সঙ্গে বড় হয়েছি, তাই তারা সবসময় আমাকে বলে যে ৯/১১ এ যা ঘটেছিল – এটি ইসলামের প্রতিনিধিত্ব নয়। এটা সব ইসলামী নীতির পরিপন্থী।’
মোহাম্মদ ফাসেহ সিকান্দার (২৩), ব্রুকলিনে জন্মগ্রহণ করেন
৯/১১ এর কিছু দিন আগে, আমার পরিবার পাকিস্তানে আমাদের অন্য পরিবারকে দেখার জন্য ব্রুকলিন ত্যাগ করে। তারপর ঘটে গেল মর্মান্তিক ঘটনা। তারপর ১০ বছর আমরা পাকিস্তানে ছিলাম। কারণ আমাদের পরিবার এখানে ফিরে আসতে ভয় পেয়েছিল, এই ভেবে যে মুসলমানদের প্রতি এক ধরণের শত্রুতা এবং প্রতিশোধ নেওয়া হচ্ছে।
মুসলিম সম্প্রদায় – বিশেষ করে নিউইয়র্কের অধিবাসীদের এই ভয় বেশি কাজ করছিল। আমাদের মত অসংখ্য পরিবার এই ঘটনার পর ফিরে আসার সাহস পায়নি।
অথচ দেশাত্বোবোধের জায়গা থেকে আমি এখন আমেরিকান রিজার্ভ অফিসার ট্রেনিং কোর প্রোগ্রামের জুনিয়র অফিসার হিসেবে কাজ করছি। যদিও সেক্ষেত্রে আমাকে কঠিন দেশপ্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছে। একজন মুসলিম আমেরিকানও প্রবল দেশাত্ববোধ ধারণ করে থাকে। কিন্তু আমেরিকার রাজনীতি, নীতিনির্ধারণ ও প্রশাসনে কাজ করতে হলে মুসলিম আমেরিকানদের দেশপ্রেমিক হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করে দেখাতে হয়।
পালভাসা খান (১৮), উইলিয়াম কলেজ
৯/১১ এর বার্ষিকীতে আমি সত্যিই খুব অস্বস্তিবোধ করি। যা ঘটেছিল, সেটা সত্যিই মারাত্মক ব্যাপার, কিন্তু একই সঙ্গে এটি বিদ্যমান ইসলাম-ফোবিয়ার কারণকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। এটিকে অনেকগুলো জীবনকে ধ্বংস করার মূল্যায়ণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। যখন মানুষ এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলে আমি ভীষণ অস্বস্তিবোধ করি।
ষষ্ঠ গ্রেডে পড়ার সময় আমার সঙ্গে খুব বাজে ঘটনা ঘটেছিল। একটি বাচ্চা আমার সঙ্গে খুব খারাপভাবে মজা করছিল, যদিও ঠিক সেই সময়টাতে আমি তার ওই আচরণের মর্মার্থ বুঝে উঠতে পারিনি। আমার বাবা মা পাকিস্তানি হওয়ায় সে আমাকে ‘তালেবানের রানী’ বলে ডাকতে থাকে। সে খুব সচেতনভাবেই এটা করছিল এবং আমার মাথায় একটি মুকুট পরিয়ে দিয়েছিল।
অমি বুঝতে পারছিলাম না যে আমার সঙ্গে কেন এমন করা হচ্ছে! এই ঘটনায় আমি খুব ভেঙ্গে পড়েছিলাম।
অন্যদেরকে শেখানোর চাপ থেকে আমি অনুভব করতে পারছিলাম যে, প্রত্যেকে অমার কাছ থেকে ইসলাম সম্পর্কে জানতে চাইতে পারে। একজন মুসলমান হিসেবে আমাকে ইসলামের সম্পূর্ণ বিষয়কে জানতে হবে। কারণ আমাকে প্রতিনিয়তই একজন মুসলিম হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আমাকে আমার পরিচয় নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে, না হলে ইসলাম-ফোবিয়া বিস্তার লাভ করেই যাবে। এই অর্থে আমি বিশ্বাস করি, যে পরিচয় আমি বহন করছি, তা নিয়ে প্রকৃতপক্ষেই ভীষণরকমের আত্মবিশ্বাসী।
সূত্র: স্পেকট্রাম নিউজ