‘যখনই তারা আমার গল্প শুনবে, তখন কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করবে না: আপনি কি মুসলিম? আপনি কি খ্রিস্টান? তারা শুধু একজন মানুষ হিসেবে আপনাকে মূল্য দেবে।’
মাহা মামোর কোনো নাগরিকত্ব ছিলো না। সিরিয়ান বাবা-মায়ের সন্তান মাহা মামো জন্মেছেন লেবাননে। উভয় দেশের জাতীয়তা অর্জনের শর্ত পূরণে তিনি ‘অযোগ্য’ ছিলেন। একজন রাষ্ট্রহীন মানুষকে কতোটা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকতে হয় তা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন মামো আর তার দুই ভাইবোন। বছরে পর বছর স্বদেশ খুঁজে পাওয়ার সুদীর্ঘ প্রচেষ্টায় তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয় ব্রাজিলে এসে।
লেবাননে শৈশবের সময়গুলোতে এই জটিল হিসাব নিকাশ তার বোধগম্য ছিলো না। ১৫ বছর বয়সে মেয়েদের স্কাউটিং এ বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ থেকে মামো যখন বঞ্চিত হয়, তখন সে তার বাবা-মায়ের মুখোমুখি হয়েছিল। তারপরে মিসেস মামো জানতে পেরেছিলেন যে সে আর তার দুই ভাই বোন কোন রাষ্ট্রের নাম পরিচয় ছাড়াই জন্ম নিয়েছে, তারা রাষ্ট্রহীন। তারা যেকোনো দেশের নাগরিকত্বের অযোগ্য, স্কাউট ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় পাসপোর্টসহ সকল ধরনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।
তার বাবা-মা ব্যাখ্যা করছিলেন যে, লেবানন সেখানে জন্মগ্রহণকারী অভিবাসী সন্তানদেরকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নাগরিকত্ব দেয় না। আবার তাদের নিজেদের দেশ সিরিয়া থেকে অনুমোদিত কোনো নথিপত্র সংগ্রহ করাও অসম্ভব ছিল। কারণ সে আর তার স্ত্রী ভিন্ন ধর্মের হওয়ায় সিরিয়ায় তাদের বিবাহ অবৈধ ছিল।
স্বদেশ খুঁজে ফেরার তাড়না মামোকে ব্রাজিলে টেনে আনে। সেখানে ২০১৮ সালে তিনি আর তার বোন সৌদ সেদেশের নতুন অভিবাসী আইনের আওতায় প্রথম রাষ্ট্রহীন মানুষ হিসেবে নাগরিকত্বের স্বীকৃতি পান।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে রাষ্ট্রহীন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩৯ লাখ। মাহা মামো এই বিপুল সংখ্যক রাষ্ট্রহীন মানুষের দুঃখ, দুর্দশার প্রতিনিধিত্ব করেছেন বিশ্ববাসীর কাছে। ৩৮ বছর বয়সী মামো পাসপোর্ট পাওয়ার আগে, কিছু রাষ্ট্রহীন ব্যক্তিদের দেওয়া বিশেষ ভ্রমণ নথি ব্যবহার করে বিশ্ব ভ্রমণ করেছিলেন এবং জাতিসংঘের সম্মেলন ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে আবেগঘন বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন।

বিভিন্ন পরিস্থিতি থেকে রাষ্ট্রহীনতার উদ্ভব ঘটে, যেমন সীমানা পুননির্মাণ, বৈষম্যমূলক আইন (যা নারীদের একটি জাতীয়তার বাইরে অন্য জাতীয়তার সন্তান ধারণে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে), যুদ্ধ ও সহিংসতা থেকে।
মামো রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক আইনের শিকার হয়েছিল। লেবাননের জীবন মামো আর তার দুই ভাই বোনের জন্য সুখকর ছিল না। যখন তারা যুদ্ধবিধ্বস্ত বৈরুতের চেকপোস্ট পার হতো তখন প্রায়শই সিরিয়ানদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হতো।
তাদের পর্যাপ্ত অর্থের সংস্থান ছিল না। তার মা ছিলেন সিরিয়ান নার্স যিনি লেবাননে এসে চাকুরি হারান। তার বাবা একজন স্থানান্তরিত কর্মী হিসেবে সামান্য অর্থ উপার্জন করতেন। বাচ্চারা ক্রিসমাস এবং ইস্টার উপলক্ষ্যে বছরে শুধু দু’বারই নতুন পোশাক পেতেন।
বাচ্চাদের পরিচয়পত্রের কোনো নথি না থাকায় স্কুলে ভর্তি করানো এক প্রকার অলৌকিক ব্যাপার ছিল। কলেজের পাঠ শেষে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় হলো, তখন মিসেস মামোকে মাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি নিতে রাজি হল। যার ফলে মামোর চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন সেখানেই বিসর্জন দিতে হয়।
মামো বলছিলেন ‘লেবানিজ নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আমরা এমন কিছু নেই যে করিনি। এমনকি আমার এক বন্ধুর বাবা-মাকে অনুরোধ করেছিলাম অমাকে দত্তক নেওয়ার জন্যে। আমার ভাই বোনেরা এক পর্যায়ে তাদের ভাগ্য মেনে নিয়েছিল। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি।’
তিনি লেবাননের সব দূতাবাসের একটি তালিকা তৈরি করেন এবং প্রত্যেককে তিনি তার অপূর্ণ সুযোগ আর অনাগত স্বপ্নের বর্ণনা দিয়ে ইমেল প্রেরণ করেন। কয়েক বছর ধরে প্রচেষ্টার পর ২০১৩ সালে মেক্সিকো রাষ্ট্রদূত তাকে সহায়তার আশ্বাস দেয়। এই সম্ভাবনাটি মিসেস সৌদকেও তার ভাগ্য ফেরাতে উৎসাহ দিয়েছিল। ২০১৪ সালে মার্চে ব্রাজিলের দূতাবাস সৌদকে সহয়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে মিসেস মামো ও তার ভাই এডি কে সিরিয়ান শরণার্থীদের জন্য একটি বিশেষ ভিসায় ব্রাজিল ভ্রমনের আমন্ত্রণ জানানো হয়।
মিসেস মামো বলছিলেন, ‘আমি ব্রাজিল সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। শুধু এটুকুই জেনেছিলাম যে, ব্রাজিল একটি অনিরাপদ দেশ।’ মিসেস মামো ফেসবুকের মাধ্যমে স্ক্রল করে ব্রাজিলে থাকা স্কাউটিং এর এক বন্ধুর খোঁজ পেয়েছিলেন। মামোর সেই বন্ধুর পরিবার তাকে এবং তার ভাই বোনদের ব্রাজিলের দক্ষিণ-পূর্ব শহর হরিজন্টে তাদের বাড়িতে থাকার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।
২৬ বছর বয়সী মামো যখন ব্রাজিলে পা রাখলেন, তখন এতো বড় শহর আর তাদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। তবে শীঘ্রই তিনি অনুধাবন করেন তার অভিবাসনকে বৈধ করার কোন সুস্পষ্ট উপায় তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। মামো বলছিলেন, ‘আমি বিভ্রান্তিতে ছিলাম, আমি এখানকার ভাষা বুঝতে পারতাম না, সংস্কৃতি বুঝতে পারতাম না। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে পাম্পলেট বিতরণ করতাম।
২০১৫ সালের মার্চে রাষ্ট্রহীনতা সম্পর্কে ব্রাজিলের একটি টেলিভিশনে দেয়া সাক্ষাৎকার তাকে অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে পরিচিত করে তোলে। জাতিসংঘের সহায়তায় তিনি বিশ্ব ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছিলেন আর এভাবে তিনি লক্ষ লক্ষ রাষ্ট্রহীন মানুষদের নাগরিকত্বের আইনগত সুযোগ তৈরি করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
কিন্তু এতসব প্রচেষ্টার পরও তার ভাই বোনরা রাষ্ট্রহীনতার কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি। তারপর জুন ২০১৬ সালে তার ভাই এডি বাড়ির কাছেই ডাকাতির চেষ্টাকালে নিহত হয়েছিল। এই মৃত্যুতে ব্রাজিলে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। ২০১৭ সালে আইন প্রণেতারা যখন দেশটির অভিবাসী আইনের সংস্কার করছিলেন, তখন তারা রাষ্ট্রহীন মানুষদের নাগরিকত্ব প্রদানের পথকে দৃঢ় করতে একটি নতুন আইন অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন।

২০১৮ সালের জুনে তৎকালীন বিচারমন্ত্রী তোরকোয়াটো জারডিম, মিসেস মামো এবং তার বোনকে রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেখানে তারা প্রথম রাষ্ট্রহীন মানুষ হিসেবে ব্রাজিলের নাগরিকত্বের জন্য যোগ্য হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন।
কয়েক মাস পর, জেনেভার একটি অনুষ্ঠানে মিসেস মামো তার বক্তব্য যখন শেষ করছিলেন ঠিক এমন সময় ব্রাজিলিয়ান কর্মকর্তারা তাকে নাগরিকত্বের কাগজপত্র দিয়ে অবাক করে দিয়েছিলেন।
জাতিসংঘ মহা মামোর কৃতিত্বের জন্য তাকে অভিবাদন জানায়। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার রাষ্ট্রহীনতা বিভাগের প্রধান মেলানিয়া খান্না বলেছেন,‘বিভিন্ন মহাদেশে তার প্রকাশ্য উপস্থিতি এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে উপস্থিতির জন্য ধন্যবাদ। হাজার হাজার মানুষ বুঝতে পেরেছে যে কীভাবে কোনো ব্যক্তি নিজের দোষ ছাড়াই রাষ্ট্রহীন হতে পারে? এবং এর পরিণতিগুলি কত ভয়াবহ।’
মামো বলছিলেন যে, তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বহুু বৈচিত্র্যের দেশ হিসেবে ব্রাজিলকে অনুভব করতে চান। ‘যখনই তারা আমার গল্প শুনবে, তখন কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করবে না: আপনি কি মুসলিম? আপনি কি খ্রিস্টান? তারা শুধু একজন মানুষ হিসেবে আপনাকে মূল্য দেবে।’
আর্নেস্তো লন্ডোনো,দ্য নিউইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে