হজে অংশ নিতে পায়ে হেঁটে মক্কার পথে এক ব্রিটিশ মুসলিম

0
1048
পায়ে হেঁটে মক্কা-হজ-ব্রিটিশ মুসলিম-অভিবাসী


আগামী বছর নির্দিষ্ট সময়ে হজে অংশগ্রহণের লক্ষ্য নিয়ে পায়ে হেঁটে যাত্রা করেছেন ইরাকি-কুর্দি বংশোদ্ভূত এক ব্রিটিশ মুসলিম। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির মতো অসহনীয় পরিস্থিতি চলা স্বত্বেও ৫২ বছর বয়সী আদম মোহাম্মদ নামের এ ধর্মানুরাগী এমন অবিশ্বাস্য সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দুঃসাহসিক স্বপ্ন দেখলেন। এ লক্ষ্যে গত ১ আগস্ট তিনি নিজ বাসস্থান উলভারহ্যাম্পটন থেকে তার পথচলা শুরু করেছেন।

৫২ বছর বয়সী আদম মোহাম্মদকে অতিক্রম করতে হবে ৬ হাজার ৫০০ কিলোমিটারের দীর্ঘ পথ।

এরই মধ্যে আদম মোহাম্মদ নেদারল্যান্ড পৌঁছে গেছেন। এখান থেকে জার্মানি, চেক রিপাবলিক, বুলগেরিয়া, তুরস্ক, সিরিয়া ও জর্ডান সীমান্ত পাড়ি দেবেন তিনি। সবমিলিয়ে তিনি প্রায় ৬ হাজার ৫০০ কিলোমিটার পথ হাঁটবেন। যথাযথ সময়ে লক্ষ্য পূরণে প্রতিদিন তাকে গড়ে ১৭ দশমিক ৮ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হবে।


পায়ে হেঁটে সৌদি আরবের মক্কা নগরীতে পৌঁছানো প্রসঙ্গে আদম মোহাম্মদ বলেন, ‘একদিন আমি মাত্রই ঘুম থেকে উঠলাম এবং নিজেকে বললাম আমি পায়ে হেঁটে হজ করতে মক্কা যাচ্ছি। এরপর আমি যাত্রা শুরু করি। চলার পথে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেছি, হে আল্লাহ, আপনি আমাদের সবাইকে কৃপা করুন, মানুষ হিসেবে ক্ষমা করে দিন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে ক্ষমা করে দিন।’


হজ ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম। সামর্থ্য আছে এমন প্রত্যেক মুসলমানকে জীবনে অন্তত একবার হলেও হজ পালন করা আবশ্যক। প্রতি বছর অনুষ্ঠেয় ইসলাম ধর্মানুরাগীদের বার্ষিক এ আয়োজনে প্রায় ২০ লাখ মানুষ অংশগ্রহণ করে, যা কিনা পৃথিবীর অন্যতম বড় গণজমায়েত। যদিও এই বছর সৌদি আরব সরকার বিদেশিদের হজে অংশগ্রহণের ওপর নানারকম কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। করোনার উপদ্রব কমাতে ও কঠোরভাবে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সৌদি আরব সরকার মূলত এমন ব্যবস্থা নিয়েছে।

আরো পড়ুন

অভিবাসন গন্তব্য দেশের তালিকায় আরব বিশ্বে সেরা সৌদি আরব


দীর্ঘ সময় ধরে পায়ে হেঁটে পথ পাড়ি দিতে অবশ্য পেশায় তড়িৎ প্রকৌশলী এই ধর্মপ্রাণ মুসলমান দুইশো কেজি ওজনের একটি কার্ট গাড়ি তৈরী করেছেন। যেখানে তিনি ইসলামিক গজল চালানোর জন্য স্পিকার লাগিয়ে নিয়েছেন। মোহাম্মদ জানান, তিনি ভালোবাসা, শান্তি ও সমতার বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন সবার উদ্দেশ্যে। ‘আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি এবং আমার যাত্রা উম্মাহর যাত্রায় পরিণত হয়েছে। এখন আর এটি আমার একার পথচলা নয়, এটা এখন সব বর্ণের, ধর্মের, সব বিশ্বাসের ও জাতির পথচলা।’


আত্মনির্ভরশীল আদম মোহাম্মদ চলার পথে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। ‘অনেক জায়গা থেকে অসংখ্য মানুষ এসেছেন শুধু আমার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে। তারা আমার জন্য খাবার নিয়ে আসেন, অনেকে আবার অর্থ সহায়তা পর্যন্ত করেছেন। একইসঙ্গে এমন অনেকে আছেন, যারা সবকিছু ছেড়ে আমাকে সঙ্গ দিচ্ছেন এবং আমার গাড়িও ঠেলে দিচ্ছেন।’

অর্থনৈতিক সংকট ছাড়া যেন নিরাপদে তিনি যুক্তরাজ্য থেকে মক্কা পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন এজন্য ‘আ গো ফান্ড পেজ’ নামের একটি পেজ বানানো হয়েছে আগস্টের ১ তারিখ। এরই মধ্যে প্রায় ৪১ হাজার ২৪০ ডলার সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। যদিও তার সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ডলার।


রান্নাবান্না ও ঘুমানোর কাজে ব্যবহারের জন্য স্থানীয় ওয়েল্ডিং কোম্পানির সহায়তায় দুই মাস ধরে কফিনের মতো দেখতে একটি ট্রলি বানিয়েছেন মোহাম্মদ। এতে তিনি বিদ্যুৎও সংযুক্ত করেছেন। ট্রলিটিতে তিনি আরবী ও ইংরেজি ভাষায় লিখেছেন ‘প্রতিটি জীবনই গুরুত্বপূর্ণ’।


হজের উদ্দেশ্যে যাত্রার পথে তিনি মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন পৌঁছে দিচ্ছেন; তিনি বলেন, ‘আমার বার্তা সব মানুষের জন্য, মানবতার জন্য। দয়া করে ঘৃণা বন্ধ করুন, মানুষের দোষ ধরা বন্ধ করুন। আমরা মানুষ, আমরা সবাই ভাই ভাই, আমরা যুক্তরাজ্যের মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। আমরা ৩০ থেকে ৪০ মিলিয়ন মুসলমান, আমরা আমাদের ভূমি ছাড়তে বাধ্য হয়েছি। আমরা এখানে (যুক্তরাজ্যে) এসেছি এবং আমরা এখানে শরণার্থী হিসেবে আছি, আমরা শান্তি খুঁজতে এসেছি। ইউরোপের মানুষ আমাদের তা দিয়েছে। এজন্য আমাদের উচিৎ তাদের শ্রদ্ধা করা।’


মাত্র ২৫ দিনের মধ্যে আদম মোহম্মাদ তার টিকটক অ্যাকাউন্টে প্রায় পাঁচ লাখ অনুসারী পেয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি তার প্রতিদিনের পথচলার কথা পোস্ট করেন। তিনি যখন হাঁটতে থাকেন তখন উৎসুক মানুষ গাড়ি নিয়ে তাকে দেখার চেষ্টা করে। এসময় আগন্তুকরা তাদের সন্তানদেরও সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। আর তাকে উদ্দেশ করে বলতে থাকেন সন্তানদের তারা প্রতিদিনই তার উপদেশ বানী শোনান।

‘‘আপনি কল্পনা করতে পারবেন না, কতোটা ভালো লাগে আমার। ছোট ছোট বাচ্চারা যখন আমার কাছে ছুঁটে আসে এবং ‘আদম চাচা আমার নায়ক’ বলে আমাকে চুমু দেয়, আসলে আমি তখন গর্ববোধ করি।’’
আদম মোহাম্মদ নারীদের উৎসাহিত করতে একদিন হিজাবও পরেছেন। এ নিয়ে তার মতামত, ‘মুসলিম নারীদের গর্বের সঙ্গে হিজাব পরিধান করা উচিৎ।’

আরো পড়ুন

মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব তৈরিতে হিজাব কতোটা দায়ী


আদম মোহাম্মদ আরবি, ফারসিসহ চারটি ভাষায় কথা বলতে পারেন। হজ শেষ করে ফিরে আসার পর ফ্রান্স, পোল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অন্য দেশগুলোতে হালাল মাংস নিষিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে তিনি যেন সোচ্চার হন, সে আহ্বানও তাকে অনেকে জানিয়ে রেখেছেন।

উল্লেখ্য, ১৯৯০ সালের শেষের দিকে আদম ইরাক থেকে যুক্তরাজ্যে আসেন। ইরাকে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি যুদ্ধবন্দি হিসেবে জেলও খেঁটেছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here