ড্ডা ভ্রমণ শেষ করে ট্রোলটুংগা পাহাড়ে পৌঁছানোর চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে। খুব ভোরে জিহ্বা বাবাজিকে দর্শনের উদ্দেশ্যে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

পাহাড় পর্ব

ট্রোলটুংগাতে হাইক শুরু করা যায় মুলত দুইটা পয়েন্ট থেকে। শ্যাগেদাল এবং মগেলিটপ । শ্যাগেদাল থেকে মগেলিটপ এর দূরত্ব যদিও মাত্র ৪ কিলোমিটার, কিন্তু যাত্রাপথের সব থেকে কঠিন রাস্তা এটাকেই বলে থাকে অনেকে।

এঁকেবেঁকে খাঁড়া উঠে যাওয়া এই পাঁকা রাস্তাটি এক ধাক্কায় পুরো ৮০০ মিটার উচ্চতায় নিয়ে যায় যাত্রীদের। আমরা ভোর ছয়টার শাটল বাস ধরে পোঁছালাম শ্যাগেদাল। সেখান থেকে মগেলিটপ পর্যন্ত আরেকটা শাটল বাস যায়। আমরা ভেবছিলাম হাইকের কষ্ট কমাতে সেটার টিকেট কাটবো। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেল শাটল বাসটা শুধু শুক্র শনিবারেই ছাড়ে। আমরা ঠিকঠাকমতো তথ্য না নিয়েই চলে এসেছি মঙ্গবারে। সুতরাং হাঁটা ছাড়া গতি নেই।

এই পথ দিয়ে পৌঁছুতে হবে পাহাড়ে

খাঁড়া রাস্তার প্রতি বাঁকে বাঁকে থেমে দম নিয়ে তারপর উঠছিলাম আমরা। দলের মধ্যে আমার অবস্থাই সব থেকে খারাপ মনে হল। রাস্তা দিয়ে উঠতে যখন নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছিল তখন পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া প্রাইভেট কারগুলোকে হিংসা হচ্ছিলো খুব। বহুকষ্টে মগেলিটপ পৌঁছালাম আমরা, এইটুকু রাস্তা উঠতেই সময় এবং শক্তি ক্ষয় হয়েছে বিস্তর। সামনে আরো ১০ কিলো রাস্তা পেরিয়ে টুংগার দেখা মিলবে, তারপর আবার ফিরে আসতে হবে একই রাস্তায়।

আরো পড়ুন
ট্রোলটুংগা সফর ১ম পর্ব

এদিকে শ্যাগেদাল থেকে শেষ ফিরতি শাটল বাস সন্ধ্যা ৭ টায়। তাই সময় নিয়ে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লাম আমরা। ঠিক হলো এরপরে খুব প্রয়োজন ছাড়া আর থামবো না, আর থামলেও খুব বেশি কালক্ষেপণ করা যাবেনা কোথাও। মগেলিটপের পর থেকেই আসল পাহাড়ি রাস্তা শুরু। প্রথম দিকের পথ বেশ সমতল। চারদিকের দৃশ্যও মনোরম। এতক্ষণের পীড়াদায়ক রাস্তা পেরিয়ে আসার পর এই রাস্তা দেখে মনে হচ্ছিলো হেসে খেলে দশ কিলোমিটার পেরিয়ে যাবে।

কিন্তু দেড়/দুই কিলোমিটার পেরোনোর পরেই পাওয়া গেলো পাথুরে সিঁড়ির দেখা। উঁচু উঁচু পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতেও বেশ বেগ পেতে হলো। পথে কিছু ভিনদেশী পথিকের দেখা মিললো। তাদের চলার গতি আমাদের তুলনায় সাবলীল। আমাদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলো তারা। চোখে একরাশ হিংসা নিয়ে তাদের চলে যাওয়া দেখলাম।

পিচ্ছিল বরফ আর পাথুরে সিঁড়ি পেরিয়ে খাঁড়াভাবে উঠা বেশ বিপদজনক। কিন্তু হাইকিং এর আসল রোমাঞ্চ তো এখানেই

এদিকে যতই এগোচ্ছি রাস্তার সৌন্দর্য মনে হচ্ছে বাড়ছে। পথশ্রম ভুলিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতি। কিন্তু তা ক্ষণিকের জন্যেই। তারপরেই একরাশ ক্লান্তি এসে চলার গতি ধীর করে দিচ্ছিলো বার বার। পথে বার বার থেমে, হাল্কা কিছু মুখে দিয়ে, বোতল বা পাহাড়ি ঝর্ণার পানি খেয়ে শক্তি সঞ্চয় করতে হচ্ছিলো। মোটামুটি অর্ধেক রাস্তা পার হবার পরে তাপমাত্রা কমে যাওয়াটা টের পাওয়া যাচ্ছিলো। দেখলাম এই গ্রীষ্মেও যায়গায় যায়গায় বরফ জমে আছে।

 বরফ গুলো পুরোপুরি জমাট বাঁধা নয়, হাল্কা গলে গলে রয়েছে। ফলে কিছু যায়গা সামান্য বিপদজনক। অসাবধানতার কারণে দুইবার হাঁটু পর্যন্ত ডেবে গেলো আমার। প্রায় শেষের দিকে গিয়ে একটা জায়গা পেরোতে বেশ ভয় পেয়েছিলাম সবাই। পাহাড়ের সরু একটা রাস্তা পেরিয়ে উপরে উঠার রাস্তা। সরু রাস্তাটা কাঁদা আর বরফের মিশেলে কিচ্ছুটা পিচ্ছিল। আর রাস্তার ডান দিকেই খাঁড়া নেমে গেছে খাঁদ।

সবাই মিলে ধরাধরি করে কোনমতে পেরিয়ে এলাম যায়গাটা। এমনিভাবে অনন্তকাল পথ চলে অবশেষে টুংগা বাবাজির কাছে যখন পৌঁছালাম তখন বেলা একটা পেরিয়ে গেছে। সাধারণত ট্রোলটুংগার অগ্রভাগে ছবি তোলার জন্য মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। কিন্তু আমরা যেসময় পেঁছালাম তখন ভাগ্যক্রমে জায়গাটা ফাঁকা ছিলো। আমি আর আমার সঙ্গের মেয়ে বন্ধুটি একটু জিরাতে বসলাম, আর দলের ছেলে বন্ধু দুজন চলে গেলো কাঙ্ক্ষিত জায়গাটিকে কাছ থেকে দেখতে আর ছবি তুলতে।

অবশেষে ট্রোলটুংগা দর্শন। লেখক ও তার বন্ধু

আমি নিজেও টুঙ্গার আগা থেকে নিচটা দেখার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। ওরা ফেরত আসার আগেই আমিও নেমে গেলাম। টুঙ্গার সামনের অংশটি পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসা একটা চ্যাপ্টা পাথর মাত্র। নিচে কিছু নেই। সুতরাং উপর থেকে নিচে তাকিয়ে দেখতে কিছুটা ভয়ই লাগে। দেখলাম পাথরের একদম আগার দিকে লোহার শিক ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে বাড়তি সাপোর্টের জন্য।

অনেকে অবশ্য এখানে বসে পা ঝুলিয়ে ছবি তোলে। আমারো শখ ছিলো তোলার। কিন্তু বন্ধুদের নিষেধ শুনে আর বাড়তি ঝুঁকি নিলাম না। ছবি তোলা শেষে, হাল্কা খাওয়া দাওয়া করে সামান্য জিরিয়ে নিয়ে ফেরার পথ ধরলাম সবাই।

ফিরতি পথে শরীর আর চলছিলো না। অতি কষ্টে ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলাম যেন । চলার গতি ধীর হয়ে গিয়েছিল প্রচুর। আর পা মহাশয়ও হঠাৎ করে এত পরিশ্রম সহ্য করতে পারছিলো না। ব্যাথায় টন টন করছিলো পায়ের অগ্রভাগ।

বিশেষ করে পাথুরে সিঁড়ির জায়গাটায় যখন ফিরলাম, প্রতি পদক্ষেপে পায়ের ব্যাথা জানান দিয়ে যাচ্ছিলো। মগেলিটপ যখন পৌঁছালাম তখন সারে পাঁচটা বাজে প্রায়। অথচ শরীরের যেই অবস্থা, বিশেষ করে আমরা যে দুজন মেয়ে ছিলাম তাদের, তাতে এই সময়ের মধ্যে এত খাঁড়া রাস্তা নেমে ফিরতি বাস ধরতে পারবো বলে মনে হচ্ছিলো না।

রোমাঞ্চকর অভিযানের পরিসমাপ্তি। ট্রোলটুংগা থেকে ফিরতি পথের যাত্রা।

এইসব নিয়ে যখন আমরা চিন্তা করছি তখন সৌভাগ্যক্রমে এক নরওয়েজিয়ান ভদ্রলোক আমাদেরকে তার গাড়িতে করে শ্যাগেদাল পর্যন্ত এগিয়ে দিতে সম্মত হলেন। কিন্তু তার গাড়িতে আর দুইজন মানুষ বসার মতই যায়গা আছে। যেহেতু আমরা মেয়েদুটোর অবস্থা বেশি খারাপ, তাই আমরা দুজন সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে যাব বলে ঠিক হল। যদিও সঙ্গের দুইজনকে রেখে আসতে কিছুটা খারাপই লাগছিলো, কিন্তু সেসময় বাস ধরতে পারাটাই মূখ্য মনে হয়েছিলো আমাদের কাছে। আমরা গাড়িতে করে আধঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম নিচে। বাকি দুইজনের দেখা মিললো আরো আধাঘন্টা পরে। দুইজন কোনমতে নিচে নেমেই বসে পড়লো ধপ করে।

ওরা বলছিল, পুরো রাস্তার সবথেকে কষ্টকর অংশ ছিল ওইটুকু। পাঁকা ঢালু রাস্তায় পা ফেলায় যাচ্ছিলো না ব্যাথায়। আর পায়ের ওপর নাকি কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না নামার সময়। ওরা বলছিলো আমরাসহ নামলে নাকি কখনোই সময় মতো নামতে পারা যেত না।

যাইহোক অবশেষে শাটল বাস ধরে ওড্ডা ফিরলাম আমরা। সময় তখন প্রায় আটটা। নরওয়ের গ্রীষ্মের হিসেবে সেটা বিকেল। আগেরদিন ফেরার পরে শহর ঘুরে দেখার যে পরিকল্পনা করেছিলাম সেটা ভাবতে হাসি পেল আজ।

তবু এত সুন্দর একটা জায়গায়, এত মনোরম একটা বিকেলে ঠিক তখনি বাড়ি ফিরতে মন চাইলো না। তাই ফিয়োর্ডের পাশে বসে থাকলাম আমরা বেশ কিছুক্ষণ। দিন শেষে রাতের জন্য কিছু খাবার কিনে বাড়ি ফিরলাম আমরা। ক্লান্ত পা দুটো বাড়ির দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় মনে হলো, ট্রোলটুংগা সফর তাহলে ভালোই হলো।

লেখক: নরওয়ের নোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here