দেশীয় শিল্পের উন্নয়নে প্রবাসীদের বিনিয়োগের সুযোগ ও সম্ভাবনা

0
768
দেশীয় শিল্পে প্রবাসীদের বিনিয়োগ
দেশীয় শিল্পে প্রবাসীদের বিনিয়োগ

জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্বব্যাপী অভিবাসীর সংখ্যা ২৭২ মিলিয়নেরও অধিক, যার একটি বিরাট অংশ শ্রমিক হিসেবে বিভিন্ন দেশে বর্তমানে কর্মরত রয়েছে। অভিবাসী শ্রমিক প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বর্তমানে সারা বিশ্বে ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে (সূত্র: আইএলও, ২০১৯)। বিএমইটির ডাটাবেজ অনুসারে, বর্তমানে এক কোটির অধিক বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত রয়েছে, যাদের বেশির ভাগই চুক্তিভিত্তিক শ্রম অভিবাসন করেছেন।

বিগত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সকল অভিবাসীরা ২১.৭৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছে। তাই এইটা সহজেই অনুমেয় যে, দেশে অবস্থানরত এক বিরাট জনগোষ্ঠী (মতান্তরে ৩-৪ কোটির অধিক) অভিবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের উপরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল-তাদের জীবিকা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং টেকসই অর্থনৈতিক সুরক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে রেমিট্যান্স।

বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের শ্রমিকদের শ্রমমূল্য তুলনামূলকভাবে সস্তা হওয়াতে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন অভিবাসী শ্রমিক গ্রহণকারী দেশে এর চাহিদা ব্যাপক। অন্যদিকে, বাংলাদেশ থেকে অন্য দেশে শ্রমিক অভিবাসন ব্যয় উচ্চ, যার কারণে আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের অভিবাসনের জন্য বিনিয়োগের অর্থ তুলে আনতে অনেক বেগ পেতে হয়।

তার উপরে, আমাদের দেশের প্রবাসী শ্রমিক ও তাদের পরিবারের রেমিট্যান্সের সঠিক ও সুচিন্তিত বিনিয়োগের উপরেও পর্যাপ্ত জ্ঞানের স্বল্পতা রয়েছে। এক কথায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় তাদের দক্ষতার ঘাটতির দরুন রেমিট্যান্সের সঠিক ব্যবহারও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়না। প্রবাসীদের কষ্টার্জিত বেশিরভাগ অর্থই ব্যয় হয় অভিবাসনে বিনিয়োগকৃত অর্থ উত্তোলনে এবং পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে।

প্রবাসীর পরিবারের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে করণীয়

প্রবাসী পরিবারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নির্ভর করে মূলত তিনটি বিষয়ের উপরে: অভিবাসনে বিনিয়োগের অর্থ উত্তোলন, পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণ, এবং অর্থনৈতিক সুরক্ষার জন্য বিনিয়োগ। অর্থনৈতিক সুরক্ষার বিষয়টি আবার নির্ভর করে কয়েকটি বিষয়ের উপরে, যেমন: সুচিন্তিত ব্যয় (বা অযৌক্তিক ব্যয় হ্রাস), সঞ্চয় এবং বিনিয়োগ (যেমন: ঘর-বাড়ি নির্মাণ, জমি বা স্থাবর সম্পত্তি বৃদ্ধি, কৃষি ও উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ, বা শিল্প-কলকারখানার বিনিয়োগ ইত্যাদি)। তাই আর্থিক শিক্ষা বা প্রবাসীর পরিবার পর্যায়ে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা উল্লেখিত সকল বিষয়ের উপরে নির্ভর করে, যার সঠিক ও সময়পোযোগী প্রয়োগ তাদের পরিবারের সফলতা আনয়নে এক তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

বিএমইটির পরিসংখ্যান অনুসারে আমাদের দেশ থেকে বেশি সংখ্যক স্বল্পদক্ষ বা আধাদক্ষ কর্মীরা অভিবাসন করে থাকে, যাদের অনেকেই খুব একটা শিক্ষিত নয়। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই সকল প্রবাসীর পরিবারও খুব বেশি শিক্ষিত নয়। যার ফলে দেখা যায়, তাদের পরিবার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় অদক্ষ হয়ে থাকেন।

শ্রম অভিবাসন যেহেতু চুক্তিভিত্তিক (অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের শ্রমিকরা ১-৩ বছরের চুক্তিতে বিদেশে কর্মসংস্থান করে থাকে) সেহেতু প্রবাসী শ্রমিকদের সবসময় প্রাধান্য দিয়ে থাকেন অভিবাসন ব্যায় উত্তোলন ও পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রবাসীরা চুক্তি শেষ হওয়ার পরে দেশে ফেরত আসতে বাধ্য হন, যার ফলে তারা খুব একটা সঞ্চয় করতে পারেন না। ফলে, দেশে এসে বেকার থাকেন বা আবার বিদেশ যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন।

বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ তাদের পরিবার সঞ্চয় বা আয় বৃদ্ধিমূলক কর্মে  বিনিয়োগের চেয়ে ভোগ-বিলাসিতায় ব্যয় করেন। অন্যদিকে কিছু ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করলেও তা সুচিন্তিত হয় না। ফলে এই বিনিয়োগ থেকে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়। অনেকে ভাবেন-

ঘর -বাড়ি নির্মাণ ও জমি ক্রয়ও এক ধরণের বিনিয়োগ। কিন্তু মনে রাখতে হবে, উৎপাদনশীল ও আয়-বৃদ্ধিমূলক কর্মকান্ডে বিনিয়োগ পরিবারের অথনৈতিক সুরক্ষা সবচেয়ে বেশি দিতে পারে এবং করতে পারে হাজারো বেকারদের কর্মসংস্থান।

এর জন্য প্রয়োজন সঠিক অর্থনৈতিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, এবং সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন পরিষেবা ও সুযোগ সুবিধা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা। 

কোথায় বিনিয়োগ করবেন?

যেহেতু আমাদের দেশে বেশিরভাগ প্রবাসীর পরিবার বা রেমিট্যান্স গ্রহীতা গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন, সেহেতু তাদের জন্য আদর্শ সিদ্ধান্ত হতে পারে কৃষি খাতে বিনিয়োগ করা। সেইসঙ্গে তাদের যদি পর্যাপ্ত কৃষিজমি বা জলাশয় থাকে, তাহলে মৎস্য চাষ, গবাদিপশু পালন, পোল্ট্রি ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করতে পারেন। এছাড়া প্রবাসী কর্মীরা বিদেশে তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে অন্যান্য খাতে যেমন: চামড়া শিল্পে, হস্ত শিল্পে, গার্মেন্টস, ফুড ক্যাটারিং-এ, রেস্টুরেন্টে, কনস্ট্রাকশন-এ, মেডিকেল/ফার্মেসী খাতে বা এক্সপোর্ট-ইম্পোর্টে বিনিয়োগ করতে পারেন। তবে মনে রাখতে হবে, তারা যেই ক্ষেত্রেই বিনিয়োগ করুক না কেন, তা হতে হবে যুগোপযোগী, বাজারে চাহিদাসম্পন্ন ও উদ্ভাবনী। এক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরা ও বিদেশফেরত প্রবাসী কর্মীরা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন।

কোথা থেকে সেবা বা সহায়তা পাবেন?

কারিগরী বা দক্ষতা উন্নয়নের জন্য সরকারিভাবে ৬৫টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) রয়েছে দেশব্যপী। এছাড়া রয়েছে ৬টি মেরিন একাডেমী, যেখান হতে বিনা খরচে ও স্বল্প ব্যয় এ প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। অন্য দিকে, সেইপ (এসইআইপি) এর অধীনে রয়েছে ১৬টি প্রতিষ্ঠান, যার মাঝে পিকেএসএফ এর অধীনে দেশব্যপী বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে ১৩টি ট্রেডে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ রয়েছে।

জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারের যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, মহিলা ও শিশুবিষয়ক কার্যালয় ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মৎস্য ও পশু অধিদপ্তরের অধীন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও এসএমই (এসএমই ফাউন্ডেশন) কর্তৃক পরিচালিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকেও প্রশিক্ষণ নেয়া যায়। বেসরকারি পর্যায়ে রয়েছে অনুমোদিত হাজারো প্রতিষ্ঠান- যেখান থেকে সহজে বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ নেয়ার সুযোগ আছে।

আর্থিক সুবিধা বা ঋণের জন্য রয়েছে প্রবাসীদের জন্য বিশেষায়িত ব্যাংক- প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, যেখান থেকে খুবই স্বল্প সুদে (৪%-১১% হারে) প্রবাসী ও তাদের পরিবার বিভিন্ন ব্যবসা উদ্যোগের জন্য ঋণ নিতে পারেন। ঋণ নেয়া ছাড়া, সঞ্চয় ও প্রবাসী বন্ড ক্রয় করেও প্রবাসীর পরিবার রেমিট্যান্সের সঠিক ও ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ করতে পারেন। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ছাড়াও – অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক ও বর্তমানে প্রবাসীদের জন্য বিভিন্ন ঋণ ও সঞ্চয় সেবা প্রদান করছে।

যদিও প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সেবার পাশাপাশি এই সকল প্রবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজন রয়েছে কাউন্সেলিং বা সঠিক পরামর্শের- যার মাধ্যমে তারা তাদের সক্ষমতার বিশ্লেষণের দ্বারা বিনিয়োগের সঠিক দিক নির্দেশনা পাবেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এই ধরণের সেবা প্রাপ্তির সুযোগ তাদের কমই রয়েছে। গুটি কয়েক বেসরকারি সংস্থা ছাড়া (যেমন: ঢাকা ও কুমিল্লাস্থ এম আর সি, ওয়ারবি, বমসা, রামরু, ওকাপ, প্রত্যাশী, সিসিডিএ, বিলস, বাস্তব, ও ব্র্যাক) এই ধরণের কাউন্সেলিং সেবা সরকারিভাবে দেয়া হয় না বললেই চলে।

প্রবাসীদের রেমিট্যান্সে একদিকে যেমন দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হচ্ছে, অন্যদিকে প্রবাসীদের পারিবারিক উন্নয়ন ও সাধিত হচ্ছে। কিন্তু দেশের সার্বিক উন্নয়নে ও মধ্যম আয়ের দেশের সকল শর্ত পূরণে প্রবাসীদের রেমিটেন্সকে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে শিল্প ও কৃষি খাতে বিনিয়োগে তাদের উৎসাহী ও সক্ষম করে তুলতে ও আর্থিক স্বাক্ষরতা আনয়নে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই।

পাশাপাশি তাদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ডকে তৃণমূল পর্যায়ে আরও বেশি উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। সরকারি অন্যান্য সেবা, যেমন: ট্রেড লাইসেন্স প্রদান, ট্যাক্স ও ভ্যাট সার্টিফিকেট প্রদান, পরিবেশ ছাড়পত্র প্রদান, এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট লাইসেন্স প্রদান, ব্যাংক একাউন্ট ও ট্রানজেকশনাল সেবা ইত্যাদির ক্ষেত্রে প্রবাসীদের অগ্রাধিকার ও বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা করতে হবে। যেন প্রবাসী ও তাদের পরিবার দেশে ভোগান্তি ছাড়া উৎপাদনশীল খাতে রেমিট্যান্সের বিনিয়োগে অধিক আগ্রহী হয়।

লেখক : শ্রম অভিবাসন বিশ্লেষক ও উন্নয়ন কর্মী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here