‘এটা খুবই ভালো ভিসা, একেবারে লাখের বাড়ি মারবে’

0
1521

পিতা-পুত্রের ব্যর্থ প্রবাস জীবন ও উপলব্ধি

‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।’ সেই অপার বিশ্বাসে ভাগ্যের চাঁকা ঘোরাতে দেশ পেরিয়ে কাঁটাতারের ওপারের অজানা রঙ্গীন দুনিয়ায়, স্বপ্নের বেলুন উড়িয়ে প্রতিনিয়তই ছুটে চলেছেন অজস্র মানুষ। কেউ কেউ হয়তো নিমিষেই পৌঁছে যান সেই কাঙ্খিত গন্তব্যের দুয়ারে। জীবনকে রাঙ্গিয়ে তুলে এগিয়ে চলেন সাফল্যের চূঁড়ায়। কিন্তু সবার পরিণতি কি এক বিন্দুতে মিলিত হয়!

স্বপ্নভঙ্গের জালে জড়িয়ে প্রতনিয়ত অসংখ্য মানুষের ভাগ্য থমকে যায়। জীবনে নেমে আসে ঘোরতর অমানিশা। প্রতারণার ফাঁদে পড়ে অজ্ঞতা কিংবা সরল বিশ্বাসের খেসারত দিতে হয় পদে পদে, কখনওবা জীবন দিয়ে। তারপরও কাঙ্খিত সেই সোনার হরিণের আশায়, বিশ্বাস আর স্বপ্নের বুনন থেমে থাকে না।

ঠিক এরকমই একজন বাবা রেজাউল করিম (৫৩) ও ছেলে আব্দুর রহমান (৩৩) বারংবার ফিরে আসা ব্যর্থতার বিপরীতে অপার বিশ্বাসের জাল বুনেছেন। পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা ও সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে ২০০৭ সালে বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন খুলনার দাকোপ উপজেলার সরদার রেজাউল করিম। ধর্মপ্রাণ রেজাউল, হজরত মুহাম্মদ (স.) এর মাতৃভূমি মক্কা, মদিনা দর্শন ও হজ পালনের অভিলাষে গন্তব্য হিসেবে সৌদি আরবকে বেছে নেন।

পাসপোর্ট, ভিসাসহ বিদেশ যাবার নানান প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে খুলনার দাকোপ উপজেলার মৌখালি গ্রামের এই বাসিন্দা একদিন সত্যিই পৌঁছে যান সৌদি আরবের ঝাঁ চকচকে জৌলুসময় শহর জেদ্দায়। কিন্তু সেখানে পৌাঁছানোর পর তার জীবন আর জৌলুসময় থাকেনি। শুরুতেই ধাক্কা খান কর্মস্থলে যোগ দিতে গিয়ে।

‘বিদেশ নিয়ে মানুষ যে গল্প শোনে, সেই গল্পের বিদেশ আর বাস্তবতা ভিন্ন জিনিস।

হাসপাতালের কর্মী হিসেবে যোগদানের আশ্বাস দিয়ে, রাস্তার পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ দেওয়া হয় তাকে। সৌদিতে যাওয়া বাবদ রেজাউল করিমের খরচ হয় তিন লাখ ৭০ হাজার টাকা। প্রতি মাসে পারিশ্রমিক হিসেবে ৮০০ রিয়াল দেওয়ার চুক্তি থাকলেও তিনি মাত্র ৩০০ রিয়াল করে পেয়েছিলেন। এরপর তিনি জানতে পারেন, তাকে কোনো আকামা দেওয়া (সৌদি আরবে বসবাস ও কাজের অনুমতিপত্র) হয়নি। যে দালালের মাধ্যমে তিনি এসেছেন, তার সঙ্গেও যোগাযোগ করে কোনো লাভ হয়নি।

দুঃশ্চিন্তা চেপে ধরে রেজাউলকে; সেখান থেকে চলে গেলেন অন্য এক শহরে। খুঁজতে থাকলেন বিকল্প উপায়। একদিকে আকামা না থাকায় ভাল কোনো কাজেও তিনি যোগ দিতে পারছিলেন না। অন্যদিকে গ্রেফতার হওয়ার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াতেন। শেষ পর্যন্ত একটি ফটোকপির দোকানে কাজ পান তিনি। খেয়ে না খেয়ে সেখান থেকে একটু একটু করে কিছু টাকা সঞ্চয় করতে থাকেন।

অর্থকষ্ট ও পুলিশের ভয়, এই দুইয়ে চলছিল তার প্রবাস জীবন। অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এরকম একটা পরিস্থিতির মধ্যে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার তার মাওলানাপড়ুয়া ছেলেকে সৌদিতে তার কাছে নিয়ে আসবেন।

সৌদিতে নিজেই প্রতারিত হয়েছেন, তারপরও ছেলেকে কেন একই পথে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে রেজাউল করিম বলেন-‘ আমি তখন পরিচিত একজনের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়েছিলাম, আমার ছেলেকে যে ভিসা দেয়া হবে, তা খুবই ভাল ভিসা, একেবারে লাখের বাড়ি মারবে।’ অর্থাৎ রেজাউল করিমের ছেলে প্রতি মাসে লাখ টাকা উপার্জন করতে পারবে, এমনি আশ্বাসে তাকে সৌদি আনার প্রক্রিয়া শুরু হল।

ঘটনাটি ২০১০ সালের, তখন বাংলাদেশ থেকে সৌদিতে ভিসা পাওয়ার জটিলতা থাকায় রেজাউল করিমের ছেলে আব্দুর রহমানকে দালাল চক্রের মাধ্যমে ভারতে পাঠানো হয়। নিজের সঞ্চিত টাকা আর গ্রামের জমি বন্ধক রেখে সেখানে প্রায় চার লাখ টাকা দালালের হাতে তুলে দেন রেজাউল। সময় যায়, কিন্তু আব্দুর রহমানের সৌদি আরবে যাওয়ার কোনো সুরাহা হয় না। অবশেষে ভারত থেকেই আব্দুর রহমান বাংলাদেশে ফেরত আসেন। দালালের কাছে দেওয়া সব টাকাও গচ্চা যায়।

এদিকে সৌদি আরবে পিতা রেজাউলের পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকায় তিনি স্বেচ্ছায় পুলিশের কাছে ধরা দেন। এরপর ২০১৩ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন।

শূণ্য হাতে দেশে ফিরে সংসার ও সন্তানদের নিয়ে আর্থিক সংকটে পড়েন রেজাউল। ভাবলেন তার ব্যর্থ প্রবাস জীবনের কাছে তিনি হার মানবেন না। যে করেই হোক তিনি আবারো ছেলেকে বিদেশ পাঠাবেন। একপর্যায়ে তিনি তার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে ওমানে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন। আব্দুর রহমান মাদ্রাসা পড়ুয়া হওয়ায় তাকে ওমানে মসজিদের ইমামের চাকরির প্রলোভন দেখানো হল, সেই সঙ্গে মোটা অংকের টাকা পাওয়ার আশ্বাস তো ছিলই।

২০১৬ সালে, বাড়ির অবশিষ্ট জমি বন্ধক রেখে, আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে ধার দেনা করে এবং এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে আবারো সাড়ে চার লক্ষ টাকা খরচ করে আব্দুর রহমানকে ওমানে পাঠান বাবা রেজাউল করিম। কিন্তু এবারও বিধি বাম। পিতার প্রতারিত জীবনের ছায়া যেন তাকেও গ্রাস করে ফেলতে থাকে। লাখ টাকার চাকরির দেখা তিনি আর পাননি। মূলত দালাল তাকে ট্যুরিস্ট ভিসায় ওমানে পাঠিয়েছিল।

আব্দুর রহমান বললেন, ‘বিদেশ নিয়ে মানুষ যে গল্প শোনে, সেই গল্পের বিদেশ আর বাস্তবতা ভিন্ন জিনিস। যারা বিদেশ যায়নি তারা ছাড়া এ কষ্ট আর কেউ বুঝবে না। যখন বিদেশ গিয়ে আপনি কাজ পাবেন না, না খেয়ে থাকবেন ঘুমানোর জায়গা পাবেন না, তখনকার সেই অসহায় পরিস্থিতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।’

এভাবে কেটে যায় তিন থেকে চার মাস। আব্দুর রহমান একদিন জানতে পারেন, ওমানে মসজিদের ইমামের চাকরি দেয়া হয় সরকারিভাবে শুধু স্থানীয়দেরকে। তারপর ওমানে কাজের কোনো ব্যবস্থা করতে না পেরে পুলিশের সহায়তায় পিতার মতোই শুণ্য হাতে দেশে ফিরে আসেন আব্দুর রহমান।

কিন্তু দেশে ফেরার পর তার জন্য অপেক্ষা করছে ৪ লক্ষ টাকার ঋণের বোঝা। আবারো দিশেহারা হয়ে পড়েন রহমান। কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে, তাই আবারো ওমান যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ওমানে পরিচয় হওয়া আরেক ব্যক্তির কাছ থেকে আশ্বাস পান, কোনো একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিবেন তিনি। সেক্ষেত্রে ওয়ার্ক ভিসা ইস্যু করে তাকে আনা হবে, কিন্তু ভিসায় উল্লেখিত কাজের পরিবর্তে অন্য কাজ করতে হবে তাকে।

সেই শর্তে রাজি হয়ে ওমান চলে যান রহমান। এবার গাড়ি ধোওয়া-মোছার কাজ পান তিনি। এ কাজেও শর্ত জুড়ে দেয়া হয় তাকে। মাসিক চুক্তিতে গাড়ি প্রতি ৫-১০ রিয়াল করে দেওয়া হবে থাকে। আবার তাকে কাজ করতে হবে পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে, রাতের বেলা। ‘আমাদের মধ্যে অনেকে ধরাও পড়তো পুলিশের কাছে। তারপর অনেক বুঝিয়ে কাউকে হয়তো ছাড়িয়ে আনা সম্ভব হতো, আবার কাউকে শাস্তি পেতে হতো- বলছিলেন রহমান।’

এভাবে পালিয়ে কাজ করতে গিয়ে রহমান হতাশ হয়ে পড়েন, তাকে আতঙ্কিত থাকতে হত সবসময়। একপর্যায়ে একটা পাঞ্জেগানা মসজিদে নামাজ পড়ানোর সুযোগ পেয়ে যান তিনি। সেখানে চাকরি পাওয়ার পর ধীরে ধীরে ঋণের বোঝা কমতে থাকে আব্দুর রহমানের। কিন্তু তার ভালো থাকার দিন খুব দ্রুতই ফুরিয়ে আসে, করোনার কারণে বন্ধ হয়ে যায় সব মসজিদ। শেষ পর্যন্ত কাজ হারিয়ে বাধ্য হয়ে দেশে ফেরেন তিনি।

বিদেশে যেতে গিয়ে যে পরিশ্রম ও টাকা খরচ করতে হয়, তার আংশিক টাকা যদি দেশে বিনিয়োগ করা হয় এবং যথাসাধ্য পরিশ্রম করা যায় তাহলে আশানুরূপ কিছু করা সম্ভব।’

দেশে ফেরার পর তার ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে যায়। এদিকে করোনার কারণে নির্দিষ্ট সময়ে ওমানে ফিরতে না পারায় সেখানকার চাকরিটিও হারাতে হয় তাকে। বারবার ফিরে আসা ব্যর্থতায় হতাশা গ্রাস করে আব্দুর রহমানকে। সেই সঙ্গে পরিবারে আর্থিক অনটনতো রয়েছেই।

নিজ এলাকায় তার অবশিষ্ট জমিতে অল্প পরিসরে চাষাবাদের কাজ শুরু করেন রহমান। বিদেশে কাজ করতে গিয়ে তার পরিবারকে দীর্ঘ বিড়ম্বনাময় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তার উপলব্ধি হলো- বিদেশের চাইতে আমাদের দেশেই অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘বিদেশে যেতে গিয়ে যে পরিশ্রম ও টাকা খরচ করতে হয়, তার আংশিক টাকা যদি দেশে বিনিয়োগ করা হয় এবং যথাসাধ্য পরিশ্রম করা যায় তাহলে আশানুরূপ কিছু করা সম্ভব।’

‘আমি যেহেতু কৃষক পরিবারের সন্তান, তাই কৃষিকাজকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে চাই। মাছ চাষের প্রতি আমার আগ্রহ আছে। আমার বিশ্বাস, এখানে বিনিয়োগ করতে পারলে একটা সময় ভালো ফল পাব। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নতুন উদ্যোক্তাদের যে সমস্যায় পড়তে হয় তাহলো- এই কাজে পর্যাপ্ত অর্থ সহায়তা পাওয়া যায় না। আমার আত্মীয়-স্বজন বিদেশ যাওয়ার জন্য আমাকে সহায়তা করলেও নিজের মতো করে কোনো ব্যবসা শুরু করতে চাইলে কেউ এগিয়ে আসছে না।’

রহমান মনে করেন, এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের সমাজের মানসিকতায় বড় ধরনের গলদ আছে। এছাড়াও তিনি বলেন- ‘ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে হলে যেসব শর্ত ও প্রক্রিয়া পার করতে হয়, তা পূরণ করা অনেকের পক্ষে সম্ভব না। তবে আমি এবার প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে ঋণের জন্য আবেদন করবো। যদি ওখান থেকে ঋণসুবিধা পাই, তাহলে আমি আমার জমিতেই মাছ চাষ করতে পারবো। আমার বিশ্বাস সর্বোচ্চ পরিশ্রম করে লেগে থাকতে পারলে দেশের মাটিতেই আমার ভাগ্য ফিরবে।’

বিদেশে প্রতারিত হয়ে এতটা কাঠখড় পুড়িয়ে দেশে ফিরে আসা সন্তানের এমন পরিকল্পনায় পিতা রেজাউল করিম সায় দেন। তিনিও আর সন্তানের কষ্ট দেখতে নারাজ। তার উপলব্ধী হয়, বিদেশে না গিয়ে যদি নিজেই কিছু করা সম্ভব হয়, তাহলে তার সন্তান তাই করুক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here