সিসিলির উপকূলে ঠাঁই নেওয়া উত্তর আফ্রিকা থেকে আগত অভিবাসন প্রত্যাশীদের কাছে ইতালি দীর্ঘদিন ধরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহে পৌঁছানোর একটি জনপ্রিয় সীমান্ত পথ।
ইতালির সরকার যখন এই অভিবাসনের স্রোত সামলাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে প্রয়োজনীয় সাহায্যের আশা করছিল, ঠিক তখন বেলারুশ ও পোল্যান্ডের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ বিস্ফোরিত হল। আর তাই, ইউরোপের মনোযোগ এখন ভূমধ্যসাগর থেকে পূর্ব ও উত্তর দিকে।
সহজ ভাষায় বললে, ভুমধ্যসাগরে সংগঠিত অভিবাসীদের অবর্ণনীয় দুঃসংবাদ আড়ালে পড়ে গেছে এবং এর পরিবর্তে পোলিশ-বেলারুশিয়ান সীমান্তের চলমান মর্মান্তিক চিত্র মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। সিসিলিতে নৌকা থেকে অবতরণ করা লিবিয়ায় নির্যাতিত পুরুষ, নারী ও শিশু-যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিচ্ছে, তাদের গুরুত্ব আড়ালে পড়ে গেছেে ইইউ নীতি নির্ধারকদের কাছে।
এদিকে ইতালি সরকার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে কারণ দেশটি ইউরোপীয়দের আবার ভূমধ্যসাগর এবং আফ্রিকার দিকে ফিরে তাকানোর আহ্বান জানাচ্ছে, যখন বেশিরভাগ ইউরোপীয় রাজধানী এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠানগুলির এই মুহূর্তে সম্পূর্ণ মনোযোগ পূর্বমুখী।
এটি অবশ্যই বোধগম্য যে, ইউরোপীয় প্রান্তে পোল্যান্ড এবং বাল্টিক দেশসমূহের সঙ্গে বেলারুশ সংযুক্ত। এর বাইরেও, এটা স্পষ্ট যে ইউরোপীয় ইউনিয়নে পাড়ি দেওয়ার জন্য এই বিশাল জনগোষ্ঠী জার্মানিকে খুব উদ্বিগ্ন করে তুলছে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ছায়া রয়েছে গোটা ব্যাপারটার ওপর।
সংকটটি এখন সেই দশ হাজার অভিবাসীর ঠাণ্ডায় জমে থাকা ক্যাম্পের তথাকথিত গল্পের বাইরে চলে গেছে। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য একটি কৌশলগত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে যার আড়ালে ভূমধ্যসাগরের পরিস্থিতি ঢাকা পড়ে গেছে।
একটি ইউরোপীয় জরুরি অবস্থা
ইতালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখন অবৈধ অভিবাসন ঠেকানোর প্রচেষ্টায় একাকী হয়ে পড়েছে। ইউরোপীয় কমিশন তিউনিসিয়া, লিবিয়া এবং সাব-সাহারান দেশসমূহে বড় ধরনের বিনিয়োগের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল যাতে অভিবাসীরা ইতালীয় উপকূলে যাত্রা না করে।
মাত্র কয়েক মাস আগে, যখন মধ্য ভূমধ্যসাগরের রুটটিতে অভিবাসীদের আগমনে বিস্ফোরিত হবার উপক্রম, অবশেষে তখন উত্তর আফ্রিকা ইউরোপীয় জরুরি অবস্থার তালিকায় স্থান পেয়েছিল। স্বরাষ্ট্র বিষয়ক ইউরোপীয় কমিশনার ইলভা জোহানসন এই দেশগুলি পরিদর্শন করেছিলেন এবং ব্রাসেলস তাদের সাহায্য করবে বলে আশ্বাসও দিয়েছিল।
মারিও দ্রাগির ইতালীয় সরকার ভেবেছিল যে, এটি শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয়দের নাড়া দিয়েছে, কিন্তু মাস পেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছুই হয়নি। তিউনিসিয়ায় সামান্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। লিবিয়ায় কিছুই হয়নি। সাহারা অঞ্চলের অবস্থা তারচেয়েও খারাপ।
পলায়নপর মানুষের এ এক অন্তহীন নদী, যা শুকানোর কোনো লক্ষণ নেই
এসবের প্রভাব হিসেবে দেখা যাচ্ছে: অস্থির সমুদ্রে নাও ভাসানোর গণ যাত্রা, এনজিও এবং উদ্ধারকারী জাহাজের তৎপরতা; সিসিলির দক্ষিণে ল্যাম্পেডুসার ছোট্ট দ্বীপে উদ্ধারকারী জাহাজগুলি নিজেরাই পৌঁছে যাচ্ছে, যেখানে অভ্যর্থনা কেন্দ্রটি হাজার খানেক মানুষের চাপে বিস্ফোরিত প্রায়; সিসিলির ত্রাপানিতে সী আই ৪ জাহাজ থেকে হাজার খানেক অভিবাসীর অবতরণ; এবং আনুমানিক আরও ৩০৬ জন অভিবাসন প্রত্যাশী ওশেন ভাইকিং জাহাজে অগাস্টা পৌঁছাতে চলেছে। এ যেন এক ধরাবাধা চিত্রনাট্য
লোভী এবং অসাধু চোরাকারবারীদের নেতৃত্বে পলায়নরত মানুষের অনন্ত বহমান এ নদী শুকানোর কোনও লক্ষণ নেই। এমন একটি প্রেক্ষাপটে, ইইউ-এর পূর্ব সীমান্তের দিকে অর্থায়ন ও মনোযোগ ইতালির জন্য আক্ষেপই বটে।
ভূমধ্যসাগর অপেক্ষা করতে পারে
মারিও দ্রাগি নিজেই এমন একটি তড়িৎপরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন যা তিনি আশা করেননি। এটি ঠিক গত মাসের ঘটনা, যখন ব্রাসেলসে অভিবাসন বিষয়ক ইউরোপীয় কাউন্সিলের বৈঠক শেষে, ইতালীয় প্রধানমন্ত্রী সন্তুষ্টি নিয়ে সম্মেলনের চূড়ান্ত বিবৃতিটি পড়েছিলেন।
ইতালীয়রা আশা করেছিল, ইইউ এর অভিবাসন নীতির উপর ভূমধ্যসাগরীয় সংকট একটি বৃহত্তর আলোচনার দিকে নিয়ে যাবে। স্পষ্টতই ইতালির জন্য বছরের পর বছর ধরে চলমান সমস্যাটি সমাধানে দ্রাগির প্রত্যাশা অনেকখানি অনিশ্চিয়তায় গিয়ে ঠেকেছে।
সরকারের কূটনৈতিক সূত্র থেকে এটিই নিশ্চিত করা হয়েছে যে, অভিবাসীদের নিয়ে বেলারুশ পোল্যান্ডে যে বিরোধ ছড়িয়ে পড়ছে তা হঠাৎ করে ইউনিয়নের অগ্রাধিকারের বিষয় হয়ে উঠেছে। ইউরোপ শেষ পর্যন্ত ইতালির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করবে সেই আশার বানীর সঙ্গে সঙ্গে উত্তর আফ্রিকা, লিবিয়া, ভূমধ্যসাগর এবং অন্য সব স্থানও অগ্রাধিকারের তালিকায় পিছনের সারিতে চলে গেছে।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ভূ-কৌশলগত প্রভাব এবং সম্ভাব্য যুদ্ধের পরিস্থিতি বিবেচনায় ইউরোপের ‘পূর্ব রুট’ যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ। প্রাক্তন সোভিয়েত প্রভাবিত অঞ্চলের অন্তর্গত যে দেশগুলোর সীমানায় রাশিয়ার প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে, ইউরোপকে অবশ্যই সে সব সীমান্ত প্রতিরোধ করার জন্য সিদ্ধান্তমূলকভাবে কাজ করতে হবে। সার্বিক পরিস্থিতি দেখে এটাই মনে হচ্ছে, ভূমধ্যসাগরকে হয়তো আরো অপেক্ষা করতে হতে পারে।
লেখক: ফ্রান্সেসকো গ্রিগনেটি এবং ইলারিও লোম্বার্দো। সংবাদ মাধ্যম ওয়ার্ল্ডক্রাঞ্চ এ প্রকাশিত এই নিবন্ধটি ভাষান্তর করেছেন খুর্শিদা জাহান