অমর বৈরাগী, ১৯৭১ সালের ১৯ মে পাক-হানাদার বাহিনীর হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘর ছেড়েছিলেন। ছয় বছর বয়সে শরণার্থী হয়ে যাত্রা করেন ভারতের উদ্দেশে।
‘লক্ষ মানুষ ভাত চেয়ে মরে। লক্ষ মানুষ শোকে ভেসে যায়। ঘরহীন ভাসে শত শত লোক। লক্ষ জননী পাগল প্রায়। রিফিউজি ঘরে খিদে পাওয়া শিশু। পেটগুলো সব ফুলে-ফেঁপে ওঠে। এইটুকু শিশু এতবড় চোখ। দিশেহারা মা কার কাছে ছোটে। সেপ্টেম্বর হায় একাত্তর। যশোর রোড যে কত কথা বলে। এত মরা মুখ আধমরা পায়ে পূর্ব বাংলা থেকে কোলকাতা চলে’- মার্কিন কবি অ্যালেন্স গিন্সবার্গ তার কালজয়ী কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ এ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার শরণার্থীদের দুঃসহ বিভীষিকাময় সেই পথ যাত্রার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে।

একাত্তরে ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় এক কোটি শরণার্থীর বেশিরভাগেরই ঠাঁই হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে। যশোর রোড ধরে লক্ষ লক্ষ মানুষ তখন প্রাণভয়ে ছুটছে উন্মত্তের মতো। কতো মৃত্যু, কতো বেদনা, কতো হাহাকার আর আর্তনাদ লুকিয়ে আছে ওই যশোর রোডের বুকে তার হিসেব কারো জানা নেই। কালের ধূলোয় পেরিয়ে গেছে পঞ্চাশটি বছর, কিন্তু সেই ভয়ার্ত স্মৃতি আজো বয়ে নিয়ে চলেছেন বেঁচে ফেরা শরণার্থীরা।
অমর বৈরাগী একাত্তরের সেরকম একদিনে যশোর রোডের উদ্বাস্তুর মিছিলে সামিল হয়েছিলেন ; ছুটে চলছিলেন পরিবারের হাত ধরে। কিন্তু মাঝ পথে এলোমেলো হয়ে যায় সব। খুব অল্প বয়সেই দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন তিনি। তবুও বালক বয়সের সেই দুঃসহ স্মৃতিগুলো আজো যেন পরিণত অমর বৈরাগীর অন্তরের স্মৃতিপটে জ্বলজ্বল করছে।
‘আমরা তখন বাড়ি থেকে অনেক দূর চলে এসেছি। লোকমুখে খবর আসছে বাদামতলায় গুলি হয়েছে।’- দৃষ্টিহীন চোখ দুটি বন্ধ করে যেন অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে স্মৃতিপাঠ করে চলেছেন অমর বৈরাগী। খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার দ্বীপগ্রাম বলাবুনিয়া, এখানেই তার বসবাস। বাদামতলী বাজারের কাছেই বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে পৌঁছুতে হয় বলাবুনিয়া গ্রামে। আর পঞ্চাশ বছর আগে নৌকাই ছিল এসব এলাকার প্রধান বাহন।
একাত্তরের ১৮ মে মিলিটারিরা গান বোট নিয়ে বটিয়াঘাটার কাজিবাছা নদীর পশ্চিমপাড়ে হামলা চালায়। এ খবর ছড়িয়ে পড়ায় আশেপাশের গ্রামের লোকেরা দ্রুত নৌকা করে ভারতের দিকে রওয়ানা দেয়। অমর বৈরাগীর বয়স তখন পাঁচ কি ছয় বছর। পরের দিন ১৯ মে মা-বাবা, জ্যাঠা-জ্যাঠিমা ও নয় ভাই-বোনসহ তার পরিবারের ১৩ সদস্য উঠে পড়লেন নৌকায়
অকুল পাথারে যাত্রা
‘শালতা নদী দিয়ে আমাদের নৌকা চলছে। সামনে পিছনে শত সহস্র নৌকা। সন্ধ্যার দিকে আমাদের নৌকার বহর এসে পৌঁছালো চুকনগরের অনতিদূরে কাঠালতলা নামক স্থানে। সেখানেই নৌকায় রাত্রিযাপন। খুব ভোরে আমাদের কাছে খবর এলো-এখানে গুলি হতে পারে। তাই আর এক মুহূর্ত দেরি নয়, পালাতে হবে; এবার পায়ে চলার পথ। চলতে চলতে পথে সন্ধ্যা নামলো। পাথরঘাটায় এক বাঁশবাগানে রাত্রিযাপন। পরের দিন সকালে আবার শুরু হলো পথ চলা। সামনে ঝাউডাঙ্গা।

অভিশপ্ত ঝাউডাঙ্গা বাজার!
কিছুক্ষণ থেমে আবারো বলতে শুরু করলেন তিনি, ‘আমি তখন খুব ছোট। আকাশে মে মাসের প্রখর রোদ্দুর। কখনো হেঁটে কখনো বা কারো কোলে উঠে চড়েছি। আমি তখন আমার দাদু (মাতামহ) সতীশ তরফদারের হাত ধরে চলছি। তেষ্টা পেয়েছে বলতেই দাদু সে কথা বাবাকে জানালো। ছবিটা আজও আমার চোখে জ্বলজ্বল করে। বাবা নিজের কোমরে গোঁজা ব্যাগ থেকে একটি আধুলি দিলেন ডাব কেনার জন্য। তারপর আমরা ডাব কিনতে গিয়ে জনারণ্যে হারিয়ে গেলাম। দাদুর সঙ্গে সামনে এগোতে থাকি। সেই দিনের পর থেকে আর কেনোদিন বাবার সঙ্গে দেখা হয়নি।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবারো বলে যান অমর বৈরাগী, ‘পরে ছোড়দার কাছ থেকে শুনেছিলাম- বাবা-মা যেই দলের সঙ্গে আসছিলেন সেখানে মিলিটারিরা এল এম জি দিয়ে ব্রাশ ফায়ার করলো। সঙ্গে সঙ্গে চলমান ভয়ার্ত জনতা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।’

‘ঐ দুঃসময়ের মধ্যেও বেঁচে থাকা জ্ঞান বাবু (শিক্ষক) ও আমার জ্যাঠাতো ভাই মনোরঞ্জন বৈরাগী এসব দৃশ্য স্বচক্ষে দেখেন। চারটে লাশ জ্ঞান বাবুর গায়ের উপর পড়ায় তিনি গুলির হাত থেকে বেঁচে যান। ছোড়দা (মনোরঞ্জন বৈরাগী) বুটের তলায় পিষ্ট হন। তাই তারা তাকে মৃত মনে করে আর গুলি করেনি। মিলিটারিরা চলে গেলে চারিদিকে কেবল কান্না আর অর্ধমৃতের যন্ত্রণার চিৎকার। ওখানেই আমার বাবা, জ্যাঠা মহাশয় ও বড়দা গুলিবিদ্ধ হন। মৃত্যুকালে তাদের মুখে জল দেয়ার মতো কোনো পাত্র ছিল না। ছোড়দা নাগরা জুতায় করে পাশের খাল থেকে জল এনে তাদের মুখে দেন।’
‘ওই তাণ্ডবের পর আমাদের পরিবারের লোকসংখ্যা তেরো থেকে দশে এসে পৌঁছালো। যতদূর জানা যায়, ওই খান সেনারা কোনো মহিলাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েনি। তাই আমার জ্যেঠিমা ও মা বেঁচে গেছেন। তারা তখন দিশেহারা। কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। তখন জ্যেঠিমার বড়দা বললেন,‘ যারা চলে গেছে তাদের তো আর পাওয়া যাবেনা। যারা বেঁচে আছে তাদেরকে নিয়ে এক্ষণি পালাতে হবে নইলে সবাইকে মরতে হবে। সেই অবস্থাতেই তিনি সবাইকে নিয়ে ভারতের দিকে ছুটলেন।’
সীমান্তের ওপারে
অমর বৈরাগী তার দাদুর হাত ধরে যশোর রোড পেরিয়ে আগেই পৌঁছে গিয়েছিলেন ভারতের বসিরহাটে। তিনি বলছিলেন, ‘কিছুক্ষণের মধ্যে আমার এক মামা দাদুর কানে কানে নিচুস্বরে বলছে,‘ বিনয় দা ও কালিপদ দা আর নেই।’ আমি মুহূর্তেই জানতে চাইলাম, কি হয়েছে? দু’জনেই নিরব। আমি বললাম বাবা কোথায়? মা কোথায়? দাদু কাঁদছেন। পরদিন বড়দি, মেজদি ছোট বোন ও ছোট ভাইকে নিয়ে মা পৌঁছালো।’
‘আমার ছোট ভাই সমরের বয়স তখন দেড় মাস। সন্ধ্যা নাগাদ সীমান্ত পার হয়ে বসিরহাটে পৌছানোর পর আমার এক আত্মীয়া মায়ের কোল থেকে ছোট ভাই সমরকে নেয় এবং দেখে তার কোনো নড়াচড়া নেই। এই ক’ঘন্টা মা তাকে কোলে নিয়ে শুধু বেহুশের মতো হেঁটেছে। কিছু না খেয়ে সে মরণাপন্ন। সেইদিন সেই আত্মীয়া নিজের বুকের দুধ পান করিয়ে তাকে বাঁচিয়েছিলেন।’

শরণার্থী ক্যাম্প
‘বসিরহাটে কিছুদিন অবস্থানের পর ডাক ট্রেনে করে আমরা চলে গেলাম বাঁকুড়ার গামারবাড়ি ক্যাম্পে। বালির মধ্যে প্রচণ্ড গরমে গাদাগাদি করে তাবু টানিয়ে থাকতাম সেখানে। আটা, চিনি আর কৌটার মধ্যে একধরণের গলানো মাংস দেওয়া হতো খাওয়ার জন্য। সরকারি অনুদানের যেসব সাহায্য আসতো সেগুলোর ওপর নির্ভর করতে হতো আমাদের। দেখতাম, প্রতিদিনই কারণে অকারণে ক্যাম্পের অনেক মানুষ মারা যেত। বন্যায় তাবুতে পানি উঠে যেত।’
‘তখন আমরা একটা পরিত্যক্ত প্লাটফর্মে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমি যেহেতু খুব ছোট ছিলাম, তাই আমরা কেন এখানে থাকছি অথবা যুদ্ধ, স্বাধীনতা এসব ওতো বুঝে উঠতে পারতাম না। তবে বাবাকে দেখতে না পাওয়ার যন্ত্রণা আমাকে খুব পীড়া দিত। ক্যাম্পের কেউ কেউ রেডিওতে আকাশ বাণীর খবর শুনতো। একদিন সবাই খুব আনন্দিত হয়ে বলতে লাগল, দেশ স্বাধীন হয়েছে। তারপর সবাই দেশে ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়লো।’

স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তন
চোখে মুখে খুশির ঝিঁলিক ছড়িয়ে অমর বৈরাগী বলে উঠলেন- ‘আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে ক্যাম্পের সামনে অনেকগুলো লরি দাড়িয়ে আছে। এই লরিতে করে মানুষদের দেশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমরা সবাই বিশাল একটি লরিতে উঠলাম। ওটাই ছিল আমাদের সবার গাড়ীতে উঠার প্রথম অভিজ্ঞতা। একদিন পর আমাদেরকে নামিয়ে দেওয়া হলো গল্লামারি। বাড়িতে ফিরে দেখলাম, ঘরবাড়ি সবকিছু পুড়ে ছাই।’
‘তারপর থেকে শুরু হলো আরেক জীবনযুদ্ধ। তবে দাদু ছিলেন বলে আমরা অভিভাবক শূন্য হইনি। কিন্তু পিতৃস্নেহের পরশ আজও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। আজও বাবাকে স্বপ্ন দেখি, চোখ বুজলেই দেখতে পাই সুদর্শন, সুঠামদেহী বাবা আমার দাদুর হাতে একটি আধুলী দিচ্ছে।’ শরণার্থী জীবন কিংবা যুদ্ধোত্তর দিনগুলোর অসহনীয় কষ্ট কোনো কিছুই বাবা হারানোর যাতনার চেয়ে আমাকে ভারাক্রান্ত করে না।’