ফুটপাতে ঘুমানোর অধিকারও খর্ব করবে যুক্তরাজ্যের নতুন অভিবাসন নীতি!

0
518
প্রতিনিয়ত লন্ডনের রাস্তায় এভাবেই ঘুমিয়ে থাকতে দেখা যায় গৃহহীন হাজারো মানুষকে। (Photo by TOLGA AKMEN / AFP) / TO GO WITH AFP STORY BY ROLAND JACKSON (Photo by TOLGA AKMEN/AFP via Getty Images)


পৃথিবীজুড়ে আশ্রয়হীন মানুষের সংখ্যা আশংকাজনক হারে বাড়ছে। মাথা গোজার ঠাঁই করতে না পেরে বাধ্য হয়ে ফুটপাতে বা রাস্তায় ঘুমিয়ে পড়ার দৃশ্য নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে যুক্তরাজ্যের রাস্তা বা ফুটপাতে ঘুমানোর নূন্যতম এই অধিকারটুকুও হারাতে বসেছে আশ্রয়হীন অভিবাসীরা। দেশটির নাগরিক নন এমন অভিবাসী, যারা কিনা ফুটপাত অথবা রাস্তার পাশে ঘুমায়, তাদেরকে রাফ স্লিপার অ্যাখ্যা দিয়ে নতুন আইন করে দেশত্যাগে পর্যন্ত বাধ্য করছে। দেশটির করা নতুন অভিবাসন নীতির আওতায় এসব মানুষের ভিসাও বাতিল করা হচ্ছে। যুক্তরাজ্য সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত নতুন একগুচ্ছ অভিবাসন নীতি অনুসারে এই কার্যক্রমটি ১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে। অবশ্য লন্ডনের বেশ কয়েকটি ব্যুরো কাউন্সিল এই নীতিমালার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে

চলতি বছরের ১ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্য সরকার অভিবাসন বিষয়ক একগুচ্ছ নতুন নীতিমালা প্রবর্তন করে। দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধিত হতে যাওয়া জনস্বাস্থ্য আইনকেন্দ্র (পিআইএলসি) নামের একটি কমিউনিটি আইন সংস্থার প্রকাশিত তথ্যমতে, এই নীতিমালার অংশ হিসেবে, অভিবাসীদের রাস্তা ও ফুটপাতে ঘুমানোর কারণে (রাফ স্লিপিং) যুক্তরাজ্যে থাকার অনুমতি বাতিল করার ঘটনা ঘটছে।
পিআইএলসি এর তথ্যমতে, নতুন এই নীতিমালা ‘কর্মী, দর্শনার্থী বা শিক্ষার্থী ভিসা; পাঁচার ও আধুনিক দাসত্বের শিকার ব্যক্তিদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ২০২১ সালের ৩০ জুনের আগে ইইউ নিষ্পত্তি প্রকল্পে আবেদন করেনি এমন ইইউ নাগরিকসহ অভিবাসীদের আরো কয়েকটি ক্যাটাগরি এর আওতায় পড়তে পারে। এমনকি এই নীতিমালা চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বরের পরে ইইউ থেকে আগতদের উপরও প্রভাব ফেলতে পারে।’
তবে “সর্বাধিক শরনার্থী এবং আশ্রয়প্রার্থী”, পাশাপাশি যে কেউ “ ব্যক্তিগত বিষয়ের ভিত্তিতে (ইসিএইচআর) এর ৮ নম্বর অনুচ্ছেদের অধীনে যুক্তরাজ্যে থাকতে আবেদন করেছেন এবং অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে থাকা ব্যক্তিবর্গ ও ইইউ নিষ্পত্তি প্রকল্পের আবেদনকারীরা এই নতুন নিয়মের বাইরে থাকবেন।”


‘প্রত্যাখান করার অঙ্গীকার করুন’


দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার একটি নিবন্ধ অনুসারে, লন্ডনের বেশ কয়েকটি ব্যুরো কাউন্সিল, পাশাপাশি গৃহহীন লোকদের নিয়ে কাজ করা কিছু দাতব্য সংস্থা নতুন এই নীতিমালা ‘প্রত্যাহার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাদের মতে, এই নীতি ‘রাফ স্লিপার’দের অপরাধী হয়ে উঠতে এবং বিতাড়িত হতে বাধ্য করবে।’
যুক্তরাজ্যে গৃহহীনতার অবসান ঘটাতে কাজ করে এমন ৭০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ক্রাইসিস নামের একটি সংস্থা নতুন নিয়ম কার্যকর হওয়ার আগেই ৬ নভেম্বর ,এই নীতিমালা পুনর্বিবেচনার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানিয়ে একটি খোলা চিঠি পাঠিয়েছিল। চিঠিতে স্বাক্ষরকারীরা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে জানান, মহামারী চলাকালীন কর্মসংস্থানের সংকটের কারনে যুক্তরাজ্যের আইনসিদ্ধ/ বৈধ অভিবাসীদের অনেকে ‘রাফ ‘রাফ স্লিপিং’ ও বিতাড়িত হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে শোষণমূলক কাজ ও আধুনিক দাসত্বের দিকে ধাবিত হতে পারে।
বৃটিশ স্বরাষ্ট্রসচিব প্রীতি প্যাটেল যদিও এই নতুন অভিবাসন নীতিমালা ঢেলে সাজানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু তারপরও ১ ডিসেম্বর এই নতুন নীতিমালাটি কার্যকর হয়।


মহামারী বিষয়টিকে আরো কঠিন করে তুলছে


প্রচুর সংখ্যক অভিবাসী যারা ক্যাটারিং এবং ক্ষুদ্রশিল্পে কাজ করেন, কোভিড-১৯ মহামারীতে তারা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। অসংখ্য দোকান পাট, বার, ক্যাফে এবং রেস্তোরা একসঙ্গে কয়েকমাস বন্ধ রাখতে হয়েছিলো। অনেক কর্মচারির সুরক্ষার জন্য সাময়িক ছুটিজনিত একটি প্রকল্প চালু করা হয়েছিল, তবে তা আগস্টে শেষ হয়। প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংস্করণ শরৎকাল অবধি চালু ছিলো, তবে সেখানে ফ্রিল্যান্সিং বা অস্থায়ী চুক্তিতে থাকা কর্মীদের জন্য তা সহজলভ্য ছিলো না।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাজ্যে ছড়িয়ে পড়া নতুন প্রজাতির ভাইরাস ঘিরে আবারো যে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে, তাতে করে এইসব অভিবাসীদের সংকট আরো জটিল হতে চলেছে।

সুরক্ষা জাল ছড়িয়ে রাখুন


গৃহহীনদের নিয়ে কাজ করে এমন দাতব্য সংস্থার তথ্যমতে, মহামারীটির শুরুতে যারা পূর্বে আবাসন সহায়তা পাননি তাদের অনেককে থাকার জন্য স্থান দেওয়া হয়েছিল । পুরো শীতকাল জুড়ে এবং মহামারীটির দ্বিতীয় ঢেউ অব্যাহত থাকা পর্যন্ত এই সুরক্ষা জাল অব্যাহত রাখতে স্বাক্ষরকারী সংস্থাগুলো যুক্তরাজ্য সরকারকে আহবান জানায়। তারা বলছে যে, সরকার যদি এই নীতিমালা পরিবর্তন করার বিবেচনা করে, তাহলে গৃহহীন মানুষদের সহায়তায় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি কার্যকর করতে সরকারের সঙ্গে তারা একযোগে কাজ করবে।


সরকারি তহবিলে প্রবেশাধিকার নেই


গৃহহীনদের পুনর্বাসন নিয়ে কাজ করে এমন একটি প্রতিষ্ঠান ক্রাইসিস-এর প্রধান নির্বাহী জন স্পার্কস ইনসাইড ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যুক্তরাজ্যে থেকে যাওয়ার পরেও কিছু অভিবাসীদের জন্য তাদের সরকারি তহবিল ব্যবহার করার অনুমতি নেই। এর অর্থ হল তারা আবাসন সুবিধা বা বেকারত্বের সহায়তা পেতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। এসব লোকেরা যখন তাদের চাকরি হারায়, তারা দ্রুতই গৃহহীন হয়ে পড়তে পারে। দাতব্য সংস্থাগুলি এই শ্রেণীর অভিবাসীদের নিয়ে বেশি চিন্তিত।
এর আগে যুক্তরাজ্য সরকার “ইইউ মুক্ত আন্দোলনের অপব্যবহার” হিসেবে এই ‘রাফ স্লিপিং’ টার্মটি ব্যবহার করেছিল। তবে এই “অনুশীলনটি হাইকোর্ট ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে বেআইনী ঘোষণা করে”। এই আইনী চ্যালেঞ্জটি পিআইএলসি সামনে এনেছিল এবং তারা এখনকার পরিবর্তনের বিরুদ্ধে একটি নতুন চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করেছে।


লন্ডনের বেশিরভাগ অভিবাসী রাফ স্লিপার!


গার্ডিয়ানের তথ্যমতে, যুক্তরাজ্যের বেশিরভাগ অভিবাসী রাফ স্লিপাররা রাজধানী লন্ডনে রয়েছেন। লন্ডনের মেয়রের অধীনে গ্রেটার লন্ডন কর্তৃপক্ষ (জিএলএ) পাশাপাশি শ্রমিক-নেতৃত্বাধীন হারিঞ্জি আইলিংটন কাউন্সিলের মত পৃথক ব্যুরো কাউন্সিল জানিয়েছে যে, তারা এই নীতিতে হোম অফিসকে সহায়তা করবে না।
পিআইএলসি গার্ডিয়ানকে বলেছে যে, নিয়মগুলি ‘খুব সাধারণ অভিবাসী, যেসব অফিসকর্মী গভীর রাতে তাদের ডেস্কে মাথা রেখে বা ভোরের একটি বিমান ধরার আগে বিমানবন্দরে ঘুমাচ্ছিলেন, এমন ভ্রমণকারীরাও এই নীতির আওতায় পড়তে পারেন।


নতুন নিয়মের বিরোধিতা করা দরকার

পূর্ব লন্ডনের নির্বাচনী এলাকা পপলার ও লাইমহাউজের লেবারপার্টির সাংসদ আপসানা বেগম টুইটারে বলেছেন যে, “তিনি বিশ্বাস করেন যে নতুন নিয়মটির বিরোধিতা করা প্রয়োজন।”
পূর্ব অফ্রিকার এক অভিবাসী গার্ডিয়ানকে বলেছেন যে, তিনি তিন বছর ধরে গৃহহীন ছিলেন এবং তিনি সবসময় গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কা করতেন। ৩৮ বছর বয়সী ওই যুবক আরো বলেন, “ভ্রমন করা, কাজ করা অথবা সুবিধা চাওয়ার কোনো অনুমতি আমার নেই। আমার জীবন আর আমার নিজের নয়।”
তবে যুক্তরাজ্য সরকার গার্ডিয়ানকে নিশ্চিত করেছে যে , “নীতিমালাটি কেবলমাত্র সংখ্যালঘু ‘রাফ স্লিপারদের’ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যারা বারবার স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সহায়তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অবিরাম অসামাজিক আচরণে লিপ্ত থাকে, তাদের যুক্তরাজ্যে থাকার অধিকার হারাতে হবে।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here