অভিবাসনপ্রত্যাশীদের কাছে আশ্রয় শিবির যেন উন্মুক্ত কারাগার

0
1060

জীবনকে নতুন করে সাজানোর দুচোখভরা স্বপ্ন নিয়ে যে মানুষগুলো মাতৃভূমি ত্যাগ করে, তাদের সবার স্বপ্নই কি পূরণ হয়? নাকি তাদের স্বপ্ন ফিঁকে হয়ে যায় অদৃশ্যসব দুর্ভাগ্যের কাছে?

আইওএম এর আশ্রয়শিবিরকে ‘উন্মুক্ত কারাগার’ হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করেছেন আফগান শরণার্থী আমিরি। তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে স্বাধীন কিন্তু মুক্ত নই।’

অভিযোগ উঠেছে, আত্মহত্যার মতো এরকম ঘটনা নিয়মিত ঘটছে ইন্দোনেশিয়াতেও। দেশটিতে বছরের পর বছর ধরে আটক থাকা শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীদের অনেকে জানিয়েছেন, ইমিগ্রেশন ডিটেনশন সেন্টার ও দাতাসংস্থাগুলোর অর্থায়নে পরিচালিত আশ্রয়শিবিরগুলোতে মানসিক সমস্যায় ভুগে আত্মহত্যার ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।

শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীদের সঙ্গে কথপোকথনের পর সংবাদমাধ্যম ‘দ্য নিউ হিউম্যানিটারিয়ান’ এর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এখানে ২০১৪ সাল থেকে কমপক্ষে ১৩ জন আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে কেবল গত বছরই মারা গেছেন চার জন। এদের একজন ৩০ বছর বয়সী এক আফগান যুবক। যিনি পশ্চিম ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার বানটেন প্রদেশে জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা আইওএম এর অর্থায়নে নির্মিত একটি আশ্রয় শিবিরে গত বছরের ডিসেম্বরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।

আশ্রয়প্রার্থীরা মূলত অন্য দেশে যাওয়ার জন্য ইন্দোনেশিয়াকে ট্রানজিট দেশ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এই আশ্রয়প্রার্থীদের অর্ধেকই আফগানিস্তান থেকে আগত। বাকিরা সোমালিয়া, মিয়ানমার, ইরাক ও সুদানের নাগরিক।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে সংঘাতে কারণে অনেকেই, যারা কিনা নিজেদের পুনর্বাসনে সক্ষম নয়, বাড়ি ফিরতে রাজি নয়, এমনকি ইন্দোনেশিয়াতে যাদের নতুন জীবন গড়ে তোলার সামর্থ্য নেই, তারা নিরাপদ দেশগুলোতে আশ্রয়লাভের প্রত্যাশায় দেশটিকে ট্রানজিট দেশ হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।

হাসান রামাজান, ৪২ বছর বয়সী একজন আশ্রয়প্রার্থী, পশ্চিম জাকার্তার একটি আশ্রয়শিবিরে বসবাস করছিলেন তিনি। গত মাসে খাদ্যে বিষক্রিয়ার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। জানা গেছে, খাদ্যে বিষ প্রয়োগ করে তাকে কেউ হত্যা করতে চেয়েছিল। তিনি জানান, আফগানিস্তানে তার বাবা ও সন্তান রয়েছে। ‘ তিন চার বছর আগেও বেশ স্বাস্থ্যবান একজন মানুষ ছিলেন আমার বাবা। কিন্তু একদিকে যুদ্ধের বিভীষিকা, অন্যদিকে সন্তানের অনিশ্চিত জীবন, এই চিন্তায় সেই মানুষটি আজকাল যেন নিজের খেই হারিয়ে ফেলেছেন। আমার অনুপস্থিতিতে তাদের ভাগ্যে কী ঘটবে? কীভাবে আপনি এর ব্যাখ্যা দেবেন?’ পরিবারকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন রামাজান।

বর্তমানে শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীরা ইন্দোনেশিয়ার শহর এলাকাগুলোতে বসবাস করছে। এসব জায়গায় কিছু ইমিগ্রেশন ডিটনশন সেন্টার রয়েছে। বাকিগুলো আইওএম এর অর্থায়নে নির্মিত কমিউনিটি হাউজিং। এখানে যাদের জায়গা হচ্ছে না, তারা রাস্তায় অথবা তাবুতে বসবাস করছে। আইওএম বলছে, তারা ৭ হাজার শরণার্থীকে সহায়তা করছে। মাসিক ভাতা ও অন্যান্য সেবা প্রদান করা হচ্ছে তাদের। এছাড়া অন্যান্য এনজিও ও স্থানীয় সংগঠনগুলো আশ্রয়প্রার্থীদের মৌলিক সেবা প্রদানের চেষ্টা করছে। এত কিছুর পরও আশ্রয়প্রার্থী ও শরণার্থীদের অভিযোগ তারা খুবই খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে দিনযাপন করছে।

রামাজান অবস্থান করছেন পশ্চিম জাকার্তার কালিদেরেসে। এখানে একটি পরিত্যক্ত মিলিটারি পোস্টে ২৩০ জনেরও বেশি মানুষ গাদাগাদি করে বসবাস করছেন। এতগুলো মানুষের জন্য এখানে রয়েছে মাত্র দুটি ছোটো টয়লেট। এরকম নানাবিধ সংকটের কারণে অনেকেই মানসিকভাবে আরো বিষন্ন হয়ে পড়ছেন বলে জানান তিনি।

‘আশ্রয় শিবিরে অবস্থানরত কিছু মানুষ যাদের পুরোনো ফোন আছে এবং যাদের নাম্বার ইউএনএইচসিআর এর দ্বারা নিবন্ধিত-তারা তাদের ফোনটি হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘুমাতে যায়, আর অপেক্ষা করতে থাকে, কখন একটি কল আসবে (পুনর্বাসন বিষয়ে)। এই অপেক্ষা বেদনার, এই অপেক্ষা তাদের মনে করিয়ে দেয়, ‘আমাদের জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।’

রামাজান ১৯৯০ এর দিকে আফগানিস্তানে থেকে পালিয়ে পাকিস্তানে গিয়ে দুই দশক সেখানে বসবাস করেন। এরপর ২০১৬ সালে ইন্দোনেশিয়া আসেন। তার পরিবার পাকিস্তানেই থেকে যায়। পাকিস্তানে প্রায় ১৪ লাখ আফগান শরণার্থী রয়েছে। যার মধ্যে কমপক্ষে ৫ লাখ অনিবন্ধিত। দেশটি প্রতিনিয়তই এসব শরণার্থীদের তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছে।

‘আমার মেয়ে তার মাকে সবসময় প্রশ্ন করে, কখন বাবা আসবে? এবং তার মা উত্তর দেয়, শীঘ্রই আসবে’। রামাজান বলেন, ‘এখন আর আমার মেয়ে এসব কথা বিশ্বাস করে না।’

আসাদুল্লাহ আমিরি, ৩০ বছর বয়সী এ শরণার্থী আফগানিস্তান থেকে ইন্দোনেশিয়া আসেন আট বছর আগে। মাকাসার, দক্ষিণ সুলাওসি প্রদেশে আইওএম এর সহায়তায় মুক্তির আগে একটি ডিটেনশন সেন্টারে তিনি দুই বছর ছিলেন। তিনি বলেন, গত বছর দক্ষিণ সুলাওসি প্রদেশের মাকাসারে আইওএম পরিচালিত আশ্রয়শিবিরে দুই ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে তার এক আফগান বন্ধু রয়েছেন, যিনি গত জুলাইয়ে আত্মহত্যা করেছেন।

আইওএম এর আশ্রয়শিবিরকে ‘উন্মুক্ত কারাগার’ হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করেছেন আমিরি। তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে স্বাধীন কিন্তু মুক্ত নই।’ মাকাসার এই জীবনকে দুর্বিষহ অ্যাখ্যা দিয়ে তিনি জানান, এখানে নিয়মিত আত্মহত্যার চেষ্টা করে মানুষ। অনেকের আবার অভিযোগ শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীদের কেউ কেউ ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার দ্বারা নির্যাতনের শিকার হন।

জাফর হাসান, সুমাত্রার পেকানবারু দ্বীপে অবস্থানরত একজন শরণার্থী, তিনি বলছেন, তার ভাই গত বছর একটি ডিটেনশন সেন্টারে মারা যায়। এর আগে তীব্র মাথাব্যাথা হচ্ছে জানিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেছিলেন তিনি। ‘ কিন্তু কেউ আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি।’
এদিকে সংবাদমাধ্যম ‘দ্য নিউ হিউম্যানিটারিয়ান’ এসব বিষয় নিয়ে আইওএম এর মুখপাত্র আরিয়ানি হাসানা সোয়েজোতির কাছে ব্যাখ্যা চাইলে তিনি লিখিত এক বক্তব্যে শরণার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনাকে ‘বৈশ্বিক উদ্বেগ’ হিসেবে অ্যাখা দেন। এসময় তিনি বলেন, ‘শরণার্থীরা সবখানেই অতিরিক্ত মানসিক চাপের মুখোমুখি হচ্ছেন।’

অবশ্য আইওএম এর এ মুখপাত্র আইওএম পরিচালিত আশ্রয়শিবিরগুলোতে আত্মহত্যার ঘটনা প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।

এত কিছুর পরও ইন্দোনেশিয়ায় ছুটে আসা শরণার্থীরা স্বপ্ন দেখেন স্বচ্ছল ও স্বাভাবিকভাবে দেশটিতে অবস্থান করতে। যার প্রতিধ্বনি শোনা যায় আশ্রয়প্রার্থী বভেলন ও রামাজানের ভাষায়। প্রথমজনের বক্তব্য হল- যদি সম্ভব হতো তাহলে তিনি ইন্দোনেশিয়ার নাগরিকত্ব নেয়ার সুযোগটি গ্রহণ করতেন। ‘ইন্দোনেশিয়া আমার জন্য অন্তত নিরাপদ জায়গা। আমি এখানে থাকতে চাই।’

আর ৪২ বছর বয়সী আশ্রয়প্রার্থী হাসান রামাজান বলেন, ‘সবাই অবগত যে, আফগানিস্তানে কোনো শান্তি নেই। আমি আর সেখানে ফিরে যেতে চাই না’

সমাধানের পথ আছে…

ইন্দোনেশিয়ার নিযুক্ত ইউএনএইচসিআর এর মুখপাত্র অ্যান মেমান জানান, শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা বিপর্যস্তকর পরিস্থিতি তৈরি করছে। সমস্যার সমাধানে কাউন্সেলিংয়ের মতো মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রোগ্রামগুলো আরো বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। তার পরামর্শ , স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে শরণার্থীদের খাপ খাইয়ে নেয়া, শিক্ষার অধিকার আরো বেশি সুসংহত করা, প্রশিক্ষণ অথবা আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে, যাতে করে তারা একটি অর্থবহ জীবনযাপন উপভোগ করার পরিবেশ পায়। এ বিষয়ে অবশ্য ইন্দোনেশিয়ার ইমিগ্রেশন বিভাগের মহাপরিচালক কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here